Inqilab Logo

শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

চট্টগ্রামে ঘোষণা ছাড়াই বন্ধ দুটি পোশাক কারখানা, বেকার ৬০০ শ্রমিক

সড়ক অবরোধ করে শ্রমিকদের বিক্ষোভ : পুলিশের লাঠিচার্জ : ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া

রফিকুল ইসলাম সেলিম | প্রকাশের সময় : ১৮ নভেম্বর, ২০২২, ১২:০৭ এএম

বৈশি^ক অর্থনৈতিক মন্দায় বন্ধের পথে আরো বেশ কয়েকটি
হঠাৎ বেকার হয়ে পড়লেন ৬০০ জন শ্রমিক। একদিন আগেও তারা বুঝতে পারেননি তাদের জন্য অপেক্ষা করছে এমন দুঃসংবাদ। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে যথারীতি অফিসে এসে দেখেন কারখানার দরজায় তালা। সেখানে ঝুলছে বন্ধের নোটিশ। এ যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত। প্রথমে হাউমাউ কান্না, চিৎকার। এরপর সড়ক অবরোধ করে তীব্র প্রতিবাদ-বিক্ষোভ।

চট্টগ্রাম নগরীর বাকলিয়া থানার কর্ণফুলী সেতু এলাকার নিউ চর চাক্তাই সড়কের ডিপস অ্যাপারেলস লিমিটেডের তৈরী পোশাক কারখানার দুটি ইউনিট হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতে মহাবিপাকে পড়েছেন ছয় শতাধিক শ্রমিক কর্মচারী। মালিক পক্ষের বরাত দিয়ে পুলিশ বলছে, বৈশি^ক অর্থনীতিতে মন্দার প্রভাবে কারখানা দুটি বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া কোন উপায় ছিল না।

কারণ গত কয়েক মাস ধরে কারখানা দুটিতে বিদেশী ক্রেতাদের পক্ষ থেকে তৈরী পোশকের কোন অর্ডার আসছিলো না। তাতে কাজ কমে যায়। কর্তৃপক্ষ লোকসান দিয়েই কারখানা চালু রেখেছিলো। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার কারণে দেশের তৈরী পোশাক রফতানি আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। অর্ডার কমেছে প্রায় ২৫ থেকে ৩৫ শতাংশ। আর দেশে চলমান গ্যাস, বিদ্যুৎসহ জ্বালানি সঙ্কটে উৎপাদন কমেছে আরো ২০ থেকে ৩০ শতাংশ।

অন্যদিকে ডলার সঙ্কটের কারণে কাঁচামাল আমদানির এলসিও খোলা যাচ্ছে না। বিজিএমইএ নেতারা বলছেন, চট্টগ্রামের বিভিন্ন কারখানায় আটকা পড়ে আছে তিন হাজার কোটি টাকার রফতানি পোশাক। অর্ডার দিয়েও বিদেশি ক্রেতারা এসব পোশাক নিচ্ছেন না। এ অবস্থায় গভীর সঙ্কটে নিপতিত হয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় রফতানি এই খাত।

বেশিরভাগ কারখানায় শ্রমিকদের অনেকটা বসিয়ে বসিয়ে বেতন ভাতা দিতে হচ্ছে। এ ব্যাপারে ব্যাংকগুলো থেকেও কোন রকম সহযোগিতা মিলছে না। সরকারি তরফেও কোন সহযোগিতার আশ^াস নেই। ফলে বাধ্য হয়ে অনেক মালিক ইতোমধ্যে শ্রমিক ছাঁটাই শুরু করেছেন। শিল্প পুলিশের হিসাবে গত কয়েকদিনে বিজিএমইএর সদস্য নয় এমন অন্তত ২০টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও শ্রমিক ছাঁটাই করা হয়েছে। আর একদিনেই বিজিএমইএর সদস্যভূক্ত দুটি কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হলো। এর জের ধরে খুব শিগগির আরো কয়েকটি কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে বলেও বিজিএমইএ সূত্র জানিয়েছে।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক প্রফেসর ড. আবুল কালাম আযাদ বলেন, এভাবে পোশাক কারখানা বন্ধ হতে থাকলে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। আর্থ-সামাজিক অবস্থায়ও এর প্রভাব হবে ভয়াবহ। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স এবং রফতানিমুখী তৈরী পোশাক খাতের মতো দুটি গুরুত্বপূর্ণ খাতে এমন নাজুক অবস্থা দেশের অর্থনীতিকে আরো বেশি দুর্বল করে তুলবে। এমনিতেই মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতিতে মানুষ দিশেহারা। তার উপর বেকারের সংখ্যা বাড়লে দেশ কঠিন সঙ্কটের দিকে ধাবিত হতে।

এদিকে কোন ঘোষণা ছাড়াই ডিপস অ্যাপারেলসের দুটি ইউনিট বন্ধ করে দেওয়ার প্রতিবাদে সকাল ৯টা থেকে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন কারখানার শ্রমিকেরা। তাদের অবরোধের ফলে সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে করে মহানগরীর ব্যস্ততম প্রবেশপথ কর্ণফুলী সেতু এবং দেশের অন্যতম বাণিজ্যিক কেন্দ্র চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ ও আছদগঞ্জসহ আশপাশের পুরো এলাকায় অচলাবস্থা নেমে আসে। সপ্তাহের শেষ কর্মদিবসে কর্মজীবি, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সব শ্রেণির মানুষকে চরম দুর্ভোগের শিকার হতে হয়। শুরুতে থানা পুলিশ ও শিল্প পুলিশের কর্মকর্তারা শ্রমিকদের বুঝিয়ে রাস্তা থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। তবে শ্রমিকেরা তাদের পাওনা ছাড়া ঘরে ফিরে যাবে না বলে জানিয়ে দেন।

তারা অভিযোগ করেন আগের দিনও তাদের বলা হয়নি কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হবে। তাদের পাঁচ মাসের বেতন ভাতাসহ আনুসঙ্গিক পাওনা রয়েছে বলেও জানান শ্রমিকেরা। তবে কারখানার মালিক জসিম উদ্দিনসহ কোন কর্মকর্তাকে সেখানে দেখা যায়নি। মালিক পক্ষের বরাত দিয়ে শিল্পাঞ্চল পুলিশের সহকারি পুলিশ সুপার সেলিম নেওয়াজ ইনকিলাবকে বলেন, দীর্ঘদিন কোন অর্ডার না পাওয়ায় কারখানা দুটি লোকসান দিয়ে আসছিলো। কোন কাজ না থাকায় মালিক পক্ষ কারখানা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। মালিক পক্ষের সাথে কথা হয়েছে এবং তারা আগামী ১২ ডিসেম্বরের মধ্যে শ্রমিকদের যাবতীয় পাওনা পরিশোধ করারও আশ^াস দিয়েছেন বলেও জানান তিনি।

এদিকে বাকলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জানান, মালিক পক্ষের আশ্বাসের পরও শ্রমিকরা রাস্তায় অবরোধ অব্যাহত রাখে। বেলা আড়াইটায় তারা চর চাক্তাইয়ের পাশাপাশি রাহাত্তার পুল এলাকায়ও সড়ক অবরোধ করে। এতে পুরো এলাকায় অচলাবস্থা নেমে আসে। তাই বাধ্য হয়ে পুলিশ তাদের লাঠিচার্জ করে হটিয়ে দিয়েছে। পুলিশের পক্ষ থেকে শ্রমিকদের তাদের পাওনা দিয়ে আগ্রাবাদের শ্রম পরিচালকের অফিসে মালিক পক্ষের সাথে আলোচনায় যাওয়ার ব্যবস্থাও করা হয়।

শ্রমিকেরা অভিযোগ করেছেন, পুলিশ লাঠিচার্জ করেছে, এতে বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। পুলিশের সাথে মালিক পক্ষের কিছু মাস্তানও অলিগলিতে ঢুকে শ্রমিকদের মারধর করে। কয়েকজন শ্রমিককে পুলিশ আটকও করে। তবে কাউকে আটকের কথা অস্বীকার করেন থানার ওসি। পরে শ্রমিকেরা লেবার অফিসে গিয়ে তাদের অভিযোগ দায়ের করেন। শ্রমিকেরা দ্রæত তাদের বকেয়া বেতন ভাতা পরিশোধের দাবি জানান। তারা বলছেন, এমন সময়ে বেকার হয়ে পড়ায় তারা পরিবার পরিজন নিয়ে মহাসঙ্কটে পড়েছেন। বকেয়া পাওনার দাবিতে শ্রমিকেরা কারখানার সামনে বিক্ষোভ অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন। বিগত ২০১২ সালে ডিপস অ্যাপারেলস কারখানা উৎপাদনে যায়। ঢাকায়ও তাদের কারখানা রয়েছে।

 

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ