Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

চট্টগ্রামে বাড়ছে খুন

ভয়ঙ্কর নৃশংসতায় জনমনে উদ্বেগ

রফিকুল ইসলাম সেলিম | প্রকাশের সময় : ৪ নভেম্বর, ২০২২, ১:২২ এএম


খুনের পর বন্ধুর লাশ বস্তায় ভরে চার তলা থেকে ফেলা হয়েছে সড়কের পাশের ঝোপে। ধর্ষণের পর খুন করে সাত বছরের শিশুর লাশ ফেলা হয় নর্দমায়। জমির বিরোধে প্রতিবেশিকে মেরে লাশ গুম করা হয়েছে ডোবায়। ত্রিভুজ প্রেমের জেরে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে কিশোর বন্ধুকে। চট্টগ্রামে একের পর খুনের ঘটনা বাড়ছে। ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে নৃশংসতা। তুচ্ছ ঘটনায় মানুষের জীবন নেওয়া হচ্ছে। তাতে জনমনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছেই।
পুলিশ বলছে, নৈতিক অবক্ষয় এবং সমাজে অস্থিরতা থেকে সহিংসতা বাড়ছে। কিশোর-যুবকেরাও ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। অনেকের জীবনের প্রথম অপরাধ শুরু হচ্ছে খুন-গুম দিয়ে। মানুষের মধ্যে মায়া-মমতা উঠে যাচ্ছে। সম্প্রতি চট্টগ্রাম মহানগরী ও জেলায় সংগঠিত বেশ কয়েকটি চাঞ্চল্যকর খুনের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় খুনিরা ধরাও পড়েছে। তারা নির্বিকারে খুনের দায়ও স্বীকার করছেন। খুন-গুম করে তারা অবলিলায় তা আদালতের কাছে স্বীকার করছেন। ভয়ানক নিষ্ঠুরতায় মেতে উঠার পরও অনুশোচনার লেশ মাত্রও নেই এসব স্বঘোষিত খুনিদের মনে।
মহানগরীর বাকলিয়ায় ৩১ অক্টোবর সন্ধ্যায় খুন হন কিশোর রাকিবুল ইসলাম। এই ঘটনায় জড়িত গোলাম কাদের হৃদয় ও মো. সাকিবকে বুধবার গ্রেফতার করে পুলিশ। পুলিশ জানায়, হৃদয়, সাকিব ও রাকিবুলসহ সাত থেকে আটজনের একটি কিশোর গ্যাং রয়েছে। এর মধ্যে রাকিবুলকে হত্যায় জড়িত হৃদয় ও সাকিবসহ পাঁচজন। এই কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা বিভিন্ন ধরনের ভিডিও করে তাদের টিকটক ও ফেসবুক গ্রæপে প্রচার করত। ফেসবুক-টিকটকের মাধ্যমেই রাকিবুলের সঙ্গে এলাকার এক কিশোরীর প্রেমের সম্পর্ক হয়। তবে স¤প্রতি ওই কিশোরী রাকিবুলের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে সাকিবের সঙ্গে ফেসবুকের মাধ্যমে সম্পর্ক গড়ে তোলে। কিন্তু রাকিবুল বারবার ফেসবুকের মেসেঞ্জারে মেয়েটির সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করতে থাকে। বিষয়টি সাদ্দাম জানার পর কিশোর গ্যাংয়ের ফেসবুক মেসেঞ্জার গ্রæপে ৫-৭ দিন ধরে তাদের মধ্যে ঝগড়া চলছিল।
সাদ্দাম-হৃদয়সহ পাঁচজন মিলে রাকিবুলকে খুনের পরিকল্পনা করে। সে অনুযায়ী তাকে ডেকে নেয়া হয় বাকলিয়ার বলিরহাট এলাকায়। সাদ্দাম তাকে পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে ঝগড়ার সূত্রপাত ঘটায়। ঝগড়ায় সাদ্দামের পক্ষে আরও চারজন যোগ দেয়। একপর্যায়ে হৃদয় কাঠ দিয়ে রাকিবুলের মাথায় আঘাত করে। সাদ্দাম পিঠে ও পেটে ছুরিকাঘাত করে। এভাবে রাকিবুলের মৃত্যু নিশ্চিত করে তারা। পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর খুনের দায় স্বীকার করে তার বর্ণনাও দেয় ওই দুই কিশোর। পুলিশ বলছে, এরা এলাকায় বখাটে হিসাবে পরিচিত হলেও বড় কোন অপরাধের রের্কড নেই। কিন্তু তুচ্ছ কারণে বন্ধুকে খুনে তারা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠে।
জেলার চন্দনাইশ উপজেলায় ড্রাম ট্রাক চালক আরিফুল ইসলামের খুনিরাও ছিল ভয়ঙ্কর। এই ঘটনায় পুলিশ মো. আজিজ নামে একজনকে গ্রেফতার করেছে। আজিজও খুনের দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে। সে জানিয়েছে, পরিকল্পিতভাবে সহকর্মী ও বন্ধু আরিফুলকে হত্যার পর লাশ বস্তায় ভরে চার তলার ছাদ থেকে রাস্তায় ছুড়ে ফেলা হয়। সেখান থেকে মঙ্গলবার অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই রাতেই কক্সবাজার থেকে পাকড়াও করা হয় আজিজকে। মো. আজিজ কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার খুটাখালী গ্রামের নুরুল আবছারের ছেলে। তবে চন্দনাইশ উপজেলা উত্তর হাশিমপুর এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকত সে। খুনের শিকার আরিফুল ইসলামের বাড়ি চন্দনাইশ উপজেলার পূর্ব ছৈয়দাবাদের উত্তর হাশিমপুর এলাকায়।
পুলিশ জানায়, আরিফুল ও আজিজ পেশায় ডাম্পার ট্রাক চালক। তারা ইটভাটার ইট পরিবহন করত। একই ট্রাকে কখনও আজিজ চালক, আরিফুল সহকারী, আবার কখনও আরিফুল চালক, আজিজ সহকারী হিসেবে কাজ করত। বছরখানেক আগে তারা অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে একটি ডাম্পার ট্রাক কিনে। আজিজ চালানোর সময় সেই ট্রাক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। তখন সিদ্ধান্ত হয় আজিজ ৫০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দেবে। কিন্তু একবছরেও সেই টাকা পরিশোধ না করায় দু’জনের মধ্যে দ্ব›েদ্বর সৃষ্টি হয়। তবে তা কখনো প্রকাশ্যে আসেনি। তাদের সম্পর্ক আগের মতোই চলছিল। এর মধ্যে আরিফকে শেষ করে দেয়ার পরিকল্পনা করে আজিজ। টাকা দেয়ার কথা বলে ২৯ অক্টোবর আরিফুলকে ডেকে বাসায় নেয় আজিজ। এরপর আজিজ, জোহা ও শুক্কুর মিলে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে তাকে। পরে তার পা প্লাস্টিকের রশি দিয়ে বেঁধে লাশ বস্তাবন্দি করে বাসার চারতলার ওপর থেকে ডোবায় ফেলে দেয়।
নগরীর জামালখানে সাত বছরের এক কন্যা শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করে বস্তাভর্তি লাশ ফেলে দেয়া হয় নালায়। একশ’ টাকা দেয়ার লোভ দেখিয়ে মুদি দোকানের কর্মচারী লক্ষণ দাশ শিশু মারজান হক বর্ষাকে গুদামে নিয়ে উপর্যপুরি ধর্ষণ করে। ধর্ষণে রক্তাক্ত বর্ষাকে খুন করে লাশ বস্তায় ভরে ফেলে দেয়া হয় নালায়। বাসা থেকে ১০ টাকা নিয়ে গলির মুখে পরিচিত ওই দোকানে গত ২৪ অক্টোবর চিপস কিনতে যায় বর্ষা। এরপর থেকে নিখোঁজ ছিল সে। বর্ষাকে খুঁজতে গিয়ে ওই মুদি দোকানে যান তার মা।
দোকান কর্মচারী লক্ষণ দাশকে জিজ্ঞেস করেন তার কথা। লক্ষণ দাশ নির্বিকার ছিলেন। তাদের পরামর্শ দিলেন থানায় গিয়ে নিখোঁজ ডায়েরী করতে। তিনদিন পর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এরপর সিসিটিভি ফুটেজ এবং টিসিবির বস্তার সূত্র ধরে পাকড়াও করা হয় লক্ষণ দাশকে। গ্রেফতারের পর অকপটে বর্ষাকে ধর্ষণ ও খুনের দায় স্বীকার করে লক্ষণ। পুলিশ জানায়, মুদি দোকানের ওই কর্মচারীর অতীতে কোন অপরাধের রেকর্ড নেই। কিন্তু অপরাধী না হয়েও পরিচিত নিষ্পাপ একটি শিশুকে পাশবিক নির্যাতনের পর নিষ্ঠুরভাবে খুন করে ঠাÐা মাথায় লাশ গুম করে সে। এত ভয়ঙ্কর অপরাধের পরও সে পালিয়ে যায়নি। তার এমন পাশবিক কাÐে হতবাক হত খোদ পুলিশ কর্মকর্তারাও।
সম্প্রতি বোয়ালখালীতে সম্পত্তির বিরোধের জেরে এক কবিয়ালকে মেরে লাশ ডোবায় ফেলে দেয়া হয়। তিনদিন পর লাশ উদ্ধার হয় গ্রেফতার হন খুনি। নগরীর ইপিজেড এলাকায় পরকীয়া প্রেমিকের সাথে মিলে নিজ সন্তানকে খুন করেন এক মা। এসব ভয়ঙ্কর খুনের ঘটনায় ধরা পড়ার পর দায় স্বীকার করছেন খুনিরা। খুনের পর তাদের মধ্যে অনুশোচনার কোন চাপও দেখা যায়নি। এমন ঘটনাকে নজিরবিহীন বলছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা।

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ