পোশাক রপ্তানিতে উৎসে কর ০.৫ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব
আগামী পাঁচ বছরের জন্য তৈরি পোশাক রপ্তানির বিপরীতে প্রযোজ্য উৎসে করহার ১ শতাংশ থেকে হ্রাস করে ০.৫ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব করেছে পোশাক খাতের দুই সংগঠন
অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবেলায় তামাকজাত পণ্যে শুল্ক বাড়ানোর পাশাপাশি প্রান্তিক করদাতার উপর করের হার বৃদ্ধি ও রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য শুল্কের হার কমানো হবে কিনা জানতে চেয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। তবে বিদ্যমান অর্থনৈতিক সঙ্কট, মুদ্রাস্ফীতি ও জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় করের বোঝা না বাড়িয়ে করজাল বাড়ানোর কথা আইএমএফকে জানিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। আজ রোববার সকাল ১০টা থেকে বেলা সাড়ে ১২টা পর্যন্ত রাজস্ব ভবনে বৈঠক করে আএমএফের প্রতিনিধি দল।
রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তারা বলেন, বর্তমান অর্থনৈতিক চাপ এবং মুদ্রাস্ফীতির চাপের মধ্যে প্রান্তিক করদাতাদের করের হার বাড়ানোর সুযোগ নেই, বরং আমরা কর ফাঁকি কমিয়ে জিডিপিতে কর বাড়াতে এবং ফাঁকি কমানোর জন্য কর ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করছি। পরিবেশ যাতে করদাতারা স্বেচ্ছায় কর প্রদান করে। এছাড়া এনবিআরের সম্প্রসারণ নীতি এবং বর্তমান রাজস্ব প্রবৃদ্ধিতে সন্তোষ প্রকাশ করেছে আইএমএফ।
অর্থনৈতিক সঙ্কট কাটাতে আইএমএফের কাছ থেকে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ চেয়েছে বাংলাদেশ। এর অংশ হিসেবে সংস্থাটির একটি দল এখন ঢাকায়। দলটি গত বুধবার থেকে আগামী ৯ নভেম্বর পর্যন্ত সরকারের বিভিন্ন দফতরের সঙ্গে বৈঠক করবে। আইএমএফের এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর প্রধান রাহুল আনন্দ দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
দাতা সংস্থাটি রাজস্ব কর্মকর্তাদের সাথে জিডিপি অনুপাতের কর বৃদ্ধি, কর ও ভ্যাট থেকে অব্যাহতি, তামাকের উপর করের হার বৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে শুল্ক হ্রাস, ডিজিটালাইজেশন, শুল্ক আইন, কর আইনসহ প্রায় ডজনখানেক বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছে।
করের হার না বাড়িয়ে সক্ষমতা বাড়ানোয় জোর দিয়েছে এনবিআর। কর কর্মকর্তারা জানান, আইএমএফের শর্ত না মেনে আমরা দেখিয়েছি কিভাবে আমরা কর নেট এবং রাজস্ব বৃদ্ধি বাড়াচ্ছি। আমরা নিশ্চয়তা দিয়েছি, আমরা সঠিক পথে আছি। কারণ আমরা ২০ শতাংশের বেশি রাজস্ব প্রবৃদ্ধি দেখতে পাচ্ছি যখন অর্থ মন্ত্রণালয় রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ১৯ শতাংশ নির্ধারণ করেছিল।
সূত্র জানায়, এনবিআরের আয়কর নীতি, ভ্যাট নীতি ও বাস্তবায়ন এবং কাস্টম নীতির সঙ্গে আলাদা আলাদা বৈঠক করেন আইএমএফের প্রতিনিধি দলের সদস্যরা। বৈঠকে আয়কর বাড়ানোর বিষয়ে এনবিআরের পরিকল্পনা জানতে চান আইএমএফের কর্মকর্তারা। জবাবে এনবিআর কর্মকর্তারা করহার না বাড়িয়ে কর ফাঁকি বন্ধে জোর দেয়া হয়েছে বলে জানান। এতে আয়কর খাতে সর্বশেষ তিন মাসে রাজস্ব আয়ের প্রবৃদ্ধি ২০ শতাংশের কোটায় রয়েছে বলেও আইএমএফ কর্মকর্তাদের অবহিত করেন এনবিআর কর্মকর্তারা। কর হার না বাড়িয়ে আয়কর আদায় কিভাবে বাড়ানো হবে আইএমএফের এমন প্রশ্নে জবাবে এনবিআরের আয়কর কর্মকর্তারা বলেন, কর জাল বাড়াতে ইতোমধ্যে জোন এক্সপানশনসহ বেশকিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কর ফাঁকি বন্ধ করে সেই সঙ্গে করের আওতা বাড়ালে আয়কর আরো অনেক বাড়বে বলেও আইএমএফ কর্মকর্তাদের জানান এনবিআর কর্মকর্তারা। আর কর অব্যহতি কমানোর বিষয়ে জানতে চাইলে এনবিআর কর্মকর্তারা বলেন, প্রতি বাজেটে বিভিন্ন খাতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে কর ছাড় কমানো হয়েছে। আর নতুন নতুন খাতকে করের আওতায় নিয়ে এসে আয়কর খাতে অব্যাহতি আরো কমানো হবে বলেও জানান এনবিআর কর্মকর্তারা।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, এনবিআরের শুল্ক খাতের সঙ্গেও কাস্টম এবং বন্ডে বিশাল অংকের রাজস্ব অব্যহতি কমানোর বিষয়েও জানতে চান আইএমএফ কর্মকর্তারা। তারা নতুন শুল্ক আইন কবে নাগাদ বাস্তবায়ন হবে এই বিষয়ে জানতে চান আইএমএফ কর্মকর্তারা। এর জবাবে এনবিআর কর্মকর্তারা বলেন, দেশীয় শিল্প বিকাশের স্বার্থে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশেষ করে আমদানিতে শুল্ক ছাড় দেয়া হচ্ছে। এছাড়া শিল্প বিকাশের স্বার্থে বন্ডে ছাড় অব্যাহত রয়েছে। তবে বাস্তবিক দিক বিবেচনায় নিয়ে ধীরে ধীরে এসব খাতে কর অব্যাহতি কমানো হচ্ছে। বিশেষ করে বন্ডের কিছু কিছু বিষয়ে নতুন করে করারোপ করা হচ্ছে। প্রতিবছর বাজেটে ভর্তুকি কমিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। আর কাস্টম আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এনবিআর কর্মকর্তারা বলেন, আমরা ইতোমধ্যে কাস্টম আইন প্রণয়ন করে মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পাঠানো হয়েছে। বর্তমানে এই আইনটি পাশের অপেক্ষায় রয়েছে। কত সময়ের মধ্যে এই আইন পাশ হবে আইএমএফের এমন প্রশ্নের জবাবে এনবিআর কর্মকর্তারা বলেন, জাতীয় সংসদে পাশ হলেই বাস্তবায়নের কাজ শুরু হবে। তবে কবে পাশ হবে তা তারা বলতে পারবেন না বলেও জানান আইএমএফকে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বৈঠকে উপস্থিত এনবিআরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, আইএমএফের সঙ্গে আমাদের ট্র্যাডিশনাল আলোচনা হয়েছে। তারা বিভিন্ন বিষয়ে প্রস্তাব দিয়েছেন। বিশেষ করে বন্ড কাস্টমস এবং ভ্যাটে অব্যাহতি কমানোর বিষয়ে তারা জানতে চেয়েছেন। কাস্টম আইনের বাস্তবায়ন নিয়েও তারা জানতে চেয়েছে। এছাড়া কর অব্যাহতি কমানোর বিষয়ে তারা জানতে চেয়েছে। আমরা প্রতিবছর বাজেটে একটু একটু করে অব্যাহতি কমানোর চেষ্টা করছি। সামনে অব্যহতি আরো কমবে বলেও আইএমএফকে জানিয়েছি আমরা।
সূত্র আরো জানায়, এনবিআরের সঙ্গে বৈঠকে আইএমএফ ভ্যাট অটোমেশনের ক্ষেত্রে জোর দিয়েছে। অটোমেশনের আওতায় ই-ফাইলিং থেকে শুরু করে ডিজিটাল ব্যবস্থাপনার বিষয়েও জানতে চেয়েছেন আইএমএফ কর্মকর্তারা। জবাবে এনবিআর কর্মকর্তারা, এনবিআরের ভ্যাট অটোমেশনের বিষয়টি তুলে ধরেন। সেই সঙ্গে ই-ফাইলিংয়ের কাজ শেষ পর্যায়ে এবং ইএফডির অগ্রগতিও তুলে ধরেন। তামাকের করহার বাড়ানোর বিষয়টিও জানতে চান আইএমএফ কর্মকর্তারা। জবাবে এনবিআর কর্মকর্তারা বর্তমানে দেশে তামাকের সর্বোচ্চ করহারের বিষয়টি আইএমএফকে অবহিত করেন। আর ভ্যাট অব্যহতি কমানোর বিষয়ে এনবিআর কর্মকর্তারা বলেন, ইতোমধ্যে নতুন নতুন কিছু পণ্যে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। বিশেষ করে মোবাইল ফোনে নতুন করে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। যেখানে আগে ভ্যাট ছিল না। আরো কিছু কিছু খাতকে ভ্যাটের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে। সেই সঙ্গে ভ্যাট অব্যাহতি কমানোর বিষয়ে এনবিআর জোর দিচ্ছে বলেও আইএমএফের প্রতিনিধি দলের সদস্যদের অবহিত করেন এনবিআর কর্মকর্তারা।
তামাক জাতীয় পণ্যের উপর কর হার, এবং তামাক কর সংস্কারের বিষয়ে গবেষণার প্রশ্নের উত্তরে এনবিআর কর্মকর্তারা আইএমএফকে বলেছেন, বর্তমানে তামাকজাত পণ্যে ১৫ শতাংশ ভ্যাট এবং ১ শতাংশ সারচার্জ ব্যতীত প্রায় ৪০ শতাংশ থেকে ৬৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বিদ্যমান রয়েছে। তাই তামাকের দামে আর কর বাড়ানোর সুযোগ নেই। আবার শুল্ক বাড়লে চোরাচালানও বাড়তে পারে বলে জানান তারা। তারা বলেন, গত কয়েক মাসে তামাক চোরাচালান বেড়ে যাওয়ায় আমাদের গোয়েন্দা দল চোরাকারবারিদের খুঁজে বের করেছে। এমনকি শুল্কের হার বাড়ানোর পরও রাজস্ব বাড়ে না।
এনবিআর কর্মকর্তারা জানান, চলতি বছরের আগষ্ট পর্যন্ত সিগারেট থেকে ৩৩১২ কোটি, বিড়ি থেকে ১৭৮ কোটি, জর্দা থেকে ৭ কোটি ও গুল থেকে দেড় কোটি টাকার শুল্ক আদায় করেছে। এর মধ্যে গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থ বছরের সিগারেট থেকে ৩ দশমিক ৩ শতাংশ, বিড়িতে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ ও জর্দায় ২৮ দশমিক ৮১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
আইএমএফকে আরো জানানো হয়, ৩ লাখ ৭১ হাজার ব্যবসায় হিসাবের মধ্যে ৭৮ দশমিক ২১ শতাংশ ভ্যাট সার্কেল অফিসে ভ্যাট রিটার্ন জমা দেয়। বৃহৎ করদাতা ইউনিটের অন্তর্ভুক্ত ৯৯ শতাংশ বড় অনলাইনে রিটার্ন জমা দিচ্ছে। ইএফডি রাজস্ব বৃদ্ধি, জবাবদিহিতা বাড়াতে এবং আয় ও শুল্ক দিক মূল্যায়নেও সহায়তা করবে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আইএমএফ ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে তাদের সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাব থাকে। এর মধ্যে অন্যতম হলো ভর্তুকি কমানো। অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়ানোর স্বার্থে যেসব দেশে আইএমএফ ঋণ দেয়, সেসব দেশে ভর্তুকি কমানোর পরামর্শ দিয়ে থাকে। তবে অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ভর্তুকি কমানোর কোনো বিকল্প নেই বলেও মনে করেন অর্থনীতিবিদেরা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।