Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধানে, দামে খুশির ঝর্ণা

| প্রকাশের সময় : ১২ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

সোনা ফলেছে এবার। মাঠে মাঠে পাকা ধান, আর কৃষকের মুখে গান। কিষাণীর ব্যস্ততা নবান্নের আয়োজনে। কৃষকের ঘরে ঘরে খুশির বন্যা, অভাবের নিকশ কালো গর্তগুলো এবার যে সোনার ধানে ভরে যাবে। অনুকূল আবহাওয়া আর সরকারের বিনামূল্যে সার-বীজ সরবরাহে ব্যয় কমেছে আমনের উৎপাদনে। পাশাপাশি বাম্পার ফলন আর ভালো দাম পাওয়ায় কিছু বিলাসিতারও ‘দুঃসাহস’ করতে পারছেন এই চির বঞ্চিত কৃষককূল। সারাদেশের মাঠ থেকে আমাদের প্রতিনিধি মিজানুর রহমান তোতা, রেজাউল করিম রাজু, মহসিন রাজু, আবু হেনা মুক্তি, সৈয়দ শামীম সিরাজী ও আব্দুল বাসির সরদারের পাঠানো তথ্যের ভিত্তিতে রিপোর্ট লিখেছেন তাকী মোহাম্মদ জোবায়ের।

১০ বিঘা জমিতে কাটারিভোগ ধানের আবাদ করেছেন বগুরার নন্দীগ্রামের কৃষক সবুর হোসেন। প্রতি বিঘায় ফলন পেয়েছেন ২০ মণ। মণপ্রতি দাম পেয়েছেন ৯শ’ টাকার ওপরে। তাই খুশি আর ধরে না তার।
হাসতে হাসতে বলেন, “ভাই এবার ফলন অনেক ভালো হয়েছে। দামও পাচ্ছি গতবারের চেয়ে আড়াইশ’ টাকা বেশি। সব ঋণ শোধ করে আগামী দিনগুলো খুব ভালো কাটাতে পারবো।”
গত কয়েক বছর ধান চাষে খুব বেশি লাভ করতে পারেননি কৃষকরা। তবে এবার বিঘাপ্রতি লাভ তুলতে পারছেন ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা।
“এক বিঘা জমিতে ধানের আবাদ করতে খরচ হয় ৫ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৭ হাজার টাকা। এবার যা ফলন আর দাম, তাতে সব খরচ বাদ দিয়েও বিঘাপ্রতি ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা লাভ থাকবে-” বলেন বগুরা সদরের শাখারিয়ার বাসিন্দা আব্দুল বাসেত মন্ডল।
সরকারের কাছ থেকে বেশি দাম পাওয়ায় অটো রাইস মিল মালিকরা বেশি দাম দিয়ে কৃষকের ধান সংগ্রহ করছেন। গতবারের তুলনায় ২ টাকা বাড়িয়ে এবার সরকার ৩৩ টাকা দরে চাল সংগ্রহ করছে। তবে কৃষকের ব্যয় বেড়েছে মাত্র ৫০ পয়সা।
বগুরার মহাস্থান হাটের ধান ব্যবসায়ী মকবুল। তিনি কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনে সরবরাহ করেন রাইস মিলগুলোতে। জানালেন, ব্যাংক ঋণ নিয়ে ধান কল মালিকরা বেশি দামে ধান কিনে মজুদ করছেন। সরকারের বাড়তি দাম দেয়ার পাশাপাশি বাজারেও চালের দাম উঠতি। তাই বেশি দামে ধান কিনছেন তারা।
এবার আবহাওয়ার আনুকূল্য কৃষকের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে- এমনটাই মনে করছেন বগুরা কৃষি অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক হযরত আলী। “আমনের বাম্পার ফলনে আগামী ৬ মাস ধান ও চালের বাজার স্থিতিশীল থাকবে”-বলেন তিনি।
বগুরা অঞ্চলের ধানের হাটগুলোতে ঘুরে দেখা গেছে, গত বছর আমন মৌসুমে স্বর্ণা জাতের ধানের মণপ্রতি দাম ছিল সর্বোচ্চ সাড়ে ৫শ’ টাকা। কিন্তু এবার সেই একই ধান সাড়ে ৭শ’ থেকে ৯শ’ টাকায় কেনা-বেচা হচ্ছে। একইভাবে ‘বিনা-৭’ ও ‘রনজিত’ জাতের ধান বিক্রি হচ্ছে ৭২০ থেকে সাড়ে ৮শ’ টাকায়।
এবারের মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়েছে আমনের আবাদ। সব হিসাব-নিকাশ ভেঙ্গে ১ লাখ ৩৯ হাজার হেক্টর বেশি জমিতে আমন চাষ হয়েছে। এবার আমন দিয়ে ভাগ্যের চাকা ঘুরানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন চাষীরা। বিফল যায়নি জায়নামাজে বসা কিষাণীর ফরিয়াদ আর তপ্ত রোদে কৃষকের ঝরানো ঘাম। এবার আমন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ১ কোটি ৩৫ লাখ মেট্রিক টন থাকলেও উৎপাদন ১ কোটি ৪০ লাখ মে. টন ছাড়িয়ে যাবার আশা করছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। গত মৌসুমে দেশে আমনের উৎপাদন হয়েছিল ১ কোটি ৩১ লাখ ৯০ হাজার মেট্রিক টন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সরেজমিন উইংয়ের তথ্যানুসারে, সারাদেশে এখন পর্যন্ত ৭০ ভাগ জমির আমন ধান কাটা শেষ হয়েছে। এবার জাতভেদে মণপ্রতি আমনের দাম পড়ছে ৭৫০ থেকে ৯শ’ টাকা। গতবার আমনের দাম ছিল গড়ে ৭শ’ টাকা।
এবার হেক্টর প্রতি ধানের উৎপাদন ২.৪৪ থেকে ২.৪৭ মেট্রিক টন হচ্ছে, জানালেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. মোহাম্মদ আবদুল্লাহ।
এবার কৃষক শুধু বাড়তি দাম আর বেশি ফলনই পাননি, অনুকূল আবহাওয়ার জন্য কমেছে উৎপাদন ব্যয়। পাশাপাশি সরকারি উদ্যোগের কারণে সার, বীজ আর কীটনাশক নিয়ে চিন্তা করতে হয়নি তাদের।
রাজশাহী অঞ্চলের কৃষি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এবার আমন আবাদ বেশী হবার পেছনে অনুকূল আবহাওয়া ছাড়াও সরকারের বিনামূল্যে বীজ সার অর্থ ভাল কাজ দিয়েছে। তাছাড়া কৃষি বিভাগের শীর্ষ থেকে মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা ছিলেন তৎপর। যে কোন সমস্যায় কৃষি কর্মীদের সহায়তা পেয়েছেন কৃষক।
মোহনপুরের গোছা গ্রামের কৃষক আইয়ুব আলী জানান, আগে এত ঘন ঘন কৃষি অফিসারদের মাঠে পাওয়া যেত না। সরকার এখন কড়াকড়ি করায় সবসময়ই তাদের মাঠে পাওয়া যাচ্ছে।
তবে বাড়তি ফলনে ও বেশি দামে কৃষকের খুশি নির্বিঘœ নয়। তাদের লাভে ভাগ বসাচ্ছে মধ্যসত্বভোগীরা- এমন অভিযোগ আসেছে অনেক কৃষকের কাছ থেকে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে কৃষকদের সরলতার সুযোগ নিয়ে ফরিয়ারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে কম দামে জোর করে ধান কিনে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
খুলনা অঞ্চলে এখন ইরি, বেতি বালাম, চিনি কালাই, জটাই বালাম, স্বর্ণা ধান কাটা চলছে। গত বছরের তুলনায় এসব জাতের প্রতি মণ ধান ২শ’ থেকে ২৩০ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। খুলনা অঞ্চলের জেলাগুলোতে চিনি কানাই বিক্রি হচ্ছে মণপ্রতি ১৩শ’ থেকে সাড়ে ১৩শ’ টাকায়, বেতি বালাম ৯শ’ টাকায়। গত বছর ভরা মৌসুমে আমন ধান বিক্রি হয় ৭শ’ থেকে সাড়ে ৭শ’ টাকা। এবার গড়ে ৯শ’ থেকে সাড়ে ৯শ’ টাকায় ধান বিক্রি করছে খুলনার কৃষকরা।
ইতোমধ্যে খুলনা অঞ্চলের ৪০ ভাগ ধান কাটা শেষ হয়েছে বলে জানিয়েছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আব্দুল লতিফ।
এই অঞ্চলে বর্তমানে উঁচু জমির ধান কাটা ও মাড়াই চলছে। কয়েকদিন পর নিচু জমির ধান কাটা শুরু হবে, জানিয়েছেন বটিয়াঘাটা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রুবায়েত আরা।
সারাদেশের মধ্যে এবার হেক্টরপ্রতি বেশি ফলন হয়েছে বগুরা অঞ্চলে। দেশে হেক্টরপ্রতি ফলন হয়েছে গড়ে ২ দশমিক ৪৪ থেকে ২ দশমিক ৪৭ মেট্রিক টন। তবে বগুরা কৃষি অঞ্চলে হাইব্রিড, উচ্চ ফলনশীল এবং স্থানীয়-এই তিন ধরনের ধানে গড় ফলন এসেছে ৩ দশমিক ১৪ মেট্রিক টন। বগুরা কৃষি অঞ্চলের কর্মকর্তারা এই তথ্য জানিয়েছেন। ইতোমধ্যে বগুরা অঞ্চলের ৮০ ভাগ আমন কাটা হয়ে গেছে বলে জানিয়েছে কৃষি অফিস।
এবার সুনামগঞ্জের হাওর অঞ্চলে দেশি ও আগাম জাতের আমনের উৎপাদন কম হয়েছে। তবে অন্য জাতগুলোর বাম্পার ফলন হয়েছে বলে জানিয়েছেন সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা মো. মাজেদুল ইসলাম।
“বেশ কয়েক বছর পর সময়মতো বৃষ্টি হওয়ায় এবার আমনের ফলন ভালো হয়েছে”, বলেন তিনি।
অধিকাংশ কৃষক এবার ভালো অঙ্কের লাভ করলেও পোকার আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কিছু কৃষক। সিরাজগঞ্জের কিছু অঞ্চলে মাজড়া পোকার আক্রমণের খবর পাওয়া গেছে।
সিরাজগঞ্জের তাড়াশ’ উপজেলার ইল্লাপাড়া গ্রামের কৃষক ইজরুল ইসলাম জানান, ওই অঞ্চলের অনেকের ধানক্ষেতে মাজড়া পোকার আক্রমণ হয়েছে। এতে অনেক কৃষকই ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন।
তবে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হলেও অধিকাংশ কৃষকের ঘরেই এখন আনন্দের বন্যা। “বাম্পার ফলন ও ভাল দাম পাওয়ায় সবমিলিয়ে এবার কৃষক মহাখুশি”- বলেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক কৃষিবিদ মোঃ হামিদুর রহমান।



 

Show all comments
  • Kamal Pasha ১২ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১১:৪৯ এএম says : 1
    আলহামদুলিল্লাহ।
    Total Reply(0) Reply
  • শান্ত ১২ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০৭ পিএম says : 0
    কৃষকদের এই হাসি ধরে রাখতে হবে।
    Total Reply(0) Reply
  • রিফাত ১২ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১:৪৪ পিএম says : 0
    সবই মহান আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছে।
    Total Reply(0) Reply
  • রিমন ১২ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১:৪৭ পিএম says : 0
    কৃষকদের সরলতার সুযোগ নিয়ে ফরিয়ারা যেখানের কৃষকদের ঠকাচ্ছে, সেখানে প্রশাসনের পদক্ষেপ নেয়া উচিত।
    Total Reply(0) Reply
  • Nahida Sultana ১২ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১:৫০ পিএম says : 0
    amader uchit mohan Allah'r kase basi basi sukriya aday kora
    Total Reply(1) Reply
    • Amir SHAMSI ১২ ডিসেম্বর, ২০১৬, ৭:৪২ পিএম says : 4
      We should be grateful to Allah
  • Rumi ১২ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১:৫১ পিএম says : 0
    Many many thanks to the reporters and The Daily Inqilab.
    Total Reply(0) Reply
  • A AMIR SHAMSI ১২ ডিসেম্বর, ২০১৬, ৭:৪৫ পিএম says : 0
    I entirely agree with your instruction fully
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ধান


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ