পোশাক রপ্তানিতে উৎসে কর ০.৫ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব
আগামী পাঁচ বছরের জন্য তৈরি পোশাক রপ্তানির বিপরীতে প্রযোজ্য উৎসে করহার ১ শতাংশ থেকে হ্রাস করে ০.৫ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব করেছে পোশাক খাতের দুই সংগঠন
গত বছরের জুলাই- আগস্টের তুলনায় এ বছরের জুলাই-আগস্টে বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে ৩০ শতাংশ। যদিও গত বছর বাংলাদেশসহ বিশ্ব বিপর্যস্ত ছিল মহামারি করোনায়। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় তছনছ হয়ে যাওয়া বিশ্ব অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে এটিও কতদিন বজায় থাকবে তা নিয়ে শঙ্কায় অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা।
বাংলাদেশ ব্যাংক সোমবার বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায় চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) ৭৮ কোটি ৫০ লাখ ডলারের সরাসরি বিনিয়োগ এসেছে দেশে। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৩০ শতাংশ বেশি। ২০২১-২২ অর্থবছরের এই দুই মাসে ৬০ কোটি ৪০ লাখ ডলারের এফডিআই পেয়েছিল বাংলাদেশ। জুলাই-আগস্ট সময়ে নিট এফডিআই বেড়েছে আরও বেশি, ৪৫ দশমিক ২০ শতাংশ। এই দুই মাসে ৩৬ কোটি ৩০ লাখ ডলারের নিট এফডিআই এসেছে দেশে। গত বছরের এই সময়ে এসেছিল ২৫ কোটি ডলার। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে সব মিলিয়ে ৪৭০ কোটি ৮০ লাখ (৪ দশমিক ৭১ বিলিয়ন) ডলারের এফডিআই এসেছিল দেশে, যা ছিল আগের বছরের (২০২০-২১) চেয়ে ৩৯ শতাংশ বেশি। নিট এফডিআই বেড়েছিল আরও বেশি, ৬১ শতাংশ। গত অর্থবছরে নিট এফডিআইর পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার। তার আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩৩৮ কোটি ৭০ লাখ ডলারের এফডিআই পেয়েছিল বাংলাদেশ। নিট এফডিআই এসেছিল ১ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার।
দুই বছরের বেশি সময়ের করোনা মহামারির ধাক্কা কাটতে না কাটতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ওলটপালট হয়ে যাওয়া অর্থনীতি নিয়ে যখন নানান হতাশা ও আতঙ্ক দেখা দিয়েছিল, তখন স্বস্তির ইঙ্গিত দিচ্ছিল বিদেশি বিনিয়োগ। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু কর্ণফুলী টানেলসহ কয়েকটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলকে ঘিরে আগামী দিনগুলোতে দেশে বিদেশি বিনিয়োগ আরও বাড়বে বলে আশার কথা শুনিয়েছিলেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা।
‘তবে এই গতি ভালো থাকার কোনো কারণ নেই’ ব্যাখ্যা করে অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, একটি দেশে বিদেশি বিনিয়োগ অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। দেশে বিনিয়োগ না বাড়লে বিদেশি বিনিয়োগ আসে না। সন্তোষজনক রিজার্ভ থাকতে হয়। বিনিয়োগ সহায়ক পরিবেশ ও সরকারের নীতি-সহায়তা প্রয়োজন হয়।
তিনি বলেন, বেশ কিছু দিন ধরে দেশে বিনিয়োগ একই জায়গায় আটকে আছে; জিডিপির ৩১ থেকে ৩২ শতাংশের মধ্যে। ডলারের বাজারে অস্থিরতা চলছেই। এ কথা ঠিক যে, পদ্মা সেতুসহ কয়েকটি বড় প্রকল্প ঘিরে দেশে বিনিয়োগের একটি আবহ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধের ধাক্কায় সব ওলোটপালট হয়ে গেছে। এতদিন রফতানি আয়ে ভালো গতি থাকলেও হঠাৎ করে সেটা কমতে শুরু করেছে। রেমিট্যান্স কমছে। রিজার্ভও বেশ কমে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ৩৬ বিলিয়ন ডলারের হিসাব দিলেও ইডিএফের ৭ বিলিয়নসহ অন্য আরও দুটি প্রকল্পে ১ বিলিয়ন ডলার মিলে ৮ বিলিয়ন ডলার বাদ দিলে তাৎক্ষণিক খরচ করার মতো রিজার্ভ কিন্তু ২৮ বিলিয়ন ডলার।
এ অবস্থায় দেশে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে- এমন আশা সমীচীন নয় বলে মন্তব্য করেন ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে (আইএমএফ) গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করা ড. আহসান মনসুর।
২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩২৩ কোটি ৩০ লাখ (৩ দশমিক ২৩ বিলিয়ন) ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ পেয়েছিল বাংলাদেশ। নিট বিনিয়োগের অঙ্ক ছিল ১২৭ কোটি ১০ লাখ ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রায় ৫ বিলিয়ন (৫০০ কোটি) ডলার বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল দেশে। এর মধ্যে নিট এফডিআইয়ের পরিমাণ ছিল ২৬৩ কোটি ডলার। বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি বিদেশি বিনিয়োগ আসে ওই বছর। এর মধ্যে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করে জাপানের কোম্পানি জাপান টোব্যাকো। আকিজ গ্রæপের তামাক ব্যবসা কেনা বাবদ প্রায় ১৫০ কোটি (১ দশমিক ৫ বিলিয়ন) ডলার বিনিয়োগ করেছিল তারা।
বিভিন্ন খাতে মোট যে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আসে, তা থেকে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান মুনাফার অর্থ দেশে নিয়ে যাওয়ার পর অবশিষ্ট অঙ্ককে নিট এফডিআই বলা হয়। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর থেকেই দেশে বিনিয়োগের আবহ তৈরি হয়। ২৫ জুন বহুল প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতু চালু হয়েছে। এই সেতুকে ঘিরে কয়েক মাস ধরে দেশে বিভিন্ন খাতে নতুন বিনিয়োগ হচ্ছিল। সে কারণেই শিল্প স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধনি যন্ত্রপাতি বা ক্যাপিটাল মেশিনারি, পরিবহন খাতের বাস-ট্রাক তৈরির যন্ত্রপাতিসহ অন্যান্য খাতের সব ধরনের যন্ত্রপাতি-সরঞ্জামের আমদানি বেড়েছে। সব মিলিয়ে দেশে বিনিয়োগের পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, দেশের বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান নিয়ামক বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি বেড়ে ১৪ দশমিক শূন্য সাত শতাংশে উঠেছে, যা গত চার বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। টানা আট মাস ধরে বাড়তে বাড়তে ২০২২ সালের প্রথম মাস জানুয়ারিতে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচকটি ১১ শতাংশ ছাড়িয়ে ১১ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশে উঠেছিল। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় ফেব্রæয়ারিতে এই প্রবৃদ্ধি কমে ১০ দশমিক ৭২ শতাংশে নেমে আসে। মার্চে তা দশমিক ৫৭ শতাংশ বেড়ে ১১ দশমিক ২৯ শতাংশে ওঠে। সর্বশেষ জুন মাসে তা আরও বেড়ে ১৩ শতাংশ ছাড়িয়ে ১৩ দশমিক ৬৬ শতাংশে উঠেছে।
অন্যদিকে গত ২০২১-২২ অর্থবছরের ৮ হাজার ২৪৯ কোটি ৫০ লাখ (৮২ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন) ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। এই অঙ্ক আগের বছরের চেয়ে ৩৬ শতাংশ বেশি। তবে আমদানির লাগাম টেনে ধরতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক নানা পদক্ষেপ নেয়ায় আমদানি খরচ কমতে শুরু করেছে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) সেই প্রবৃদ্ধি ১৬ দশমিক ৩২ শতাংশে নেমে এসেছে। ১৩ মাস পর সেপ্টেম্বরে রফতানি আয়ে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরের চেয়ে এই সেপ্টেম্বরে রফতানি আয় কমেছে ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ। অন্যদিকে সাত মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম রেমিট্যান্স এসেছে এই সেপ্টেম্বর মাসে; ১৫৪ কোটি ডলার। যা গত বছরের সেপ্টেম্বরের চেয়ে ১১ শতাংশ কম।
রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স কমায় রিজার্ভ নেমে এসেছে ৩৬ বিলিয়ন ডলারে। গত মঙ্গলবার দিন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩৬ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশে আমেরিকান বিনিয়োগকারীদের চেম্বার অ্যামচেমের সভাপতি সৈয়দ এরশাদ আহমেদ বলেন, করোনার ধাক্কা সামলে বাংলাদেশের অর্থনীতি বেশ ভালোভাবেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও বেশ ধাক্কা খেয়েছে। এ অবস্থায় দেশে বেশি বিদেশি বিনিয়োগ আসবে- এমনটা প্রত্যাশা করা উচিত হবে না।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে এফডিআইয়ের প্রধান সমস্যা হচ্ছে ব্র্যান্ডিং। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সামনে আমরা এখনও আমাদের ব্র্যান্ডিং যথাযথভাবে তুলে ধরতে পারিনি। এ ছাড়া আমাদের বন্দরের সমস্যা আছে। এত দিনেও আমরা আমাদের বন্দরের অটোমেশন করতে পারিনি। এগুলো ঠিক হলে বাংলাদেশে আরও বেশি বিনিয়োগ আসবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা একা বিনিয়োগ করে খুবই কম। দেশি বিনিয়োগকারীদের হাত ধরে বিদেশি বিনিয়োগ আসে। সে কারণে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে হলে দেশি বিনিয়োগও বাড়াতে হবে।
সৈয়দ এরশাদ আহমেদ বলেন, নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণ বিশ্ব অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। এই সেতু ঘিরে দেশে বিনিয়োগ বাড়বে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অবশ্যই বিদেশি বিনিয়োগও আসবে। তবে, সেটার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। বিশ্ব একটি কঠিন সময় পার করছে। এই সঙ্কট কেটে গেলে, বাংলাদেশে এফডিআই বাড়বে। এই সময়ের মধ্যে আমাদের বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যেসব প্রতিবন্ধকতা আছে, সেগুলো দূর করতে হবে।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) সূত্রে জানা যায়, আগের বছরগুলোর ধারাবাহিকতায় চলতি অর্থবছরে তৈরি পোশাক খাতে কোরিয়া, চীন ও হংকং থেকে উল্লেখযোগ্য বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে। এ ছাড়া বিদ্যুৎ, ব্যাংক, টেলিকমিউনিকেশন খাতেও কিছু বিনিয়োগ এসেছে। গত অর্থবছরে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তারা মোট বিনিয়োগের প্রায় ১৭ শতাংশ বিনিয়োগ করেছে। দ্বিতীয় অবস্থানে সিঙ্গাপুর। তারা মোট বিনিয়োগের ১৬ শতাংশের মতো বিনিয়োগ করেছে। তৃতীয় অবস্থানে নেদারল্যান্ডসের বিনিয়োগ ৮ শতাংশ। এ ছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, চীন, মিশর, যুক্তরাজ্য, হংকং এবং অন্যান্য দেশের বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগ রয়েছে। ২০১৫-১৬ থেকে ২০২১-২২ এই পাঁচ অর্থবছরে দেশে মোট ২৫ দশমিক ১০ বিলিয়ন ডলার এফডিআই এসেছে। এর মধ্যে নিট এফডিআইয়ের পরিমাণ ১৭ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।