Inqilab Logo

রোববার, ১৬ জুন ২০২৪, ০২ আষাঢ় ১৪৩১, ০৯ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার

| প্রকাশের সময় : ৬ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মোহাম্মদ আবু তাহের : মিয়ানমারের রোহিং এলাকায় যারা বসবাস করেন তারাই রোহিঙ্গা নামে পরিচিত। রোহিঙ্গা শব্দের অর্থ নৌকার মানুষ, যারা সমুদ্রে নৌকার সাহায্যে মৎস্য আহরণ করে জীবিকা অর্জন করে দিনাতিপাত করেন। ইতিহাসবিদদের মতে, আরবি শব্দ রহম থেকে রোহিঙ্গা শব্দের উদ্ভব। অষ্টম শতাব্দীতে আরবের বাণিজ্য জাহাজ রামব্রি দ¦ীপের তীরে এক সংঘর্ষের কারণে ভেঙ্গে পড়ে। তখন তারা বাঁচার জন্য আল্লাহর কাছে রহম রহম বলে দয়া প্রার্থনা করে। মহান আল্লাহপাক তাদের বাঁচিয়ে দেন। তখন থেকেই তারা রোহিঙ্গা নামে পরিচিতি পায়। রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গারা ইসলাম ধর্মের অনুসারী। বিভিন্ন তথ্যানুসারে, বহুকাল আগে থেকেই রোহিঙ্গারা বসবাস করছে সে অঞ্চলটিতে। মিয়ানমার ব্রিটিশ শাসনমুক্ত হয়েই রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করার বিভিন্ন প্রক্রিয়া গ্রহণ করতে থাকে। রোহিঙ্গারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছে। বাংলাদেশে প্রায় পাঁচ লাখ, সৌদি আরবে চার লাখ, পাকিস্তানে দুই লাখ এবং থাইল্যান্ডে এক লাখ। ১৯৮২ সালে জেনারেল নে উইনের সামরিক সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার হরণ করে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর নৃশংস রাষ্ট্রীয় নির্যাতন ও নিপীড়ন পৃথিবীর সকল শান্তিপ্রিয় মানুষকে হতবাক করেছে। মানুষ হিসেবে তাদের কোন বেঁচে থাকার অধিকার নেই। নেই তাদের কোন মানবাধিকার। জাতিসংঘই বলেছে, বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর নাম রোহিঙ্গা। অথচ রোহিঙ্গা নির্যাতনের ব্যাপারে জাতিসংঘের ভূমিকা অস্পষ্ট। নির্যাতন-নিপীড়ন বন্ধে জাতিসংঙ্গের কোন কার্যকর উদ্যোগ পৃথিবীর মানুষের কাছে দৃশ্যমান হয়নি। মিয়ানমার স্বীকার করুক বা না করুক রোহিঙ্গারা ঐতিহাসিকভাবেই সে দেশের নাগরিক। বিশ্বের কোথাও যদি শান্তি বিঘিœত হয়, মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার যদি না থাকে তবে সেখানে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, মানুষের বসবাসের অধিকার ফিরিয়ে দেয়াই জাতিসংঘের দায়িত্ব ও কর্তব্য। রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে জাতিসংঘ তার দায়িত্ব কতটুকু পালন করছে তা পৃথিবীর মানুষের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ। গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, ৯ থেকে ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত ৬৯ জন রোহিঙ্গা মুসলমানকে হত্যা করেছে সে দেশের সেনাবাহিনী। নিরীহ রোহিঙ্গাদের উপর তারা হেলিকপ্টার থেকেও গুলি চালিয়েছে। সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের হত্যার পাশাপাশি ধর্ষণ করেছে, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে। নিরপরাধ মানুষকে পাখির মতো গুলি করে মেরেছে সেনাবাহিনীর সদস্যরা। শিশুদের জ্বলন্ত আগুনে ছুড়ে দিয়ে হত্যা করেছে। অনেকের হাত-পা কেটে পঙ্গু করে দিয়েছে। আগে মিয়ানমারের নাম ছিল বার্মা। বার্মা সরকারের নির্যাতনের কারণে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা দেশ ত্যাগে বাধ্য হয়েছে। বাংলাদেশেও অনেক রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছিল। বৌদ্ধ রাখাইনদের টার্গেট হলো নিরস্ত্র রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীকে নির্যাতনের মাধ্যমে নির্মূল করে দেওয়া। দেশ ত্যাগে বাধ্য করা। সেই লক্ষ্যে সরকার, সেনাবাহিনী অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গাদের দেশ থেকে বিতাড়িত করার জন্য গণহত্যা চালাচ্ছে। অং সান সু চি ও তার দল এনএলডি প্রায় দশ লাখ রোহিঙ্গাকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করার প্রক্রিয়ায় সহায়তা করেছে। সেনা সমর্থিত সরকার রোহিঙ্গাদের সাময়িক ভোটাধিকার দিতে চেয়েছিল বৌদ্ধ ভিক্ষুরা এর তীব্র প্রতিবাদ করে। বৌদ্ধ ধর্মের মূল নীতি হলো অহিংস হওয়া। হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে মানবতার জয়গান গাওয়া। গৌতম বুদ্ধ তাঁর অনুসারীদের অহিংস হওয়ার শিক্ষা দিয়ে গেছেন। তিনি সর্বজীবে দয়া ও অহিংসা মন্ত্রের চর্চা করে গেছেন। মিয়ানমারের বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীদের সম্পূর্ণ বিপরীত ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা যায়। এই বৌদ্ধ ভিক্ষুরাই সু চির রাজনৈতিক আন্দোলনের মূল সমর্থক। সু চির ক্ষমতায় আসার ব্যাপারে তারা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি শান্তিতে নোবিল পুরস্কার পেয়েছেন। কিন্তু তিনি মুসলিম রোহিঙ্গাদের নির্যাতনের বিষয়ে কথা বলছেন না। তিনি এখনও নীরব। তার দীর্ঘ নীরবতার কারণ কি শান্তিপ্রিয় বিশ্ববাসী জানতে চায়। তার নোবেল পুরস্কার প্রতাহারের দাবি উঠেছে। পুরস্কার প্রত্যাহারের দাবি ক্রমাগত জোরালো হচ্ছে। লাখ লাখ মানুষ সু চির নোবেল পুরস্কার ফিরিয়ে দেয়ার আবেদনে স্বাক্ষর করেছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে সু চির বিতর্কিত ভূমিকা কাম্য হতে পারে না। আন্তর্জাতিক শান্তি এবং ভ্রাতৃত্ববোধ প্রতিষ্ঠায় যারা কাজ করেন তাদের মধ্য থেকেই নোবেল পুরস্কার পেয়ে থাকেন। সু চির মতো যারা এই পুরস্কার পেয়েছেন তারা আজীবন এই মানবিক মূল্যবোধ রক্ষা করবেন, পৃথিবীর মানুষ স্বাভাবিকভাবেই এটি প্রত্যাশা করবে। অং সান সু চির দীর্ঘ নীরবতা পুরস্কার প্রত্যাহার বা ফিরিয়ে নেয়ার দাবিকে গ্রহণযোগ্য করে তুলছে বলে মনে করি। নিয়ম অনুযায়ী নোবেল পুরস্কার প্রত্যাহার করার সুযোগ নেই। নোবেল কমিটি আজ পর্যন্ত পুরস্কার প্রদানের আগে ও পরে পুরস্কার প্রত্যাহার করে নেয়নি। তবে এটিও ঠিক আগে যারা শান্তিতে নোবেল বিজয়ী হয়েছেন তারা গণহত্যাকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমর্থন করছেন বলে জানা যায়নি। সু চির মতো নীরব থাকেননি। সু চি সব কিছু দেখেশুনেও না দেখার ভান করছেন। যখন একজন নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী তার নিজ দেশে তিনি ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায় শান্তি রক্ষায় ব্যর্থ হন, নির্যাতনের কারণে সংখ্যালঘু দেশ ত্যাগে বাধ্য হয় তখন শান্তি রক্ষার স¦ার্থেই নোবেল শান্তি কমিটির উচিত শান্তি পুরস্কার জব্দ করা অথবা শান্তির স্বার্থেই নতুনভাবে চিন্তা করা। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, মিয়ানমারের ব্যাপারে বিশ্ব নেতারা নিশ্চুপ, মুসলিম বিশ্ব নিশ্চুপ এবং ওআইসির কোন কার্যকর উদ্যোগ নেই। রোহিঙ্গা নির্যাতন বন্ধে জাতিসংঘের কার্যকর উদ্যোগ নেই। সকল ধর্মই বলে, মানুষ হত্যা মহাপাপ। অথচ মিয়ানমারের বৌদ্ধ নেতারা নীরব। তারা গৌতম বুদ্ধের অহিংস বাণীগুলো অনুসরণ করেন না, ধারণ করেন না। সকল ধর্মের শিক্ষাই হলো বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব ও মানবতা। ধর্মের দৃষ্টিতে সব মানুষ পরস্পরের ভাই। কারণ তারা একই আদম সন্তান। কোন ধর্মেই হিংসা-বিদ্বেষ হঠকারিতা নেই। মহানবী (স.) বলেছেন, তোমরা পরস্পরের মধ্যে দয়ামায়া এবং সহমর্মিতায় একটি দেহের মতো, দেহের একটি অংশে ব্যথা হলে সর্বাংশে তা অনুভূত হয়। শেখ শাদী (র:) বলেন আদম সন্তান একই অঙ্গের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গ যেহেতু সে একই বস্তু হতে সৃষ্ঠ, অঙ্গের কোনো অংশ যদি ব্যথা পায়, অন্য অঙ্গগুলো আরাম পায় না, যদি তুমি অন্যের ব্যথায় না হও ব্যথিত, মানব নাম ধারণ করা তোমার হবে অনুচিত। মানবাধিকারের মূল কথা হলো ব্যক্তির মানবসত্তা নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় রোহিঙ্গারা কোন মানব তো নয়ই তারা যেন কোন প্রাণীই নয়। কারণ যারা সত্যিকারের মানব সন্তান তারা অন্য প্রাণীর প্রতিও মায়া-মমতা দেখাবে। মানুষ হয়ে অন্য মানুষের বিপদাপদে সহমর্মিতা, সাহায্য-সহযোগিতা না করা মহাপাপ। মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণার ১৩ ধারায় বলা হয়েছে, প্রত্যেক রাষ্ট্রের সীমানার মধ্যে চলাচল ও বসতি স্থাপনের অধিকার প্রত্যেকেরই রয়েছে। ১৪ ধারায় বলা হয়েছে, নির্যাতন এড়ানোর জন্য প্রতোকেরই অপর দেশসমূহে আশ্রয় প্রার্থনা ও ভোগ করার অধিকার রয়েছে। ১৭ ধারায় বলা হয়েছে, কাউকে তার সম্পত্তি থেকে খেয়াল-খুশি মতো বঞ্চিত করা চলবে না। ২২ ধারায় বলা হয়েছে, সমাজের সদস্য হিসেবে প্রত্যেকেরই সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার রয়েছে। প্রত্যেকেই জাতীয় প্রচেষ্টা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে এবং প্রতিটি রাষ্ট্রের সংগঠন ও সম্পদ অনুসারে তার মর্যাদা ও অবাধে ব্যক্তিত্ব বিকাশে অপরিহার্য অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারসমূহ আদায় করার জন্য স্বত্ববান। সদস্য রাষ্ট্রসমূহ যাতে মানুষের মানবাধিকার হরণ না করতে পারে সে জন্য জাতিসংঘ অঙ্গীকারবদ্ধ। মানবাধিকার এর বিষয়টি কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়। আশ্চর্য হলেও সত্য, রোহিঙ্গা মুসলিম নির্যাতনের বিষয়ে মিয়ানমারের নাগরিক সমাজ, মিয়ানমারের মানুষ কথা বলছে না, মিয়ানমারের হাজার হাজার মানুষ নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে এবং অনেকেই অনুপ্রবেশ করছে আবার বিজিবির কড়া নজরদারির কারণে অনেকেরই অনুপ্রবেশের চেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় বিশ্ব বিবেক, বিশ্বের মানবাধিকার সংগঠনগুলো যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। হিউমান রাইটস ওয়াচের মতে, এক হাজারেরও বেশি মুসলমানদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। নিহতের সংখ্যা ৩০০ ছড়িয়ে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে পারে না। জাতিসংঘের মাধ্যমে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। জাতিসংঘকে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে আন্তরিক হতে হবে। বিকল্পধারার প্রেসিডেন্ট ও সাবেক রাষ্ট্রপতি ডা, একে এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের মানবাধিকারে বিষয় বিবেচনায় নিয়ে তাদের আশ্রয় দেয়ার দাবি জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ও বাংলাদেশের মানুষকে অন্য দেশ আশ্রয় দিয়েছিল। বি চৌধুরী রোহিঙ্গাদের মানবাধিকারের কথাই বলেছেন। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য বাংলাদেশ সীমান্ত সাময়িকভাবে উন্মুক্ত করে দিয়ে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর গণহত্যা থেকে তাদের বাঁচাতে হবে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক চাপের মাধ্যমে মিয়ানমার সরকারকে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতেও বাধ্য করতে হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন, বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিক আচরণ দেখানো হবে। বিভিন্ন প্রতিকূলতার পরেও যারা এসে পড়েছে আমরা যতদিন পারি তাদের রাখবো। সুবিধাজনক সময়ে তাদের ফেরত পাঠানো হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই মানবিক ঘোষণায় পৃথিবীর মানবিক মূলোবোধ সম্পন্ন মানুষের কিছুটা হলেও আশ্বস্ত করেছে। রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধান দরকার। এমনিতেই কক্সবাজার জেলায় অসংখ্য রোহিঙ্গা রয়েছে। তাছাড়া এত বেশি শরণার্থীকে স্থায়ীভাবে আশ্রয় দেওয়ার শক্তিও বাংলাদেশের নেই। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে চলাচলের ও বসতি স্থাপনের অধিকার যেমন রয়েছে ঠিক তেমনি রয়েছে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের অধিকার। তাদের এই মানবাধিকার রক্ষায় মিয়ানমারের পার্শ্ববর্তী দেশসমূহ, মুসলিম দেশসমূহ এবং বাংলাদেশের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক : ব্যাংকার ও কলামিস্ট এবং সভাপতি, ব্যাংক অফিসার্স এসোসিয়েশন, মৌলভীবাজার জেলা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন