Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মিয়ানমার সীমান্তে গোলাগুলিতে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত

ভয়ে নাগরিকদের স্বাভাবিক কাজ ব্যাহত

বিশেষ সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ৯:৫৭ পিএম

গত কয়েকদিন বন্ধ থাকার পর মিয়ানমার সীমান্তের নাইক্ষ্যংছড়ি ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারে গোলাগুলি, মর্টারশেল নিক্ষেপ থামেনি। বুধবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত থেমে থেমে ছোড়া হয় আর্টিলারি ও মর্টার শেল। এছাড়াও রেজু সীমান্তের কাছে গতকাল সকালের দিকে হেলিকপ্টার টহল দিতে দেখা গেছে। তবে বেলা বাড়ার পর থেকে আকাশে ফাইটার জেট ও হেলিকপ্টার উড়তে দেখা যায়নি।

গত মঙ্গলবার এবং বুধবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সীমান্তের ওপারে গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে মিয়ানমার রাষ্ট্রদূতকে কড়া ভাষায় প্রতিবাদ জানালে ও কোন কিছুর তোয়াক্কা করেছে না মিয়ানমারের জান্তা সরকার। এতে এপারে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। এই ঘটনায় সীমান্তে বিজিবির টহল জোরদার করা হয়েছে।

বাংলাদেশের কড়া প্রতিবাদের পরও সীমান্ত আইন ও আকাশ সীমা লঙ্ঘন করে চলেছে মিয়ানমার। ২০২২ সালেই মিয়ানমারের পক্ষে প্রথম সীমান্ত আইন ও আকাশ সীমা লঙ্ঘন নয়, ইতিপূর্বে এমন ঘটনা অনিয়মিত ঘটলেও, গত ২০১৫ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রায় প্রতি বছর মিয়ানমার সরকার এমন সীমান্ত আইন ও আকাশ সীমা লঙ্ঘন করে আসছে৷ বাংলাদেশ প্রতিবাদ জানালেও তারা তা কোনভাবেই গায়ে মাখছে না।

মিয়ানমার বাহিনী বাংলাদেশ সীমান্তে মর্টারশেল ছোড়ার এক সপ্তাহের মাথায় ফের যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার থেকে বাংলাদেশ সীমান্তে গোলা ছোড়া হয়েছে।

পুলিশ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সীমান্ত সুরক্ষার দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, গত শনিবার পর্যন্ত টানা ২৩ দিন রাখাইন রাজ্যের স্বাধীনতাকামী বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ) সঙ্গে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে তুমুল লড়াই চলছিল। এ সময় আরকান আর্মির লক্ষ্যবস্তুতে ফাইটার জেট ও হেলিকপ্টার থেকে গুলিবর্ষণ, মর্টার শেল ও বোমা নিক্ষেপ করে আসছিল মিয়ানমারের সরকারি বাহিনী। কিন্তু গত রোববার সকাল থেকে হঠাৎ গোলাগুলি থেমে যায়।

গত মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত তিন দিন সীমান্তের ওপার থেকে গোলাগুলির কোনো শব্দ আসেনি। আকাশেও মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর ফাইটার জেট ও হেলিকপ্টার দেখা যায়নি। গতকাল সকাল থেকে নতুন করে গোলাগুলি শুরু হলেও আজকে সকালে মুর্হু মুর্হু গোলার শব্দে নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত এবং শূন্যরেখার রোহিঙ্গাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। সীমান্তে বসবাসরতরা মনে করেন, এসব ঘটনা ঘটতে থাকলে আবারও রোহিঙ্গার ঢল অনুপ্রবেশের আশঙ্কা রয়েছে।

কিন্তু বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বিজিবির সদস্যরা সীমান্ত টহল জোরদার করায় রোহিঙ্গাদের পক্ষে সহজে অনুপ্রবেশ সম্ভব হয়ে উঠছে না। বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনী (বিজিবি)'র কড়া নজরদারিতে সীমান্ত অতিক্রম করে কোন শরণার্থী বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে পারছে না। সীমান্তে বিজিবির নিয়মিত টহল জোরদার করার কথা জানা যায়। এছাড়া মিয়ানমার বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকায় 'নো ম্যান্স ল্যান্ড' এ প্রায় হাজার চারেক রোহিঙ্গাদের বসবাস। এসব রোহিঙ্গা ও সীমান্তবর্তী বাংলাদেশ অঞ্চলে সাধারণ মানুষের মধ্যে চরম নিয়াপত্তাহীনতা, ভয়, শঙ্কা কাজ করছে বলে জানা যায়।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সালমা ফেরদৌস জানিয়েছেন, সীমান্তে অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। ঘুমধুম ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান একেএম জাহাঙ্গীর আজিজ জানিয়েছেন, প্রায় দু’সপ্তাহ ধরে সীমান্ত এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করছে। ঘুমধুমের তুমব্রু, বাইশফাঁড়ি, ফাত্রাঝিরি, রেজু, আমতলীসহ বিভিন্ন এলাকা এখন থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে।

এদিকে, সেনাবাহিনীর প্রকৌশল ব্যাটালিয়ন ২০ ইসিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল সৈয়দ রিয়াসত আজিম জানিয়েছেন, সীমান্ত উত্তেজনার কারণে গত ১৫ দিন যাবৎ সীমান্ত সড়কের নির্মাণ কাজ বন্ধ রয়েছে। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সড়কটির নির্মাণ কাজ ফের চালু হবে বলে তিনি জানিয়েছেন।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু বরাবর সীমান্তের মিয়ানমার অভ্যন্তরে অজস্র গুলির শব্দ শোনা গেছে বলে জানিয়েছেন সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় বসবাসরতরা।নিরাপত্তার কারণে সীমান্তের সাধারণ মানুষ বিপাকে পড়েছে। সীমান্ত এলাকার পাহাড়গুলো থেকে গাছ, বাঁশ, লাকড়ি সংগ্রহকারী দিনমজুরেরা এখন সেখানে যেতে পারছেনা।

সুত্রে প্রকাশ, ইতিমধ্যে, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ছোড়া দুটি গোলা বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের শূন্যরেখার কাছাকাছি বাংলাদেশ ভূখণ্ডে বিস্ফোরিত হয়েছে। ভূখণ্ডের ১২০ মিটারের ভেতরে পড়ে বিস্ফোরিত হলেও এ ঘটনায় কেউ হতাহত বা আহত হয়নি কেউ। যেখানে গোলা দুটি পড়েছে সেটি জনবসতিহীন এলাকায়। এ ঘটনার ৬ দিন আগেও ২৮শে আগস্ট মর্টারের শেল নাইক্ষ্যংছড়ির উত্তর ঘুমধুমপাড়ার জনবসতিপূর্ণ এলাকায় এসে পড়েছিল। তবে সেটি বিস্ফোরিত হয়নি। পরপর এ ধরনের দুটি ঘটনা ও মিয়ানমারের বিদ্রোহী দল আরাকান আর্মির (এএ) সঙ্গে মিয়ানমার নিরাপত্তাবাহিনীর মধ্যে লড়াই অব্যাহত থাকায় বাংলাদেশ সীমান্তের স্থানীয় বাসিন্দারা আতঙ্কে ও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। সীমান্ত সংলগ্ন পাহাড়ে যারা জুম চাষ করেন তারা চাষে না গিয়ে বাড়িতেই অবস্থান করছেন। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, পরপর এ ধরনের ঘটনায় সীমান্তবর্তী এলাকার বাসিন্দাদের স্বাভাবিক জীবন প্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে। তারা নিরাপত্তা ঝুঁকিতে আছেন। সরকারের পক্ষ থেকে কূটনৈতিকভাবে এটির প্রতিবাদ করার জন্য মিয়ানমার সরকারকে কড়া বার্তা দেয়া দরকার।

এদিকে, ২৮শে আগস্ট তুমব্রু সীমান্তে মিয়ানমার থেকে মর্টারশেল পড়ার ঘটনায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেছিলেন, আমাদের সীমান্তে এসেছে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে। হঠাৎ করে চলে এসেছে। এ নিয়ে আমরা তাদেরকে জিজ্ঞেসও করেছি। তারা বলেছে, আগামীতে যাতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে এজন্য তারা সতর্ক থাকবে। ওই সময় পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, অবিস্ফোরিত মর্টারশেলটি বাংলাদেশের সীমান্তে এসে পড়ার ঘটনাটি দুর্ঘটনা নাকি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, সেটা খতিয়ে দেখা হবে।

এছাড়া তিনি বলেছিলেন, মিয়ানমার রাষ্ট্রদূতকে ডাকা হয়েছে। তাকে একটা মৌখিক নোটের মাধ্যমে কড়া প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। যেন এ ধরনের ঘটনা আর না ঘটে। যে ঘটনা ঘটেছে, সেটার ব্যাপারেও আমরা নিন্দা প্রকাশ করেছি। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) পরিচালক (অপারেশন) লে. কর্নেল ফয়জুর রহমান বলেন, সব সীমান্তেই আমরা সতর্ক থাকি। তবে মিয়ানমার সীমান্তে বেশি সতর্ক থাকি। কারণ আমরা একটা বিষয়ে খুব সোচ্চার এ ঘটনার জের ধরে নতুন করে যেন কেউ বাংলাদেশে প্রবেশ যেন করতে না পারে। গোলা ছোড়ায় সীমান্তবর্তী জনগোষ্ঠীর ঝুকি নিয়ে তিনি বলেন, সাবধানে না চললে ঝুকি থেকেই যায়।

আমরা টহলের পাশাপাশি নিজেরা সতর্ক থাকছি। সীমান্তবর্তী জনগণকেও সতর্ক করেছি বহুবার। তারা সেগুলো মেনে চললে ঝুঁকি থাকবে না। এ ঘটনার প্রেক্ষিতে জুমচাষিরা পাহাড়ে যাচ্ছে না বলে মনে করছিনা। এটি তাদের নিজেদের প্রয়োজনে যাওয়া না যাওয়া নির্ধারণ করে। যে গোলা পড়ছে সেগুলো কতটুকু শক্তিশালী ও ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা কেমন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ নিয়ে আরও তদন্তের বিষয় আছে। আর যুদ্ধে ব্যবহৃত যেকোনো গোলাবারুদই কমবেশি ঝুঁকিপূর্ণ।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ