Inqilab Logo

সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পথিকৃৎ কৃষি গবেষক ড. এস এম ইলিয়াস

| প্রকাশের সময় : ৪ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

সৈয়দ এম. গোলাম হাফিজ : বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ও পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সিন্ডিকেট সদস্য এবং বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতির সাবেক সভাপতি ড. এস এম ইলিয়াস ছিলেন কৃষি অর্থনীতিবিষয়ক গবেষণায় একজন পুরোধা ব্যক্তিত্ব। ১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বগুড়া জেলার জলেশ্বরীতলায় এক সম্ভ্রান্ত রাজনৈতিক মুসলিম পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন বগুড়ার বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য বি এম ইলিয়াস। বাংলাদেশের খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ছিলেন তার বড় ভাই এবং নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক ড. খালীকুজ্জামান ইলিয়াস তার ছোট ভাই।
ড. ইলিয়াস শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৫ বি. এজি (অনার্স) ডিগ্রি এবং ১৯৬৮ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষি অর্থনীতিতে ১ম শ্রেণিতে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি তৎকালীন কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে চাকরি জীবন শুরু করেন। ১৯৭৭ সালে তিনি ভারতের নয়াদিল্লিতে অবস্থিত ‘ইন্ডিয়ান এগ্রিকালচারাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ (আইএআরআই) থেকে ‘এগ্রিকালচারাল ইকোনমিক্সে’ পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টে (বিআইবিএম) ফ্যাকাল্টি মেম্বার হিসেবে যোগ দেন। ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএআরআই) কৃষি অর্থনীতি বিভাগে পিএসও পদে যোগদান করেন এবং প্রথম বাঙালি বিভাগীয় প্রধান নিযুক্ত হন। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের উন্নয়ন, সম্প্রসারণের জন্য তিনি নিরলস পরিশ্রম করে গেছেন। পরবর্তী সময়ে বিএআরআই-তে মহাপরিচালকসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৯ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকার ফার্মগেটে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি-বার্ক)-এর কৃষি অর্থনীতি ও গ্রামীণ সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের সদস্য পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বিএআরসিতে কর্তব্যরত অবস্থায় বাংলাদেশের কৃষি গবেষণা সিস্টেমের বিজ্ঞানীদের জন্য প্রথম RRA (Rapid Rural Appraisal) ট্রেনিং প্রোগ্রামের ন্যাশনাল কো-অর্ডিনেটর হিসেবে কাজ করেন। ১৯৯৮ সালের মে মাসে তিনি বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক নিযুক্ত হন এবং ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অবসরে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। ড. ইলিয়াসের সাথে আমার প্রথম পরিচয় বিএআরসিতে একটি National Conference-এ ১৯৯০ সালের শেষে, তখন আমি শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে চাকরি করি। এর পর সময়ের পরিক্রমায় একসাথে একই বিভাগে তার অধীনে গবেষক হিসেবে কাজ করার সুযোগ আমার হয় এবং খুব কাছ থেকে তাকে দেখার সুযোগ পাই। কৃষি গবেষণার ক্ষেত্রে সর্বদাই বাংলাদেশের কৃষির সমসাময়িক সমস্যা নিয়ে গভীরভাবে ভাবতেন তিনি। সুদীর্ঘ চাকরি জীবনে তিনি বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীতিবিষয়ক গবেষণার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন। তিনি বাংলাদেশ কৃষি, খামার ব্যবস্থাপনার অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ, কৃষি সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার, কৃষি নীতি, কৃষি ঋণ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ফসল-যেমন গম, পাট, ভুট্টা, মরিচ, বিভিন্ন ফল ও সবজি, তেল ফসল, ডাল ফসল, মসলা জাতীয় ফসল উৎপাদন ও বিপণন বিষয় আর্থ-সামাজিক গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা কাজ পরিচালনা করেন। ড. ইলিয়াসের রচিত একশ’র বেশি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ ও প্রতিবেদন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। অত্যন্ত উঁচুমানের গবেষক ছিলেন তিনি। তার তত্ত্বাবধানে ৫ জন ছাত্র কৃষি অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। বাংলাদেশে ডাল জাতীয় ফসলের উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও সমস্যাবিষয়ক তার রচিত একটি আন্তর্জাতিক মানের গবেষণামূলক গ্রন্থ ইন্দোনেশিয়ায় অবস্থিত জাতিসংঘের ESCAP এর CAPSA (Centre for Alleviation of Poverty through Sustainable Agriculture) থেকে প্রকাশিত হয়েছে। তার রচিত বিভিন্ন গ্রন্থ, প্রবন্ধ দেশে ও বিদেশে কৃষি বিষয়ক উচ্চতর ডিগ্রির ছাত্র এবং গবেষকবৃন্দ রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করছে। ব্যক্তিগতভাবে তিনি অত্যন্ত সৎ, ন¤্র, উদার, বিনয়ী ও নিরহংকারী স্বভাবের মানুষ ছিলেন। তিনি অনেক বড় হৃদয়ের মানুষ ছিলেন। এ বিষয়ে একটি উদাহরণ না দিলেই নয়। তিনি বেশ কয়েকটি বৈদেশিক ট্রেনিং এবং কনফারেন্সে নিজে না গিয়ে তার জুনিয়র বিজ্ঞানীদের যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। এ সম্পর্কে আমি এক দিন তাকে জিজ্ঞেস করি, স্যার আপনি নিজে না গিয়ে কেন জুনিয়রদের বিদেশে পাঠালেন যা সচরাচর কেউ করেন না। উনি উত্তর দিলেন “দেখ, আমি তো অনেকবার বিদেশ গিয়েছি, জুনিয়রদের সুযোগ করে দিতে হবে এবং তাদের উন্নয়নের সুযোগ করে দিতে হবে।” উত্তর শুনে শুধু ভাবলাম যে, একজন মানুষ কত বড় মনের হলে এ ধরনের কাজ করতে পারেন। যে কোনো ছোট পর্যায়ের কর্মচারী, শ্রমিক, কর্মকর্তাও যে কোনো প্রয়োজনে যে কোনো সময়ে তার সাথে কথা বলতে পারতেন। বিদেশিদের সাথেও তার বন্ধুত্ব ছিল অকৃত্রিম। আমি একবার ইন্দোনেশিয়ায় গিয়েছি  Poverty reduction  বিষয়ক একটি সেমিনারে যোগ দিতে। সেখানে এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহের নির্বাহী পরিচালক ড. রঘুনাথ গোদাকের সঙ্গে পরিচয় হয়। প্রসঙ্গক্রমে একপর্যায়ে বললাম বাংলাদেশে আমি ড. ইলিয়াসের সাথে কাজ করি। এ কথা শোনামাত্রই তিনি আমার জন্য কী করবেন ব্যতিব্যস্ত হয়ে গেলেন। ড. রঘুনাথ বললেন, “ড. ইলিয়াস খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল যখন আমরা দিল্লিতে পড়ালেখা করেছি।” এরপর যে কদিন ওই সেমিনারে ছিলাম তার আতিথেয়তায় মুগ্ধ হলাম। বাংলাদেশে তার বন্ধু ড. ইলিয়াস সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন ড. গোদাকে।
চাকরি জীবনে পদোন্নতির ক্ষেত্রে অনেক বঞ্চনার শিকারও হন তিনি। আওয়ামী লীগ শাসনামলে তাকে বিএনপির সমর্থক বানিয়ে পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত করা হয় আবার বিএনপির শাসনামলে তাকে আওয়ামী লীগ সমর্থক বানিয়ে পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত করা হয়। কিন্তু এ নিয়ে তার কখনো কোনো মনোবেদনা ছিল না, আর থাকলেও বুঝতে দিতেন না কাউকে। কারও বিরুদ্ধে অনুযোগ, অভিযোগ ছিল না তার। ড. ইলিয়াস সব কিছু মেনে নিতেন হাসিমুখে।
বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতির প্রতিষ্ঠার সাথে তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন এবং এ সমিতির প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়নে তার অবদান অনস্বীকার্য। ২০০৭ সালের ৩০ নভেম্বর বাংলাদেশের বরেণ্য এই কৃষি গবেষক আমাদের শোকের সাগরে ভাসিয়ে চিরবিদায় নেন এবং ১ ডিসেম্বর ২০০৭ ঢাকার বনানী কবরস্থানে তাকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণায় বিশেষ করে কৃষি অর্থনীতি বিষয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে বিনেদিতপ্রাণ গবেষক হিসেবে তার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
লেখক : অধ্যাপক, কৃষি অর্থনীতি অনুষদ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ এবং সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন