Inqilab Logo

শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১, ০১ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

রাজধানীর কড়াইল বস্তি। আধিপত্য বিস্তারে আলামিন খুন

রাজনৈতিক প্রভাবে কমছে না অপরাধীদের দৌরাত্ব

বিশেষ সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ২৩ আগস্ট, ২০২২, ১২:০০ এএম

রাজধানীর অভিজাত এলাকা খ্যাত গুলশান-বনানীর পাশেই অপরাধীদের সবচেয়ে নিরাপদ আস্তানা কড়াইল বস্তি। ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি, অস্ত্র-মাদক কেনাবেচা, নারী-শিশু পাচার ও অসামাজিক কর্মকাণ্ডের নিয়ন্ত্রণহীন সাম্রাজ্য হয়ে উঠেছে এই বস্তি। অস্ত্রধারী রাজনৈতিক ক্যাডারদের নিরাপদ আস্তানাও এই বস্তিটি। অবৈধভাবে বসতি, অবৈধ গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানিসহ সব কিছুই এখানে ব্যবহার হচ্ছে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে। আর এসব কিছুই নিয়ন্ত্রণ করছে সরকারী দলের শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট কড়াইল বস্তির বাসিন্দাদের কাছ থেকে অবৈধ ঘর ভাড়াসহ নানা সেবা দেয়ার নামে মাসে অন্তত ২০ থেকে ২৫কোটি টাকার চাঁদাবাজি করছে বলে আইন-শৃংখলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে।
গত ১৭ আগস্ট বুধবার রাতে কড়াইল বস্তিতে আওয়ামী লীগের কমিটি গঠন নিয়ে দু’পক্ষের সংঘর্ষ হয়। এ সময় আল আমীন নামে একজনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তাকে বাঁচাতে এগিয়ে এলে হামলায় তিন নারীসহ ছয়জন আহত হন।
নিহত আল আমীনের মা হোসপিয়ারা বেগম জানান, আমার ছেলেকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে সন্ত্রাসীরা। রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে পড়ে ছটফট করছিল সে। ওই অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে রিকশায় করে হাসপাতালে নিতে চাইলে রাস্তায় আবারও তার ওপর হামলা করে। আর মসজিদের ভেতরে কোপানো হয় আল আমীনের ভাই জুয়েলকে। আল আমিনের পরিবার সদস্যদের দাবি, শুধু রাজনৈতিক কারণে আল আমিনকে খুন করা হয়েছে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, প্রভাবশালী রাজনৈতিক এক নেতা দীর্ঘদিন ধরেই কড়াইল বস্তির নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন। তার এই আধিপত্য রোধ করতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের একাধিক অংশ মরিয়া হয়ে উঠেছ। আর তাদের মধ্যে আলামিনের ভুমিকাও অন্যতম ছিল। আর ওই নেতা কৌশলে আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের তার প্রতিদন্ধীদের প্রতিরোধের একটি সাইলেন্স গ্রুপের সদস্যদের মাঠে নামায়। ওই কমিটি দলের নতুন কমিটিকে কোণঠাসা করতে আলামিনকে হত্যার পরিকল্পনা করে। আর সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই এই খুনের ঘটনা ঘটানো হয়েছে। কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডেরও চাঁদাবাজির বিরোধ থামছে না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, কড়াইল বস্তিতে গড়ে উঠেছে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী বাহিনী, ভাড়াটে খুনি চক্র। খুন, ছিনতাই, চাঁদাবাজি মাদক ব্যবসাসহ সব ধরনের অপরাধে জড়িত এ বস্তির কয়েকটি চক্র। বছরের পর বছর ধরেই কড়াইল বস্তি সন্ত্রাসীদের অঘোষিত অভয়ারণ্যে পরিণত থাকলেও তাতে বাধ সাধতে পারেনি কেউ।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, আশির দশক থেকেই সন্ত্রাসীদের আস্তানা এবং অন্যতম মাদক স্পট হিসেবে পরিচিত কড়াইল বস্তি উচ্ছেদে সরকারের পক্ষ থেকে বহুবার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। কিন্তু শত চেষ্টার পরও এখন পর্যন্ত বস্তিটি বহাল তবিয়তে আছে। এর দখল নিয়েও বহুবার প্রতিপক্ষ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছে।
জানা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ১৯ নম্বর ওয়ার্ড কড়াইল ১ নম্বর ইউনিট আওয়ামী লীগের কমিটির সদস্য ছিলেন আলামিন। আর ওই কমিটির বিরোধের কারণেই তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে বলে তার পরিবারের সদস্যর দাবি করেছেন। তার স্ত্রী রিতা আক্তার জানান, তার স্বামী একজন নিরীহ ব্যক্তি। দলাদলির কারণেই তাকে হত্যার শিকার হতে হয়েছে। তিনি জড়িতদের গ্রেফতারের দাবি জানান।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বস্তির একাধিক বাসিন্দা ইনকিলাবকে জানান, বস্তিটি ঘিরে প্রতি মাসে ২০ থেকে ২৫ কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে। নানা অজুহাতে চাঁদাবাজি হচ্ছে। রীতিমতো দলিল করে বেচাকেনা হচ্ছে বস্তির ঘরবাড়ি। আর বসানো হচ্ছে গ্যাস-বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগ। এসব সংযোগের বিল থেকে শুরু করে ঘর ভাড়া ও বেচাকেনার নামে সংগৃহীত সকল টাকা কাউন্সিলরসহ প্রভাবশালী খাচ্ছেন। আর কড়াইল বস্তির ঘর বিক্রি করেই শ্রমজীবী থেকে অল্প সময়ের মধ্যেই গুলশানের মতো অভিজাত এলাকার ধনাঢ্য ব্যক্তির তালিকা নাম উঠছে।
বস্তির চাঁদাবাজরি শিকার ব্যক্তিরা বলছেন, দেশের সবচেয়ে বড় বস্তি কড়াইল।নগরীর স্বল্প আয়ের তিন লাখ শ্রমজীবী মানুষ এই বস্তিতে বসবাস করছে। শুধুমাত্র স্ট্যাম্পে বস্তির ঘর বিক্রি করেই কোটিপতি বনে যাচ্ছেন।
আইন-শৃংখলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, প্রতিদিন প্রায় কোটি টাকা চাঁদাবাজি হয় এই বস্তিকে ঘীরৈ। আর এ বিপুল অংকের অর্থের হাতছানিই রাজনৈতিক নেতা ও প্রভাবশালী অনেকের কাছে জায়গাটিকে আকর্ষণীয় করে বস্তিবাসী। তাদের দাবি, ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত অন্তত ৪০ প্রভাবশালী এখানকার ঘর কেনাবেচাসহ যাবতীয় কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। এটা কড়াইল বস্তি নাম হলেও বস্তির মূল দুটি ইউনিট হচ্ছে জামাইবাজার ও বউবাজার নামে। তবে বস্তিকেন্দ্রিক লেনদেনের নিয়ন্ত্রণকারীরা এটিকে ১০টি মহল্লায় ভাগ করা হয়েছে। আর সেই এগুলো হলো কুমিল্লা পট্টি, বেলতলা বস্তি, গোডাউন বস্তি, পশ্চিমপাড়া বস্তি, পূর্বপাড়া বস্তি, উত্তরপাড়া বস্তি, বাইদাপাড়া বস্তি, মোসা বস্তি, বউবাজার ও এরশাদনগর বস্তি। এই বস্তির চাঁদার একটি বড় অংশ যায় স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তাদের পটেকেও।
বস্তির বাসিন্দা শামছুর নাহার জানান, গত ২০০০ সালে বৈবাহিক সূত্রে প্রথম এ বস্তিতে পা রাখেন তিনি। ২০০৪ সালে গার্মেন্টসের হেলপার হিসেবে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। দীর্ঘ ১৪ বছর গার্মেন্টসে কাজ করে এখন চায়ের দোকান করছেন। তার স্বামী রঙের কাজ করত। দুর্ঘটনায় এখন তিনি পঙ্গু হয়ে আছেন। তার চাঁয়ের দোকান থেকে প্রতিদিন চাঁদা দিতে হয়।
অপর এক বাসিন্দা জানান,বস্তিতে গ্যাস বিল, বিদ্যুৎ বিল, ময়লার বিল, পানির বিলের নামে চাঁদা নেয়া হয়। অবৈধ গ্যাস ও বিদ্যুতের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা চাঁদা পান ঘরের মালিকরা। প্রায় বিদ্যুৎ ও গ্যাসের লোকজন এসে লাইন কেটে দেয়। তখন ব্যাপক ভোগান্তি পোহাতে হয় বস্তিবাসীকে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ