Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে সরকারের নানামুখী উদ্যোগ বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত

| প্রকাশের সময় : ৩ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মুহাম্মদ ফারুক খান এমপি : প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রতি রাষ্ট্র তার মানবিক হাত বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, রাষ্ট্র অভিভাবকহীন অটিস্টিক শিশুদের দায়িত্ব নেবে। বাবা-মায়ের অবর্তমানে রাষ্ট্র তাদের লালনপালন করবে। অটিজমসহ সব ধরনের প্রতিবন্ধী শিশুর বেঁচে থাকার এবং তাদের মেধা ও যোগ্যতা প্রকাশের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ফাউন্ডেশন ও ট্রাস্ট গঠনের ঘোষণা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এমনভাবে এগুলো চালু করা হবে যাতে ভবিষ্যতে সরকার পরিবর্তনের পর কেউ সেগুলো বন্ধ করতে না পারে।
বর্তমান সরকারের আমলে সমাজসেবা মন্ত্রণালয়, সমাজসেবা অধিদপ্তর ও জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন প্রতিবন্ধীদের সমাজের মূলধারায় সম্পৃক্ত করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে দেশে কর্মরত উল্লেখযোগ্যসংখ্যক এনজিও প্রতিবন্ধীদের অধিকার রক্ষায় কাজ করছে। প্রতিবন্ধীদের অধিকার সংরক্ষণে সরকারের ধারাবাহিক প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩ পাস করা হয়েছে। নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট আইন ২০১৩ নামে আরেকটি আইন করা হয়েছে।
আইনের আওতায় সব ধরনের প্রতিবন্ধীদের সমাজে সর্বোচ্চ সুযোগ করে দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো নানা পরিকল্পনা ও প্রকল্প হাতে নিয়েছে। দেশে প্রথমবারের মতো প্রতিবন্ধিতা শনাক্তকরণের জন্য পৃথক জরিপ কাজ শুরু করেছে এ সরকার। এর মাঝে সাড়ে ১৮ লাখ বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধী জরিপের আওতায় এলেও ১৪ লাখ প্রকৃত প্রতিবন্ধী শনাক্ত করা গেছে। এখন পর্যন্ত নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব বয়সের প্রতিবন্ধীকে সমান গুরুত্ব দিয়ে সুবিধা নিশ্চিত করা হচ্ছে। তবে মহিলা ও শিশু প্রতিবন্ধীদের প্রতি সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি বরাবরই বেশি। মহিলা ও শিশুসহ সব ধরনের প্রতিবন্ধীদের এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে প্রতিবন্ধী শনাক্ত জরিপসহ সরকারের নানা উদ্যোগ সাধারণের মাঝে ব্যাপক স্বস্তি এনে দিয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে সবচেয়ে বেশি আন্তরিকতা লক্ষ্য করা গেছে। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত আগ্রহ প্রতিবন্ধীদের সুরক্ষিত করছে আগের চেয়ে বেশী। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩-তে অটিজম, শারীরিক প্রতিবন্ধিতা, মানসিক অসুস্থতাজনিত প্রতিবন্ধিতা, দৃষ্টি প্রতিবন্ধিতা, বাক প্রতিবন্ধিতা, বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতা, শ্রবণ প্রতিবন্ধিতা, শ্রবণ-দৃষ্টি প্রতিবন্ধিতা, সেরিব্রাল পালসি, ডাউন সিনড্রোম এবং অন্যান্য প্রতিবন্ধিতাসহ ১২ ধরনের প্রতিবন্ধিতার কথা বলা হয়েছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শারীরিক, মানসিক, বুদ্ধিগত, বিকাশগত, ইন্দ্রিয়গত ক্ষতিগ্রস্ততা এবং প্রতিকূলতার ভিন্নতা বিবেচনায়, প্রতিবন্ধিতার এসব ধরন নির্ধারণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশে অটিজম শিশুদের কল্যাণে ইতিমধ্যে দৃষ্টিগ্রাহ্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দেশের ৬৪ জেলায় এবং ৩৯টি উপজেলায় ১০৩টি প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। এসব কেন্দ্রে অটিজম কর্নার চালু করা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন সেনানিবাসে চালু করা হয়েছে ‘প্রয়াস’ নামের প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়। প্রতিটি সেনানিবাসে এ বিদ্যালয়ের শাখা স্থাপনেরও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রতিবন্ধীরাও অন্য সবার মতো মানুষ। দেশের অন্য সব নাগরিকের মতো তাদের জন্যও সব নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের কর্তব্য। প্রতিবন্ধীদের অসহায় অবস্থার অবসানে বর্তমান সরকারের নানামুখী উদ্যোগ বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হয়েছে। ২০১১ সালের জুলাইয়ে ঢাকায় আয়োজন করা হয়েছিল বড় ধরনের আন্তর্জাতিক সম্মেলন। বাংলাদেশের অটিজমবিষয়ক জাতীয় পরামর্শ কমিটির চেয়ারপারসন বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্রী সায়মা ওয়াজেদ হোসেনের এ সম্পর্কিত মানবিক কার্যক্রম জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহলের প্রশংসা কুড়িয়েছে।
প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য বিদ্যালয়ে ভর্তি ও তাদের জন্য অবকাঠামোগত পরিবেশ নিশ্চিত করতে বর্তমান সরকার ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েছে। প্রতিবন্ধী শিশুরা যাতে সাধারণ ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মিশতে পারে, সে ব্যবস্থা করা হয়েছে। নিবিড় শিক্ষা গ্রহণের জন্য প্রত্যেক প্রতিবন্ধীকে ভাতা দেওয়া হচ্ছে। উপবৃত্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। চালু করা হয়েছে অটিজম কর্নার। প্রতিবন্ধিতা সম্পর্কিত সমন্বিত বিশেষ শিক্ষা নীতিমালা গ্রহণ করা হয়েছে। নীতিমালার আওতায় ৫০টি বিদ্যালয়ে প্রায় ১০ হাজার প্রতিবন্ধী ছাত্র-ছাত্রী পড়াশুনার সুযোগ পাচ্ছে।
প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি, বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিশেষ বা একীভূত শিক্ষা কার্যক্রম, প্রশিক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম, অটিস্টিকদের বিনামূল্যে বিভিন্ন সেবা প্রদান, অটিজম আক্রান্ত শিশুদের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) ইনস্টিটিউট অব নিউরো ডিজঅর্ডার অ্যান্ড অটিজম প্রতিষ্ঠা, প্রতিবন্ধীদের বিনামূল্যে ফিজিওথেরাপিসহ অন্য চিকিৎসা প্রদানের জন্য ৬৪ জেলায় ১০৩ প্রতিবন্ধী সেবা কেন্দ্র স্থাপন, ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টার, তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার করে ঘরে বসে প্রতিবন্ধীদের বিভিন্ন সেবাগ্রহণে সরকারের পদক্ষেপসহ সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা রাখা প্রতিবন্ধীদের জন্য আওয়ামী লীগ সরকারের বড় উপহার।
আমাদের সমাজের অনেকেই আছেন যারা প্রতিবন্ধীদের অবহেলা করেন। তাদের জানা উচিত প্রতিবন্ধীরাও মানুষ। তাদের প্রতি সমাজ ও রাষ্ট্রের যে বিশেষ দায় থাকা উচিত। প্রতিবন্ধীদের অধিকার রক্ষায় কাজ করতে হবে আমাদের সবাইকে। বিশেষ করে যারা প্রতিবন্ধী নয় তাদেরকেও। প্রতিবন্ধীদেরও সমান সুযোগ নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার আছে। প্রতিবন্ধীদের অধিকার নিয়ে কাজ হচ্ছে অনেক। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগামী। কিন্তু তারপরও প্রতিবন্ধীরা সামাজিকভাবে এখনো পুরোপুরি অধিকারপ্রাপ্ত হয়নি। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিই এ জন্য দায়ী।
পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বে প্রায় ১০০ কোটি মানুষ কোনো না কোনোভাবে প্রতিবন্ধী। আর এ ১০০ কোটি জনগোষ্ঠীর আবার বেশিরভাগই আমাদের মতো উন্নয়ন রাষ্ট্রগুলোতে বসবাস করে। তার মানে বিশ্বের প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ প্রতিবন্ধী। তবে এই প্রতিবন্ধীতার বিভিন্ন রকমফের আছে। কোনটি দৃষ্টিগোচর হয় আবার কোনটি অতটা প্রকট নয়। তাই ততটা গুরুত্ব পায় না।
মূলত শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রতিবন্ধীদেরই আমরা বিবেচনা করি। প্রতিবন্ধীরা নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়। তারা শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে অবজ্ঞার সম্মুখীন হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বিদ্যমান সামাজিক অবস্থাই এ বৈষম্য ও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির মূল কারণ।
একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়, প্রতিবন্ধীদের সমস্যাটি যত ব্যাপক, সে অনুযায়ী সমস্যা দূর করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে তাদের গুরুত্ব দেয়া হলেও বেসরকারি চাকরির ক্ষেত্রে তাদের ততটা মূল্যায়ন করা হয় না। ব্যক্তিগতভাবে অনেক মহৎ ব্যক্তি প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখলেও ব্যাপক পরিসরে প্রতিবন্ধীদের সমস্যা দূর করতে সামাজিক উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায় না।
প্রতিবন্ধীরা নিজ পরিবারেই নিগৃহীত হয়। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে যারা অবহেলিত, সেই ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষদের কল্যাণে রাষ্ট্রীয়ভাবে কী উদ্যোগ নেয়া হল- এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একটি সুস্থ ব্যক্তি অসুস্থতা, দুর্ঘটনা বা অন্য যে কোনো কারণে কোনো সুস্থ ব্যক্তিকে যে কোনো সময় প্রতিবন্ধীর বিড়ম্বিত ভাগ্যবরণ করতে হতে পারে।
প্রতিবন্ধীদের ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করে অনেকে ভিক্ষাবৃত্তিসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকা- সংগঠিত করে যা অত্যন্ত দুঃখজনক। এসব সমস্যার সমাধানে সরকারকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। প্রতিবন্ধীদের নামে বরাদ্দ অর্থ ও অন্যান্য সহযোগিতা নিয়ে যেন দুর্নীতি না হয়, সেদিকেও রাখতে হবে কঠোর দৃষ্টি।
লেখক : প্রেসিডিয়াম সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ; সাবেক মন্ত্রী বাণিজ্য, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন