Inqilab Logo

রোববার ০৩ নভেম্বর ২০২৪, ১৮ কার্তিক ১৪৩১, ৩০ রবিউস সানী ১৪৪৬ হিজরি

কারবালার চেতনা

ড. মো. কামরুজ্জামান | প্রকাশের সময় : ৯ আগস্ট, ২০২২, ১২:০৫ এএম

হিজরি বর্ষের প্রথম মাসের নাম মুহররম। ইসলামে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মাস। এর অর্থ অলঙ্ঘনীয় পবিত্র। এ মাসে একদিকে রয়েছে ফজিলত অন্যদিকে রয়েছে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। প্রতিবছরই এ মাসটি মুসলমানদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা নিয়ে আগমন করে। মুসলিমরা এ মাসের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের স্মৃতিচারণ করে এবং একই সঙ্গে পরকালীন পাথেয় অর্জনের চেষ্টা করে। পবিত্র কুরআনে এ মাসকে সম্মানিত মাস হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা জেনে রাখো! এই চারটি মাস বড় ফজিলত ও বরকতপূর্ণ। তোমরা এই মাসগুলোতে পাপাচার করে নিজেদের ওপর জুলুম করো না’ (সূরা তাওবা: ৩৬)। এ আয়াতে চার মাস বলতে মুহররম, রজব, জিলকদ ও জিলহজ্জ মাসকে বুঝানো হয়েছে। এ চার মাসের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হলো মুহররম মাস। পৃথিবীতে এ মাসের দশ তারিখে অনেক ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে। আল্লাহতায়ালা এদিনে আদম (আ.)কে সৃষ্টি করেছেন। এদিনে মুসা (আ.) ও তাঁর অনুসারীরা ফেরাউনের নির্যাতন হতে মুক্তি লাভ করেছিলেন। ইব্রাহিম (আ.) নমরুদের অগ্নিকুণ্ড হতে মুক্তি লাভ করেন এদিনে। এদিনে আইয়ুব (আ.) রোগ মুক্তি লাভ করেন। এদিনে হোসাইন (রা.) কারবালার প্রান্তরে নির্মমভাবে শাহাদাত বরণ করেন। এছড়াও অসংখ্য ঐতিহাসিক ঘটনা এ মাসের সাথে জড়িত আছে। এসব ঘটনার মধ্য হতে দুটি ঘটনা মুসলিম বিশে^ বিশেষভাবে পালিত হয়ে থাকে। প্রথমত মুসা (আ.) এবং তাঁর অনুসারীরা দীর্ঘ অনেক বছর যাবৎ ফেরাউন কর্তৃক নির্যাতিত হয়ে আসছিলেন। একটা সময় আল্লাহতায়ালা মুসা (আ.)কে হিজরতের নির্দেশ দেন। নির্দেশ মতো তিনি তাঁর অনুসারীদের নিয়ে স্বদেশ ছেড়ে মিশরের দিকে যাত্রা শুরু করেন। নীল নদের কিনারে এসে আল্লাহর কাছে নদী পার হওয়ার জন্য সাহায্য কামনা করেন। আল্লাহ তাঁকে হাতের লাঠি দ্বারা পানিতে আঘাত করার নির্দেশ দেন। মুসা (আ.) আল্লাহর নির্দেশে লাঠি দ্বারা পানিতে আঘাত করেন। ফলে নদীর মধ্য দিয়ে রাস্তা তৈরি হয়ে যায়। তিনি সাথীদের নিয়ে নিরাপদে নদী পার হয়ে যান। পেছন থেকে ফেরাউন ও তার বাহিনী এসে নদীর মধ্যে রাস্তা দেখে যাত্রা শুরু করে। কিছু দূর গেলে আল্লাহর নির্দেশে রাস্তা পানিতে বিলীন হয়ে যায়। তখন ফেরাউন ও তার বাহিনী নদীতে ডুবে মারা যায়। দিনটি ছিল ১০ মুহররম। মুসা (আ.)-এর অনুসারীগণ এই দিনটি স্মরণে শুকরিয়া আদায় স্বরূপ রোজা রাখতেন। মহানবী (স.)ও উক্ত দিনে নিজে রোজা রাখতেন এবং সাথীদের রোজা রাখতে নির্দেশ দিতেন। (মুসলিম) দ্বিতীয়ত ১০ মুহররম তারিখে হোসাইন (রা.)-এর শাহাদাতের ঘটনাটি মুসলিম বিশ^ পালন করে থাকে। ইসলামের ইতিহাসে মু’আবিয়া (রা.) ছিলেন একজন বিশিষ্ট সাহাবী। মৃত্যুর পূর্বে নিজ পুত্র ইয়াজিদকে তিনি পরবর্তী খলিফা হিসেবে মনোনয়ন দিয়ে যান। এ মনোনয়নের পরিপ্রেক্ষিতে ইয়াজিদ ৬৮০ সালে ক্ষমতার মসনদে আসিন হন। এ মনোনয়ন ইসলামী নীতির খেলাফ হওয়ায় হোসাইন (রা.) ইয়াজিদের হাতে বায়াত গ্রহণ হতে বিরত থাকেন। তিনি কুফাবাসীর আমন্ত্রণে ৬০ হিজরি শাবান মাসে মদীনা হতে কুফার উদ্দেশ্যে রওনা হন। সাম্রাজ্যে খেলাফতের ধারা বজায় বাখার উদ্দেশ্যে ২০০ সদস্যের একটি ক্ষুদ্র দল নিয়ে তিনি এ যাত্রা শুরু করেন। কিন্তু তিনি ইয়াজিদের প্রেরিত ওবায়দুল্লাহর অধীনস্থ সেনাপতি ওমর ইবনে সা’দ কর্তৃক বাঁধাগ্রস্ত হন। ওমর ইবনে সা’দ নেতৃত্বাধীন ৪,০০০ সৈন্য কর্তৃক অবরুদ্ধ হয়ে তিনি কারবালা প্রান্তরে শিবির স্থাপন করেন। হোসাইন (রা.)-এর শিবিরে পানির কষ্টের তীব্রতা সৃষ্টি হয়। ফলে তিনি শান্তি স্থাপনের উদ্দেশ্যে ওবায়দুল্লাহর নিকট তিনটি প্রস্তাব পেশ করেন: ১. তাঁকে নিরাপদে মদীনায় ফিরে যেতে দেওয়া হোক, ২. সীমান্ত রাজ্য খোরসানে অবস্থান করতে দেওয়া হোক অথবা ৩. ইয়াজিদের সাথে আলোচনার জন্য দামেস্কে যেতে দেওয়া হোক। হোসাইন (রা.) কর্তৃক উত্থাপিত প্রস্তাবগুলো ওবায়দুল্লাহ ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করলো। ওবায়দুল্লাহ তাঁকে ইয়াজিদের অনুকূলে বিনাশর্তে আত্মসমপর্ণের নির্দেশ দিলো। হোসাইন (রা.)-এর শান্তি স্থাপনের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে তিনি যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন। এযুদ্ধে তিনি পরাজিত হন এবং ৬১ হিজরী ১০ মুুহররম কারবালা প্রান্তরে ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে শাহাদাত বরণ করেন। ইয়াজিদ বাহিনী পরতর্বীতে পবিত্র মক্কা ও মদীনা শরীফে নারকীয় আক্রমণ চালায়। তারা পবিত্র কাবা শরীফে অগ্নিসংযোগ এবং হাজরে আসওয়াদকে ক্ষতিগ্রস্থ করে। গোটা মুসলিম দুনিয়া ১০ মুহররমকে তাই শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। কৃতজ্ঞতা আদায় স্বরূপ মুসলিমরা এদিনে রোজা আদায় করে। বিশ^ মুসলিম হোসাইন (রা.) স্মরণে কারবালা দিবস পালন করে। কেউ কেউ এ দিনকে শোক দিবস হিসেবে পালন করে থাকে। আঘাত করে করে শরীরকে রক্তাক্ত করে দেয় ও তাজিয়া মিছিল করে। যুদ্ধের সাজ সাজ পোশাকে ঘোড়া সাজিয়ে, মোটকথা, প্রতি বছর শিয়া-সুন্নি নির্বিশেষে কোটি কোটি মুসলিম হোসাইন (রা.)-এর শাহাদাতের ঘটনায় দুঃখ ও বেদনা প্রকাশ করে থাকে।

ভাববার বিষয়, কোন্ উদ্দেশ্যে হোসাইন (রা.) কোলের শিশুসহ নিজের প্রাণটি উৎসর্গ করলেন? কেনইবা তিনি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত একে একে ৭১ জন শহীদের লাশ কাঁধে বয়ে তাবুতে নিয়ে এলেন? ১২ জন অসহায় শিশু ও নারীকে কেনইবা শত্রুরা একই শেকলে বন্দি করলো? এ দিনের আগমনে আজও কেনো মুসলিমরা ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে? ইসলামের ইতিহাস অধ্যয়ন করলে জানা যায়, এত ত্যাগ কোরবানির মূল কারণ ছিল একটি। আর তাহলো হোসাইন (রা.) কর্তৃক ইয়াজিদের নেতৃত্ব মেনে না নেয়া। কেউ কেউ এটাকে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব বলে আখ্যায়িত করার অপচেষ্টা করেছেন, যদিও এটি সঠিক নয়। কারণ, হোসাইন (রা.)-এর চরিত্র এতটাই উন্নত ছিল যে, কেউই হোসাইন (রা.)-এর ব্যক্তিগত কর্তৃত্ব অর্জনের কথা উল্লেখ করবার নৈতিক সাহস রাখেন না। আর এটা ভাবাও যায় না। কারণ, আবুবকর (রা.) হতে মু’আবিয়া (রা.) পর্যন্ত সুদীর্ঘ ৫০ বছরে ব্যক্তিগত অর্জনের জন্য কোনো প্রকার যুদ্ধ বা রক্তপাত সংঘটিত হয়নি। হোসাইন (রা.) ছিলেন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বের অধিকারী। ক্ষমতার পালা বদলের সময়ে তিনি রাষ্ট্রের গতি, প্রকৃতি, প্রাণশক্তি ও ব্যবস্থার মধ্যে কোনো এক বিরাট পরিবর্তনের পূর্বাভাস লক্ষ করছিলেন। আর সেটা গতিরোধের জন্য সব ধরনের প্রচেষ্টা চালানো তিনি জরুরি মনে করেছিলেন। আর তাই তিনি প্রয়োজনবোধে সশস্ত্র জিহাদে অবতীর্ণ হওয়াকেও আবশ্যকীয় মনে করেছিলেন।
এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো, দেশের জনগণ দ্বীনের মধ্যে কোনো ধরনের পরিবর্তন আনেনি। শাসকবর্গ ও জনগণ-সবাইই আল্লাহ, রাসুল এবং কোরআনকে পূর্বের মতই মেনে চলছিলেন। দেশের শাসন ব্যবস্থায়ও কোনো ধরনের পরিবর্তন হয়নি। এসময় রাষ্ট্রের সমস্ত ব্যাপারই কোরআন মোতাবেক ফয়সালা হচ্ছিল। কিন্তু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে বুঝা যায় যে, ইয়াজিদের সিংহাসনে আরোহণ অর্থই হলো রাষ্ট্রব্যবস্থায় ক্রুটির সূচনা হওয়া। যদিও তখন সেটা পুরোপুরি পরিস্ফুটিত হয়নি। কিন্তু বিচক্ষণ হোসাইন (রা.) এ ত্রুটি লক্ষ করেই নিজের প্রচেষ্টা শতভাগ প্রয়োগ করে জীবন উৎসর্গ করলেন। বিগত ৫০ বছরের রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য ছিল, দেশের মালিক আল্লাহ। আর রাষ্ট্রপ্রধান হলো ঐ দেশের ম্যানেজার। আর জনগণ হলো আল্লাহর আজ্ঞাবহ ঐ ম্যানেজারের প্রজা। আর প্রজা পালনের ব্যাপারে এ ম্যানেজারকে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। রাষ্ট্র জনসাধারণের মালিক নয়, আবার জনসাধারণও রাষ্ট্রের গোলাম নয়। রাষ্ট্রপ্রধান তথা ম্যানেজারের কাজ হলো নিজে আগে আল্লাহর দাসত্ব গলায় ঝুলানো। অতঃপর অধীনস্ত সকল জনগণের গলায় সেটা ঝুলিয়ে দেয়া। কিন্তু মু’আবিয়া (রা.) কর্তৃক ইয়াজিদের ক্ষমতা গ্রহণের মাধ্যমে রাজতন্ত্রের সূচনা হলো। ফলে ঘটনা ঘটলো উল্টা। জনগণের গলায় দাসত্ব শৃংখল ঝুলানো হলেও ম্যানেজার ও তার সংশ্লিষ্ট সাঙ্গ-পাঙ্গরা এ দাসত্বের বাইরেই রয়ে গেল।

বিগত ৫০ বছরে রাষ্ট্রে আল্লাহর পছন্দের সৎপ্রবৃত্তিগুলো প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং অসৎপ্রবৃত্তির সকল পথ রুদ্ধ ও বিলুপ্ত ছিল। কিন্তু মানবসৃষ্ট রাজতন্ত্র চালু হওয়ার ফলে এ ব্যবস্থার উচ্ছেদ হতে শুরু করলো। রাষ্ট্রের আসল উদ্ধেশ্য ব্যাহত হলো। রাজা-বাদশাহগণ শুধুমাত্র রাজ্য জয়ের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। আর এতে মানুষের উপর মানুষের প্রভুত্ব বৃদ্ধি পেলো। বিজিত এলাকায় বিজয়ীরা করারোপ নীতি অবলম্বন করলো। ফলে বিলাসী জীবন যাপন হয়ে পড়লো রাষ্ট্রের একমাত্র উদ্দেশ্য। পূর্বের রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রাণশক্তি ছিল তাকওয়া বা আল্লাহভীতি, যা রাষ্ট্রপ্রধানদের মাধ্যমেই বেশি প্রকাশ পেতো। রাষ্ট্রের সকল কর্মকর্তা, কর্মচারী, মন্ত্রী, আমলা, বিচারপতি ও সেনাপতিগণ এ তাকওয়ার ভিত্তিতেই ছিলেন বিচক্ষণ ও বলিয়ান। রাষ্ট্রের এ উঁচু জায়গা থেকে সাধারণভাবে সমগ্র দেশে এ প্রাণশক্তি বন্যার ন্যায় প্রবাহিত হতো। কিন্তু রাজতন্ত্র কায়েম হবার ফলে রাষ্ট্র ও শাসকসমাজ চরিত্রহীন, উচ্ছৃঙ্খল, অত্যাচারী হয়ে উঠলো। সমগ্র সমাজ সুর-সঙ্গীত, গান-বাজনা আর বিলাসিতার স্রোতে গা ভাসাতে লাগলো। হালাল-হারামের বাছ-বিচার তাদের মধ্য হতে দূরীভূত হলো। রাজনীতির সাথে নৈতিকতার সম্পর্ক ছিন্ন হতে লাগলো। এটা ছিল রাজতন্ত্রের রাষ্ট্রীয় অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন। এর বাইরে রাষ্ট্রের শাসনতন্ত্রের ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হতে লাগলো। কারণ, পূর্বের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় জনগণের স্বাধীন মতামতের ভিত্তিতে নিজেদের মধ্য হতে অপেক্ষাকৃত উৎকৃষ্ট ব্যক্তির কাঁধে দায়িত্ব অর্পণ করা হতো। সেখানে স্বকীয় প্রচেষ্টায় কর্তৃত্ব অর্জনের চিন্তাই করা যেতো না। জনগণের অনুগত্যের ভোট অর্জন ব্যতীত কোনো ব্যক্তি কর্তৃত্বের আসনে সমাসীন হতে পারতো না। আবার একইভাবে জনগণের আস্থা লাভে ব্যর্থ হলে জোর করে ক্ষমতা দখলও করা যেতো না। কিন্তু ইয়াজিদের ক্ষমতারোহনের পর এসব নিয়ম-নীতি সম্পূর্ণভাবে ভেস্তে গেল। ফলে সেই হতে আজ অবধি মুসলমানরা দ্বিতীয়বার নির্বাচনভিত্তিক খেলাফাত ব্যবস্থার দিকে ফিরে যেতে পারেনি।

রাষ্ট্রের শাসনতন্ত্রের আরেকটি দিকেরও ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। পূর্বের রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাষ্ট্র পরিচালিত হতো পরামর্শের ভিত্তিতে। আর পরামর্শ নেয়া হতো নির্ভুল সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর মতো ইন্টেলেকচুয়াল ব্যক্তিদের হতে। যে সকল ব্যক্তি শুধুমাত্র নিঃস্বার্থ মানসিকতা নিয়ে জাতির সেবায় নিয়োজিত থাকতো। রাজতন্ত্র কায়েম হবার ফলে রাষ্ট্রের এ ধারা সম্পূর্ণ পাল্টে গেল। পরামর্শ সভা ‘জি হুজুরে’র দলে ভারি হয়ে গেল। শাহজাদা, প্রাদেশিক গভর্নর, সেনাপতি, স্বার্থপর আর তোষামোদকারীরা ছিল সভাসদের সদস্য, যারা ছিল চাটুকার, স্বার্থপর আর চরম লোভী। যাদের একজনও জনগণের আস্থাভোটে নির্বাচিত হতে পারতো না। পূর্ববর্তী শাসনব্যবস্থায় শুধু সভাসদের সদস্যবৃন্দেরই নয়, বরং রাষ্ট্রের যে কোনো ব্যক্তির বলার ও সমালোচনা করার অধিকার ছিল। যে কোনো ব্যক্তির রাষ্ট্র প্রধানের নিকট কৈফিয়ত তলব করার পূর্ণ ক্ষমতা ছিল। আর এটাকে সকল জনগণ তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব মনে করতো। কিন্তু রাজতন্ত্রের যুগ শুরু হবার পর মানুষের বিবেককে তালাবদ্ধ করা হলো। কণ্ঠকে দাবিয়ে দেয়া হলো। পরিবেশ এমন এক পর্যায়ে উপনীত হলো যে, মুখ খুললেই প্রশংসা করতে হবে নতুবা চুপ থাকতে হবে। আর স্পষ্টবাদিতা যার স্বভাব, তাকে কঠিন যন্ত্রণা বা মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। এমতাবস্থায় সত্য কথা বলার লোক ধীরে ধীরে কমতে শুরু করলো। সমাজে চাটুকারিতা ও তোষামোদকারীতে ভরে গেল। উচ্চতর মুক্তবুদ্ধির ঈমানদারগণ রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলো। আর সাধারণ জনগণ ক্ষমতাসীনদের মসনদে থাকার ব্যাপারে উদাসীনতা প্রদর্শন করতে লাগলো। ক্ষমতার পালা বদল হলেও সেখানে জনগণের কোনো আগ্রহ থাকতো না। তারা শুধু সেটা চেয়ে চেয়ে দেখতো। পূর্বের শাসনব্যবস্থায় দেশের সম্পত্তির মালিক ছিল দেশের জনগণ। অর্থাৎ দেশের সম্পদে রাষ্ট্রপ্রধানের যেমন মালিকানা ছিল ঠিক তেমনি মালিকানা ছিল একজন সাধারণ মানুষের। একজন সাধারণ মানুষ রাষ্ট্রীয় কোষাগারের হিসেব জানতে চাইলে রাষ্ট্রপ্রধান তা দিতে বাধ্য থাকতো। কিন্তু রাজতন্ত্রের আগমন ঘটায় সম্পদ আর জনগণের থাকলো না। সম্পত্তির মালিক হয়ে গেলেন রাষ্ট্রপ্রধান। এ আলোচনা থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, ইয়াজিদের ক্ষমতারোহণের মাধ্যমে খুলাফায়ে রাশেদিনের শাসন ব্যবস্থার অবসান হলো। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা রাজতন্ত্রে রূপান্তরিত হলো। ফলে রাষ্ট্রের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় এসব পরিবর্তন সাধিত হলো। এ পরিবর্তনকে যে কেউ তাচ্ছিল্য ভরে একটা নিছক রাজনৈতিক পরিবর্তন বলতে পারে। কিন্তু হোসাইন (রা.)-এর কাছে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ঘটনাটি ছিল ইসলামী নীতির খেলাফ। আর এ কারণে তিনি ইয়াজিদের নেতৃত্ব মেনে নেন নি। তাই যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে। যুদ্ধের ময়দানে তিনি নারী ও কোলের শিশুসহ শাহাদাত বরণ করেন। এটাই হলো কারবালার মর্মান্তিক ঘটনার প্রকৃত চেতনা।

লেখক: কলামিস্ট ও অধ্যাপক, দাওয়াহ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া



 

Show all comments
  • Md Harun ur Rashid ৯ আগস্ট, ২০২২, ১১:২৯ এএম says : 0
    অসাধারণ লেখনী প্রিয় স্যারের লেখা হাজার হাজার শিক্ষা।
    Total Reply(0) Reply
  • Md Jubayer Hossain ৯ আগস্ট, ২০২২, ৯:৫৭ এএম says : 0
    এই শিক্ষা গুলো আজ আমাদের সমাজে নাই।
    Total Reply(0) Reply
  • জে এম মুহিব্বুল্লাহ মুহিব সিদ্দিকী ৯ আগস্ট, ২০২২, ৯:৫৯ এএম says : 0
    মাশাআল্লাহ, চমৎকারভাবে আশুরা ও কারবালার ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। এ ধরনের ঐতিহাসিক ঘটনা হতে ব্যপক শিক্ষা লাভ করা যাবে। সুতরাং, পরবর্তীতে এ ধরনের আরো ঐতিহাসিক ঘটনা তুলে ধরার অনুরোধ রইল, বিশেষ করে স্পেনে মুসলমানদের পরাজয়ের কারণ কি ছিল এবং সেখান থেকে শিক্ষা সংক্রান্ত বিষয় তুলে ধরার অনুরোধ রইল। আর প্রিয়স্যারের উত্তর উত্তর সফলতা কামনা করি।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন