কারবালার চেতনা
হিজরি বর্ষের প্রথম মাসের নাম মুহররম। ইসলামে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মাস। এর অর্থ অলঙ্ঘনীয় পবিত্র।
ইসলামী চান্দ্র মাস মুহররম। ধর্মপ্রাণ মুসলমানের কাছে গোটা মাসটি হলো, এক শোকাবহ দিনমালা। মুহররমের এ পর্বে মিলন আছে কিন্তু সে মিলন আনন্দের নয়, বিশ্বজাহানের কোটি কোটি শোকাহত মুসলমানের কাছে ১০ মুহররম হলো বুকফাটা কান্না আর হাহাকারের দিন। কাজী নজরুলের ভাষায়-
‘মহররমের চাঁদ এলো এই
কাঁদাতে ফের দুনিয়ায়,
ওয়া হোসেনা, ওয়া হোসেনা তারি
মাতম শুনা যায়।’
বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর কনিষ্ঠ দৌহিত্র ইমাম হোসাইন (রা.) স্বপরিবারে কারবালার মরু প্রান্তরে বিশ্বাসঘাতক এজিদ আর তার দোসর কুফাবাসী জায়েদের চক্রান্তের জালে আটকা পড়ে শোচনীয় ও মর্মান্তিক শাহাদাত বরণ করেন। করুণ এ ঘটনার চৌদ্দশো সাতষট্টি বছর পার হওয়া সত্ত্বেও ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের কাছে দিনটি চিরভাস্বর। তাই মুহররমের ধর্মীয় তথা ঐতিহাসিক গুরুত্ব তাঁদের কাছে অপরিসীম। এ নিষ্ঠুর হৃদয়বিদারী ঘটনায় শোকে মূহ্যমান হতে বাধ্য। নজরুলের ভাষায়,
‘বহিছে সাহারায় শোকেরই লু’হাওয়া
দুলে অসীম আকাশ আকুল রোদনে,
নূহের প্লাবন আসিল ফিরে যেন,
ঘোর অশ্রু শ্রাবণধারা ঝরে সঘনে।
হায় হোসেনা, হায় হোসেনা বলি
কাঁদে গিরি-নদী, মরুস্থলী,
কাঁদে পশুপাখি তরুলতা সনে-
হযরত ওসমান (রা.)’র পর হযরত আলী (রা.) খলিফা পদে অধিষ্ঠিত হলেন। মুসলিম জগতের সর্বোচ্চ সম্মানিত এ পদের জন্য অভিলাসী ছিলেন হযরত মাবিয়া (রা.)। কিন্তু তিনি ছিলেন দামেস্কের শাসনকর্তা। আলী (রা.) খলিফা পদে অধিষ্ঠিত হলে মনে মনে ক্ষুণ্ন হলেও হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর অনুগত মাবিয়া (রা.) নীরবে তা মেনে নিলেন। আলী (রা.)’র মৃত্যুর পর মাবিয়া (রা.) একইভাবে রয়ে গেলেন দামেস্কের খলিফা। আর হযরত আলী (রা.)’র জ্যৈষ্ঠ পুত্র ইমাম হাসান (রা.) লাভ করলেন মদিনার খলিফার পদ। রাজনৈতিক এ পট পরিবর্তনের সময় মদিনার খলিফা পদের দাবিদার মাবিয়া (রা.) আবারও মনঃক্ষুণ্ন হলেন, কিন্তু শেষনবী হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর চির বিশ্বস্ত অনুগামী হিসেবে দামেস্কের শাসনকর্তার পদ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকলেন। কিন্তু এতে বাধ সাধলেন মাবিয়া (রা.)’র অবাধ্য, উচ্ছৃংখল, স্বৈরাচারী ও লম্পট পুত্র এজিদ। এজিদ মদিনার খলিফা ইমাম হাসান ও তার সহোদর ইমাম হোসাইন (রা.)কে হত্যা করে মদিনার খলিফা পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার এক ঘোর চক্রান্ত শুরু করল। গণতন্ত্রের প্রতি চির আস্থাশীল, শান্তিপ্রিয়, প্রজাবৎসল, সমগ্র মদিনাবাসীর চোখের মণি সুশাসক ইমাম ভাতৃদ্বয় ধর্মীয় তথা রাজনৈতিক অস্থির বাতাবরণ থেকে মদিনা ও মদিনাবাসীকে বাঁচাতে, তাদের ভবিষ্যৎ, শান্তি, সমৃদ্ধি, নিরাপত্তা, পারস্পরিক ঐক্য বজায় রাখতে দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিরাট ত্যাগ স্বীকার করতে রাজি হলেন।
তিনি মাবিয়া (রা.)কে খলিফা পদ দিতে রাজী হলেন, তবে শর্ত রাখলেন যে, মাবিয়া (রা.)’র মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র এজিদ খলিফা পদের উত্তরাধিকারী হতে পারবে না। মাবিয়া (রা.) এ শর্ত মেনে নিলেন।
ইমাম হাসান (রা.)’র মৃত্যুর পর মদিনার খলিফার পদে অধিষ্ঠিত হলেন অনুজ ইমাম হোসাইন (রা.)। প্রাসাদ চক্রান্তের শিকার হয়ে যেখানে ইমাম হাসান (রা.) অকালে শহিদ হলেন, সেখানে ইমাম হোসাইন (রা.)’র ভাগ্যে নিশ্চিন্তে খলিফা পদে টিকে থাকা কি সহজসাধ্য? দুর্বিনীত, উন্মাদ, দাম্বিক এজিদ তার চক্রান্তের জাল আরও বিস্তার করল। ফলে চক্রান্তের জাল থেকে মুক্তি পেতে শান্তিপ্রিয় মদিনাবাসীর চোখের মণি, খলিফা ইমাম হোসাইন (রা.)কে তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে এজিদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হতে বাধ্য করল। ইতোমধ্যে দামেস্কের অধিপতি মাবিয়া (রা.)’র মৃত্যু হয়েছে।
পিতা যতদিন জীবিত ছিলেন তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে এজিদের যাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। কিন্তু মাবিয়া (রা.)’র মৃত্যুর পর এজিদকে আর পায় কে? এদিকে আবার মাবিয়া (রা.) মৃত্যুকালে পুত্র এজিদকে খলিফা পদের উত্তরাধিকারী করে গিয়েছেন। ফলে এজিদের সঙ্গে ইমাম হোসাইন (রা.)’র বিরোধ ক্রমে তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠল। এজিদ বারবার মদিনা আক্রমণের চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু শান্তিপ্রিয় হোসাইন (রা.) মদিনার অসংখ্য ভক্তদের নিয়ে এসব আক্রমণ বারবার প্রতিরোধ করতে লাগলেন।
একদিকে এজিদের বারবার মদিনা দখলের ব্যর্থ প্রচেষ্টা। অন্যদিকে, কুফা অধিপতি কপট হোসাইন (রা.) ভক্ত এজিদের চক্রান্তের সঙ্গী জায়েদের কুফা আমন্ত্রণ। অবশেষে বাধ্য হয়ে পরিস্থিতির চাপে পড়ে নিরুপায় হোসাইন (রা.) স্বল্পসংখ্যক নিরস্ত্র অনুচর নিয়ে সপরিবারে কুফা অভিমুখে যাত্রা করলেন। উদ্দেশ্য কুফার অধিপতি জায়েদের আমন্ত্রণ রক্ষা ও তার সহযোগিতায় সেখানকার ধর্মপ্রাণ, শান্তিপ্রিয় মুসলমানদের সমর্থনপুষ্ট হয়ে দুরাচার এজিদের আক্রমণ প্রতিহত করা।
এজিদ আগেই জায়েদের সহযোগিতায় হাজার হাজার সৈন্য নিয়ে কারবালার মরুপ্রান্তরে কুফাগামী ইমাম হোসাইন (রা.)’র যাত্রাপথে বাধার সৃষ্টি করে। কুফার পথে যেতে যেতে সীমাহীন মরুভূমিতে ইমাম হোসাইন (রা.) সদলবলে পথ হারিয়ে ফেললেন। এদিকে, নিরস্ত্র মুষ্টিমেয় অনুচরসহ স্বপরিবারে ইমাম হোসাইন (রা.), অন্যদিকে অস্ত্রবলে সুসজ্জিত হাজার হাজার এজিদ সেনা। স্ত্রী-পুত্র-পরিজন আর গুটি ক’য়েক নিরস্ত্র অনুচর নিয়ে ঐ বিরাট বাহিনীর সঙ্গে মোকাবিলা বা আক্রমণ প্রতিহত করা বাতুলতা মাত্র।
নিষ্ঠুর, নির্দয় এজিদ আগে ফোরাতের তীর সৈন্যদের নিয়ে নিশ্চিদ্র করে রেখেছে, যাতে মরু প্রান্তরে পথহারা ইমাম বাহিনী ফোরাত থেকে একবিন্দু পানি নিয়ে তৃষ্ণা মিটাতে না পারে। সীমাহীন কারবালার পানিহীন বিশাল প্রান্তরে এভাবে হোসাইন (রা.) ও তার সহচরেরা ৯ দিন অতিবাহিত করলেন। অসহনীয় হয়ে উঠল কারবালার দিনের সূর্যতাপ। তৃষ্ণায় সবার কণ্ঠ, তালু, জিহ্বা শুকিয়ে আসতে লাগল। বিশেষ করে, শিশু এবং নারীদের অবস্থা সবচাইতে শোচনীয় হয়ে পড়ল। চোখের সামনে অদূরে কুলুকুলু শব্দে মিষ্টি পানিধারা নিয়ে বয়ে চলেছে ফোরাত, অথচ একবিন্দু পানি পাবার কোনো উপায় নেই। সমস্ত ফোরাতকূল অবরোধ করে রেখেছে নিষ্ঠুর আনন্দে-উল্লাসে মত্ত এজিদ সেনা। পানিবিহীন অবস্থায় মৃত্যুপথযাত্রী দুগ্ধপোষ্য শিশু আলি আসগরকে বুকে নিয়ে নিরূপায় হয়ে স্বয়ং ইমাম হোসাইন (রা.) এজিদ সেনাদের কাছে গিয়ে শিশুটির জন্য এক ফোটা পানি চাইলেন। প্রতিদানে এজিদ সেনার নিক্ষিপ্ত একটি তীর কচি শিশুর বুক এফোড়-ওফোড় করে চলে গেল। রক্তাক্ত শিশু আলি আসগরের নিষ্প্রাণ দেহ মা শাহেরবানুর কোলে ফিরিয়ে দিয়ে ইমাম হোসাইন (রা.) বললেন, ‘এই নাও তোমার পুত্র। তাকে বেহেশতের পানি পান করিয়ে আনলাম।’ পানির জন্য ফোরাতের তীরে ছুটে গেলেন সদ্যবিবাহিত হাসানপুত্র তথা হোসাইন কন্যা সখিনার স্বামী আবুল কাশেম। এজিদ-সেনার তীরের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে অমিত বিক্রমে যুদ্ধ করতে করতে শহিদ হলেন তিনি। ইমাম হোসাইন (রা.) মৃত্যুপথযাত্রী সহচর আর দলের শিশু-মহিলাদের পানিবিহনে কষ্টকর অবর্ণনীয় অবস্থা দেখে স্বয়ং যুদ্ধসাজে সজ্জিত হয়ে একা ফোরাতের কূল মুক্ত করতে এগিয়ে গেলেন। অসংখ্য এজিদ সেনাকে পরাস্থ করে অবশেষে ফোরাতের তীরে পৌঁছে আঁচল ভরে শীতল পানি তুলতে গেলেন। কিন্তু না, আত্মীয়-স্বজন, সহচরেরা যেখানে এক বিন্দু পানির অভাবে তৃষ্ণায় মৃত্যুপথযাত্রী, সেখানে তিনি কী করে একা এ পানি পান করবেন? অথচ, তৃষ্ণায় ইমাম হোসাইন (রা.)’র বুক ফাটে ফাটে। নজরুলের ভাষায়-
ফোরাতের পানিতে নেমে ফাতেমা দুলাল কাঁদে। অঝোর নয়নেরে দু’হাতে তুলিয়া পানি, ফেলিয়া দিলেন অমনি, পড়িল কি মনে।
দুধের তীর খেয়ে বুকে ঘুমাল পিয়েরে,
শাদীর নওশা কাসেম শহীদ এই
পানি বিহনেরে।
এই পানিতে মুছলোরে হাতের
হাতের মেহেদি সখিনারে।
এরপর যা ঘটল, তা ভাষায় অবর্ণনীয়। এক দিকে তৃষ্ণার্ত, ক্ষুধায় কাতর অসহায় একদল মানুষ মরুশয্যায় তিলে তিলে মৃত্যুর পথে এগিয়ে চলেছে। অন্যদিকে এদের এ দুর্দশা দেখে পৈশাচিক আনন্দে উল্লাস প্রকাশ করছে নিষ্ঠুর এজিদ বাহিনী। চোখে-মুখে জয়ের আনন্দ। অবশেষে এল মুহররমের দশ তারিখ। স্বপরিবারে মুর্মূর্ষু হোসাইন (রা.)কে হত্যা করল নির্দয়, পিশাচহৃদয় এজিদ দোসর সীমার। খলিফা পদলাভ করার পথ সে করল কণ্টকমুক্ত।
ধর্মের জন্য এই পৃথিবীতে বহুবার বহু মহাত্মা মৃত্যুবরণ করেছেন। তাদের মধ্যে কেউ যুদ্ধক্ষেত্রে, কেউ কারাগারে, কেউ প্রিয় শিষ্য বা সহচরের বিশ্বাসঘাতকতায় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন। কিন্তু সত্য, ন্যায় ধর্ম ও গণতন্ত্রের মর্যাদা রক্ষায় মহাপ্রাণ ইমাম হোসাইন (রা.)’র এ শাহাদাত বরণ বিশ্বের ইতিহাসে শুধু বিরল নয়, তুলনাবিহীন।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।