Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

এইডস : বাঁচতে হলে জানতে হবে

| প্রকাশের সময় : ১ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আফতাব চৌধুরী : এইডস একটি পরিচিত ব্যাধির নাম। পৃথিবীর কোনও ব্যাধি বোধহয় অল্প সময়ের মধ্যে বিশ্বব্যাপী এত ব্যাপক পরিচিতি লাভ করতে পারেনি। ১৯৮১ সালে আমেরিকার সেন্টার ফর ডিজিস কন্টেত্থাল একটি রিপোর্ট প্রদান করে যে, লসএঞ্জেলেসে কতিপয় সমকামী ব্যক্তি একটি অদ¢ুত রোগে আক্রান্ত। এ ঘটনার পূর্বে এ সংস্থা অন্য একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করে যে, কয়েকজন সমকামী ব্যক্তি নিউইয়র্কে ও লসএঞ্জেলেসেও একটি অদ¢ুত চামড়ার রোগে আক্রান্ত। এ রোগের নাম এইডস এবং এটিই এ রোগের প্রথম আবিষ্কার।
অল্প সময়ের মধ্যে এইডস বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে এবং মহামারীর (Pandemic) আকার ধারণ করেছে। ন্যাশনাল এইডস কন্ট্রোল অর্গানাইজেশনের (NACO)  হিসাব অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী প্রতিদিন ১৬,০০০ নারী-পুরুষ নতুন করে এইচআইভি/এইডস রোগে আক্রান্ত হচ্ছে (সূত্র ন্যাকো রিপোর্ট)। অর্থাৎ প্রতি বছরে ৭ মিলিয়ন নতুন এইচআইভি/ এইডস রোগীর সংখ্যা বাড়ছে যা সিঙ্গাপুর, কুয়েত এবং ব্রুনাইয়ের সম্মিলিত জনসংখ্যার সমান। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO)  হিসাব অনুযায়ী ১৯৮৯ সালের মে মাসে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ১,৫৪,৪০৬৭। ইউএনওর (UNO)  সদ্য প্রকাশিত তথ্য অনুসারে একমাত্র এশিয়ায় ১৯৯৮ সালের মধ্যভাগে ৭.২৮ মিলিয়ন এইডস রোগীর সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল এবং সবচেয়ে শঙ্কার বিষয় যে, এ মরণ রোগ প্রতি বছর ২০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমগ্র বিশ্বে এ পর্যন্ত প্রায় ২২ মিলিয়ন মানুষ এইডস রোগে মারা গেছে এবং প্রায় ৪০ মিলিয়ন মানুষ এইচআইভি/এইডস আক্রান্ত হয়ে জীবনযাপন করছে।
এইডস প্রাদুর্ভাবের মানচিত্রে দক্ষিণ আফ্রিকার পরে ভারতবর্ষের স্থান দ্বিতীয়। সংখ্যাতত্ত্ব অনুযায়ী ২০০১ সালে এইচআইভি/এইডস রোগীর সংখ্যা ছিল ৪ মিলিয়ন। অথচ ১৯৯২ সালের শুরুতে এ সংখ্যা ছিল ২,৫০,০০০। প্রতিদিন আটজন করে নতুন রোগী যুক্ত হচ্ছে। ন্যাকোর রিপোর্ট অনুযায়ী এইচআইভি সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি ভারতের মহারাষ্ট্রে, তামিলনাডুতে এবং ড্রাগ ব্যবহারকারীদের মধ্যে সংক্রমণ বেশি মণিপুরে। সংক্রমণের মধ্যে ৭৪.২ শতাংশ নারী-পুরুষের যৌন সংসর্গে, ৭ শতাংশ রক্তের মাধ্যমে এবং ৭ শতাংশ ড্রাগ ব্যবহারের মাধ্যমে। পুরুষ রোগীর সংখ্যা ৭৮.৭ শতাংশ এবং নারী রোগীর সংখ্যা ২১.৩ শতাংশ। মণিপুরে ৬,৮৭১টি এইচআইভি পজিটিভ কেসের মধ্যে একমাত্র ইম্ফল জেলায় এককভাবে ৩,৫০০ এবং মোট আক্রান্ত রোগীর মধ্যে ৪০০ জন মহিলা। আমেরিকার সেন্টার ফর স্ট্রাটেজিক এবং ইন্টারন্যাশনাল রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৩ সালের মধ্যে ভারতবর্ষে এইডস রোগীর সংখ্যা দাঁড়াবে ২০ মিলিয়ন।
উদার অর্থনীতি এ কালান্তক ব্যাধিকে সমগ্র বিশ্বে, বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে বিশেষভাবে সাহায্য করেছে। নতুন অর্থনীতি (Structural Adjustment Policy) তৃতীয় দুনিয়ার স্বাধীনতাকে খর্ব করছে। এ নীতি অনুযায়ী ঋণ গ্রহীতাকে আইএমএফ (IMF)  এবং ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক (World Bank) থেকে ঋণ নিতে গেলে কতকগুলো শর্ত মানতে হবে। যেমন- বাজেটে ঘাটতি কমাতে হবে, ভর্তুকি কমাতে হবে, সামাজিক উন্নয়নে সার্ভিস চার্জ বসাতে হবে, বিদেশি ব্যবসায়ীদের জন্য দ্বার উš§ুক্ত করতে হবে এবং মূলধন বিনিয়োগ ও চলাচলের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ দূর করতে হবে। ব্যাপক বেসরকারিকরণ এ অর্থনীতির অন্যতম লক্ষ্য।
আমাদের দেশ গ্রাম-প্রধান এবং দেশের ৭৫ শতাংশ মানুষ গ্রামেই বাস করে। এদের অধিকাংশ প্রান্তিক চাষি এবং গরিব। প্রায়শ টাকার অবমূল্যায়ন, বড় পুঁজিপতিদের মূলধন বিনিয়োগে ছাড় এবং রফতানি বৃদ্ধি গ্রামীণ অর্থনীতির ওপর বিরাট আঘাত হেনেছে। মুক্তবাজারে প্রচ- প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হচ্ছে আমাদের দেশের সাধারণ চাষি এবং কুটির শিল্পীরা। জীবিকার অন্বেষণে শত শত নারী-পুরুষ নির্বিশেষে গ্রাম ছেড়ে শহরের দিকে আসছে। একটি ইংরেজি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার খবরের কিছু অংশ উদ্ধৃত করলামÑ ‘নদী ভাঙন এবং জেলায় কৃষিপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারি ব্যর্থতার দরুন গত কয়েক বছর ধরে প্রান্তিক ও ভূমিহীন কৃষকেরা জীবিকার সন্ধানে ভিন জেলায় পাড়ি দিচ্ছেন।’ এ মাইগ্রেশন প্যাটার্ন বিশেষভাবে সাহায্য করছে এইচআইভি ছড়িয়ে দিতে শহর থেকে গ্রামে, গ্রাম থেকে শহরে।
 নতুন অর্থনীতির জোয়ারে বহু কলকারখানা গড়ে উঠছে এবং বহু শ্রমিকের প্রয়োজন হচ্ছে। বহু যুবক নতুন কলকারখানায় কাজের জন্য ভিড় করছে। এদের অধিকাংশ পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে। ফলে অনেকেই কর্মক্লান্ত হয়ে বাণিজ্যিক যৌন কর্মীদের কাছে মনোরঞ্জনের জন্য যায় এবং নতুন করে এইচআইভি-তে আক্রান্ত হয়। আক্রান্ত ব্যক্তিরা যখন ঘরে ফিরে আসে তাদের মাধ্যমে নানাভাবে পরিবারের অন্যান্য নারী-পুরুষ আক্রান্ত হয়।
উদার অর্থনীতির ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত মানুষের যাতায়াত অবাধ। পণ্য চলাচল ব্যাপকভাবে বেড়েছে। কয়েকটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, দুই-তৃতীয়াংশ ট্রাক ড্রাইভার সর্বদাই বাণিজ্যিক যৌন কর্মীদের সঙ্গে মেলামেশা করে। এর ফলে সংক্রমণ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। দেশের বিভিন্ন হাইওয়ের ট্রাক ড্রাইভারদের এক বিরাট অংশ এখন নানা যৌন রোগে আক্রান্ত।
সরকার স্বাস্থ্য ও শিক্ষা এবং সেবামূলক সামাজিক উন্নয়ন ক্ষেত্রে ব্যয় কাটছাঁট করছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নানা রকম ট্যাক্স ও সুবিধা দেওয়ার ফলে সরকারের রাজস^ আয় কমছে। ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের কথামতো চিকিৎসা ক্ষেত্রে সার্ভিস চার্জ বসাতে হচ্ছে এবং স্বাস্থ্য পরিসেবাকে বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের হাতে ছেড়ে দিতে হচ্ছে। এর ফল ভয়াবহ হতে শুরু করেছে। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে এইডস রোগের চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। বাংলাদেশের মতো গরিব দেশের অধিকাংশ মানুষের নাগালের বাইরে। কারণ বাংলাদেশে ‘মাথাপিছু জাতীয় আয় বছরে মাত্র ৪৫০ ডলার, বিশ্ব ক্রমপর্যায়ে যার স্থান ১৬২তম।’
পশ্চিমের উন্নত দেশগুলো তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশের চিকিৎসার খরচের ব্যাপারেÑ যেমন- ভ্যাকসিন, বিভিন্ন পরীক্ষার জন্য কিটস- নানা চাপ সৃষ্টি করছে। তৃতীয় বিশ্বকে ট্রায়াল গ্রাউন্ড হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে। এতে বোঝা যায় তৃতীয় বিশ্বের প্রতি পশ্চিমের উন্নত দেশগুলোর এইডস কন্ট্রোল প্রোগ্রাম কেমন।
পশ্চিমী দুনিয়ার ভোগবাদী জীবন দর্শন আমাদের জীবন ধারণের পদ্ধতিকে পাল্টে দিচ্ছে। ভোগবাদ, গগনচুম্বী আকাক্সক্ষা, দ্রুত অর্থ লাভের নানা পরিকল্পনা আমাদের চিন্তাধারাকে এবং আচরণকে প্রভাবিত করছে। বিভিন্ন টিভি পর্দায় রগরগে যৌনতা ও নানান হিংসার ছবি দেখানো হচ্ছে। বিবাহ-বহির্ভূত এবং একাধিক নারী-পুরুষের সম্পর্ক নিয়ে নানা ছবি তৈরি হচ্ছে। বিজ্ঞাপনের জগতে গাড়ি থেকে সাবান বিক্রির সকল ক্ষেত্রে নারীর দেহ প্রদর্শন সভ্যতার একটি অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর্থ-সামাজিক ও সংস্কৃতির পরিবর্তন বিবাহ বিচ্ছেদ বাড়াচ্ছে এবং নগরায়ণের সংস্কৃতি তৈরি করছে, বাড়ছে সঙ্গী বা সঙ্গিনী।
এইডস নিয়ে করণীয় কার্যবিধির মধ্যে প্রথম এর বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি বিশেষভাবে প্রয়োজন। এ ব্যাপারে সকল শ্রেণীর মিডিয়াকে কাজে লাগানো যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, অবাধ মেলামেশার ব্যাপারে সাবধান হতে হবে। তৃতীয়ত, হাই রিস্ক গ্রুপের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এইচআইভি/এইডস পরীক্ষা করতে হবে। চতুর্থত, ব্লাড ব্যাঙ্কের জন্য লাইসেন্স নেওয়া বাধ্যতামূলক করতে হবে। পঞ্চমত, কাউন্সিলিং সেন্টার স্থাপন করতে হবে। ষষ্ঠত, হাসপাতাল ও স্ব^াস্থ্যকেন্দ্রের সংক্রমণ কন্ট্রোল সিস্টেমগুলোকে পরিবর্তিত ও উন্নত করতে হবে। সরকার, সমাজ, সে^চ্ছাসেবী সংস্থা, গোষ্ঠী ও পরিবারকে হাতে হাত মিলিয়ে এ মহামারীর বিরুদ্ধে লড়তে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন