Inqilab Logo

শুক্রবার, ০৫ জুলাই ২০২৪, ২১ আষাঢ় ১৪৩১, ২৮ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

সংসার চালানোই দায়

মো. জাহিদুল ইসলাম : | প্রকাশের সময় : ৩০ জুলাই, ২০২২, ১২:০৮ এএম

মহামারি করোনাভাইরাস পরিস্থিতি কাটিয়ে না উঠতেই বিশ^কে আরও বড় চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এ যুদ্ধের জেরে একদিকে বাড়ছে জ্বালানি তেলের দাম। আবার জ্বালানি তেলের দরবৃদ্ধির প্রভাবে বাড়ছে নিত্যপণ্যের দামও। অন্যদিকে ডলারের বিপরীতে মান হারাচ্ছে টাকা। সর্বসাকুল্যে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও প্রবল চাপ তৈরি হয়েছে। কেবল দরিদ্র ও খেটে খাওয়া জনগোষ্ঠী নয়, মুদ্রাস্ফীতিতে নাকাল মধ্যবিত্তও। বাজারে নিত্যপণ্যের দাম হুহু করে বাড়ছে। তবে গতকাল শুক্রবার বাজারে আগেই অতিরিক্ত দামে বিক্রি হওয়া অধিকাংশ পণ্যের দাম আর নতুন করে বাড়েনি। আমদানি ব্যয় বাড়ায় চাপ পড়ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও।
সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) জানায়, বিশ্বব্যাপী খাদ্য ও জ্বালানির মূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোয় ৩ মাসে ৭ কোটি ১০ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়েছে। গত ৩ মাসে উন্নয়নশীল বিশ্বে দারিদ্র্যের হার করোনা মহামারীর চেয়ে দ্রুত বেড়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও এ সঙ্কটের ভয়াবহ প্রভাব পড়েছে। এরই মধ্যে দেশে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৭ শতাংশে পৌঁছেছে, যা বিগত ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। সরকারি হিসাবেই এখন মজুরি বৃদ্ধির হারের তুলনায় মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির হার বেশি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুযায়ী, গত অর্থবছরের শেষ মাস জুনে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ। আর ওই মাসে মজুরি বেড়েছে ৬ দশমিক ৪৭ শতাংশ। অর্থাৎ গত বছরের জুনে যে পণ্য বা সেবা ১০০ টাকায় পাওয়া যেত, সেই পণ্য বা সেবা পেতে এখন ১০৭ টাকা ৫৬ পয়সা খরচ করতে হচ্ছে। অপরদিকে যে দিনমজুর-শ্রমিক বা অন্য পেশার মানুষ গত বছরের জুনে তার শ্রমের বিনিময়ে ১০০ টাকা পেয়েছেন, চলতি বছরের জুনে তারা পেয়েছেন ১০৬ টাকা ৪৭ পয়সা। অর্থাৎ বছর ঘুরে আয় বেড়েছে। কিন্তু তাতে খুব একটা লাভ হয়নি। উল্টো ১০৬ টাকা ৪৭ পয়সা আয়ের বিপরীতে এখন খরচ করতে হচ্ছে ১০৭ টাকা ৫৬ পয়সা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের দিনমজুর-শ্রমিকসহ বেসরকারি পেশাজীবীদের আয় যে হারে বেড়েছে, তা দিয়ে মূল্যস্ফীতি সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। উল্টো আরও বাড়তি খরচের বোঝা চাপছে ঘারে। মানুষের সঞ্চয় কমছে। ব্যক্তির ভবিষ্যৎ আর্থিক নিরাপত্তা অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। বিবিএস এখনো ২০০৫-০৬ ভিত্তিবছর ধরে মূল্যস্ফীতি গণনা করা হয়। কিন্তু গত দেড় দশকে অনেক কিছু বদলেছে। ভিত্তিবছর হালনাগাদ (আপডেট) না হলে প্রকৃত মূল্যস্ফীতির চিত্র উঠে আসবে না।
বিবিএসের মূল্যস্ফীতির তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ৩০ জুন শেষ হওয়া বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরে টানা ছয় মাস বাড়ার পর জানুয়ারিতে কিছুটা কমেছিল এই সূচক। ফেব্রুয়ারি থেকে তা আবার বাড়তে থাকে। গত মে মাসে মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। জুন মাসে তা রেকর্ড ভেঙে ঠেকেছে ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশে। গত জুন মাস শেষে দেশে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশে। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ৩৩ শতাংশ। অর্থাৎ খাদ্যদ্রব্য কিনতে গিয়েই সবচেয়ে বেশি চাপে রয়েছে মানুষ। আবার শহরাঞ্চলের চেয়ে গ্রামে মূল্যস্ফীতির চাপ বেশি।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাজারদরের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছেন না বর্তমানে তাদের আয় দিয়ে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বেসরকারি চাকুরিজীবি বলেন, মাসে বেতন পাই ৩০ হাজার টাকা। বেতনের এই টাকায় বাসা ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস সিলিন্ডার ও অফিস যাতায়াত খরচের পর মাসের বাজার ও সংসারের টুকিটাকি খরচের হিসাব মেলানো দুরূহ হয়ে পড়ে। তার ওপর দুই সন্তানের স্কুলের ফি ও পড়াশোনার খরচ জোগাতে হিমশিম খেতে হয় তাকে। এর মধ্যে পরিবারের কেউ হঠাৎ অসুস্থ হলে ঋণ করতে হয়।
তিনি বলেন, করোনার পর থেকে এ পর্যন্ত বেতন কেবল এক দফা বেড়েছে। কিন্তু জীবনযাত্রায় প্রত্যেকটি খাতে খরচ দফায় দফায় বাড়ছে। এ শহরে টিকে থাকতে বাধ্য হয়ে খাবার, কাপড়, চিকিৎসার মতো গুরুত্বপূর্ণ চাহিদায় কাটছাঁট করতে হচ্ছে। মাছ, গোশত, দুধ, দুগ্ধ জাতীয় খাবার খাওয়া ছেড়েই দিয়েছি। ছেলেদের পড়ার টিউটর, কাজের বুয়া, ডিস ও ইন্টারনেট সংযোগ বাদ দিয়েছি। এমনকি ছোটখাটো অসুস্থতায় চিকিৎসকের কাছেও যাই না। তারপরেও মাস শেষে ঋণ করতে হয়। খরচ বাড়ছে, কিন্তু বেতন সেভাবে বাড়ে না। আয়ের চেয়ে ব্যয় এখন অনেক বেশি।
শুধু তিনিই নন-মূল্যস্ফীতির চাপে রয়েছেন আরও অনেকে। করোনার পরে এখন অতি-মূল্যস্ফীতিতেই বেশি ঘায়েল মানুষ। বর্তমানে চাল, ডাল, তেল, চিনি, আটা, দুধ, ডিম, মাছ, গোশত থেকে শুরু করে সব ধরনের খাদ্যপণ্যের দাম অনেক বাড়তি। অনেক খাবার নিম্ন আয়ের এমনকি মধ্যম আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবও বলছে, বছরের ব্যবধানে প্রায় সব ধরনের খাদ্যপণ্যের দাম অনেক বেড়েছে।
সাড়ে ৭ শতাংশ মূল্যস্ফীতিকে ‘অশনিসংকেত’ বলে মনে করছেন কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান। তিনি বলেন, কর্মসংস্থান কিংবা উন্নয়ন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। তবে আমাদের উচিত এই মুহূর্তে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেওয়া। এজন্য অবশ্যই বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হারকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আমাদের যে অর্থনীতি, তাতে এটা করতে না পারলে মুদ্রাস্ফীতি বাড়বেই।
টানা ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষে সাগরে ইলিশ ধরা শুরু হয়েছে। জেলেদের জালে ধরা পড়ছে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ। পাইকারি বাজার পেরিয়ে ইতোমধ্যে ইলিশের ঘ্রাণে রমরমা খুচরা বাজার। এদিকে চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত যোগান থাকায় বাজারে ইলিশের দাম ক্রেতাদের নাগালের মধ্যে রয়েছে। তাই নিজের পছন্দমতো মাছটি কিনে বাড়ি ফিরছেন ক্রেতারা। আবার বিক্রি বাড়ায় খুশি বিক্রেতারও।
এককেজি ওজনের ইলিশের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকা, যা গত সপ্তাহে ছিল ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকা। ৭০০-৮০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৭০০-৮০০ টাকায়, যা গত সপ্তাহে ৮০০-৯০০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। আর ৪০০-৫০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৪৫০-৫০০ টাকা, যা গত সপ্তাহে ৬০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছিল।
ইলিশের দাম কমলেও অন্যান্য মাছের দাম কিছুটা বেড়েছে। বিভিন্ন বাজারে রুই মাছের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৪৫০ টাকা। তেলাপিয়া, পাঙাশ মাছের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৬০ থেকে ১৮০ টাকায়। শিং ও পাবদা মাছের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৪৬০ টাকা। শৈল মাছের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা। কৈ মাছের কেজি বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২৫০ টাকায়।
চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজসহ বেশিরভাগ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নতুন করে বাড়েনি। তবে সামান্য বেড়েছে দেশি রসুন, দেশি শুকনো মরিচ, দেশি হলুদ, জিরা, দারুচিনি ও ব্রয়লার মুরগির দাম। রাজধানীর বাজারগুলোতে দেখা যায়, ঈদের আগে হঠাৎ দাম বেড়ে যাওয়া কাঁচা মরিচ এখনও চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে। ২০০ টাকার নিচে কাঁচা মরিচ কিনতে পারছেন না ক্রেতারা।
বাজারে নতুন শিমের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকায়। গাজর ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা এবং পাকা টমেটো ৮০ থেকে ১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। গত সপ্তাহে ৫০ থেকে ৬০ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া বরবটি এখন ৭০ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। শসার কেজি গত সপ্তাহের মতো ৪০-৫০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। বেগুনের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৭০ টাকায়, কাঁকরোল ৫০ থেকে ৭০ টাকা, কাঁচা পেঁপে ৩০ থেকে ৪০ টাকা, পটল ২০ থেকে ৩০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ থাকায় বাজারে সব ধরনের শাকের দাম কমেছে। ব্যবসায়ী বলছেন, আগে সব ধরনের শাকের আঁটি ২০ থেকে ২৫ টাকা দরে বিক্রি হতো। এখন সেগুলো ১০-১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এছাড়া খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১৭৫ টাকা কেজি দরে। এক লিটার বোতলজাত সয়াবিন বিক্রি হচ্ছে ১৮৫ টাকা দরে। পাঁচ লিটার সয়াবিন তেলের দাম ৯০০ টাকায় নেমেছে।
ব্যবসায়ীরা ব্রয়লার মুরগির কেজি বিক্রি করছেন ১৫০ টাকায়। পাকিস্তানি কক বা সোনালি মুরগির কেজি বিক্রি হচ্ছে ২৬০ থেকে ২৮০ টাকায়। মুরগির মতো দাম অপরিবর্তিত রয়েছে ডিমের। এক ডজন ডিম আগের মতো ১২০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ