Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অন্ধকার ঘরে শিকলবন্দি মা

এম বেলাল উদ্দিন রাউজান (চট্টগ্রাম) থেকে | প্রকাশের সময় : ২৯ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

পুরো রুম অন্ধকার। বিদঘুটে গন্ধ পুরো রুমজুড়ে। বাইরে থেকে তালাবদ্ধ দরজা। ভেতরে ৬৫ বছর বয়সী মীরা দে’র পায়ে শিকলপড়া। খাটের (চৌকির) সাথে বাঁধা সেই শিকল। বাইরে কোনো আগুন্তুকের কণ্ঠ শুনলেই বৃদ্ধ মীরা বলছে, ‘ইবা কন, কন আইস্যিদে, কিল্লা আইস্যিদে’ (সে কে, কি জন্য এসেছে) কিংবা অ্যাই ভাত খাইয়ুম, অ্যারে দু’য়া ভাত দে’ (আমি ভাত খাবো, আমাকে অল্প ভাত দাও)। রাউজান পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কিশোরী মোহনবাড়ির এই অসুস্থ মা (মীরা দে’কে) তিন মাসের বেশি সময় ধরে পায়ে শিকল পরিয়ে অন্ধকার ঘরে তালাবদ্ধ করে রেখেছেন তার সন্তানেরা। প্রায় দেড়-দুই বছর  ধরে এই বৃদ্ধা মানসিক সমস্যায় ভূগছেন। তিন মাস ধরে মীরাকে শিকল পরিয়ে রাখা হয়েছে। ব্যাপারটি প্রতিবেশী সচেতন ব্যক্তিদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার করেছে।
তারা বলছেন, মীরার মানসিক সমস্যা আছে। কিন্তু পুরোপুরি মানসিক ভারসাম্যহীন কিংবা পাগল নন। তিনি প্রতিবেশী ও স্বজনদের চিনতে পারেন। ভাত খেতে চান, শিকল খুলে দিতে বলেন। ডাক্তারের কাছে যাবে কি না জিজ্ঞেস করলে  ‘হ্যাঁ’ বলে উত্তর দেন। এরকম মহিলাকে চট্টগ্রাম কলেজ হাসপাতাল বা অন্য কোনো হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা করা হলে সুস্থ হয়ে উঠবেন। অথচ তার সন্তানেরা সেটি না করে তাকে পায়ে শিকল পরিয়ে বন্দি অবস্থায় রেখেছেন ঘরের মধ্যে।
প্রতিবেশী ও স্থানীয় জনসাধারণের সাথে আলাপ করে জানা যায়, পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা বৃদ্ধা মীরা দে’র স্বামী বিরেন্দ্র দে মারা যান বহুবছর আগে। তার দুই ছেলে সন্তানের মধ্যে অঞ্জন দে’র দোকান আছে রাউজানে। কাঞ্চন দে চট্টগ্রাম শহরে থাকেন কর্মসূত্রে। মীরার মেয়ে সন্তানের বিয়ে হয়ে গেছে। দেড় বছর আগে মীরার মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। অস্বাভাবিক আচরণের কারণে তাকে কখনো শিকল পরিয়ে রাখা হয়নি। কিন্তু গত তিন মাস ধরে তাকে দুর্গন্ধময় একটি শিকল পরিয়ে তালাবদ্ধ রেখেছেন তার সন্তানেরা। এ বিষয়টিকে অমানবিক বলে মনে করছেন এলাকার সচেতন মহল।
প্রতিবেশী এক প্রতিবাদী তরুণ বলেন ‘মীরার মানসিক কিছু সমস্যা থাকলেও তিনি সবকিছু চিনেন, আমি ডাক দিলে আমার ডাকে সারা দেন, খেতে চান, শিকলপড়া থেকে মুক্ত হয়ে ডাক্তারের কাছে যেতে চান।  চিকিৎসা পেলে তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন।’ এই প্রতিবাদী তরুণের মা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বলেন ‘আমি বাইরে থেকে এসেছি বুঝলে আমাকে ভাত দিতে বলেন। সাধ্যমতো চেষ্টা করি তাকে খাবার দিতে। তার ছেলেরা তাকে মেডিকেলে না নিয়ে কেন শিকল পরিয়ে রেখেছেন বুঝি না, সব সময় শিকল খুলে দিতে বলেন মীরা। খারাপ লাগে তার জন্যে।’ এ ব্যাপারে প্রতিবেশী রতœা চৌধুরী ও কমলা চৌধুরী বলেন ‘শিকল পড়া থেকে মুক্ত হতে আর্তনাদ করেন বৃদ্ধা মীরা।’
এ ব্যাপারে মীরার ছেলে অঞ্জন দে’র স্ত্রী শিবু দে বলেন ‘দেড় বছরেরও অধিক সময় ধরে শ্বাশুড়ি অসুস্থ। ওষুধ খেতে চায় না। ঝোঁপ-জঙ্গলে চলে যান। তাই তাকে গত তিন মাস ধরে শিকল পরিয়ে ঘরের মধ্যে আটকে রাখা হয়েছে। সেই ঘরেই তাকে খাবার দেয়া হয়। তিনি প্রকৃতির ডাকে সারা দেনও সে ঘরেই।’
এ ব্যাপারে মীরার ছেলে কাঞ্চন দে’র কাছে মোবাইলে জানতে চাইলে তিনি বলেন ‘মানসিক সমস্যার কারণে তাকে (মাকে) কিছুদিন ধরে শিকল পরিয়ে রাখা হয়েছে। তার চিকিৎসা করাবো।’
এ ব্যাপারে স্থানীয় পৌরসভার কাউন্সিলর অ্যাডভোকেট দীলিপ চৌধুরী বলেন ‘মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ায় ঘরের মধ্যে এক মহিলাকে আটকে রাখার কথা শুনেছি। বিষয়টি আমি সরেজমিন দেখব।’ এদিকে এ প্রতিনিধি সরেজমিন ঘটনাস্থলে মীরার ছবি তোলার সময় তিনি মুখ ঢেকে রাখেন।




 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ