Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

গণপূর্তের প্রধান প্রকৌশলীর পদোন্নতির সুপারিশ

দুদকের তদন্ত আড়াল

নূরুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ২৭ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তের বিষয় আড়াল করে গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী (চলতি দায়িত্ব) মোঃ হাফিজুর রহমান মুন্সিকে প্রধান প্রকৌশলী পদে পদোন্নতির সারসংক্ষেপ সুপিরিয়র সিলকশন বোর্ডে উপস্থাপনের জন্য পাঠানো হয়েছে। গত ১৭/১১/২০১৬ ইং তারিখে সারসংক্ষেপটি গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব স্বাক্ষর করার  ১০ দিন আগে দুর্নীতি দমন কমিশন মোঃ হাফিজুর রহমান মুন্সির বিরুদ্ধে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ গ্রহণ, দুর্নীতি ও অবৈধ উপায়ে কোটি কোটি টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের অর্জনের অভিযোগ তদন্তে ‘তদন্ত কর্মকর্তা’ নিয়োগ দিয়েছে। এর আগে গত ৬ সেপ্টেম্বর জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) মহাপরিচালকের কাছে মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব স্মৃতি কর্মকার স্বাক্ষরিত এক পত্রে বলা হয় “হাফিজুর রহমান মুন্সীকে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা অনুযায়ী প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ নেই বিধায় তার নামে প্রকাশিত গেজেট ও এ মন্ত্রণালয় থেকে তার নামে ইস্যুকৃত সাময়িক সনদ বাতিলের প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের জন্য মাননীয় মন্ত্রী সিদ্ধান্ত প্রদান করেছেন। তাই তার নামে প্রকাশিত গেজেট বাতিল করার লক্ষ্যে জামুকার পরবর্তী সভায় উপস্থাপনের নিমিত্তে সংশ্লিষ্ট কাগজপত্রাদি নির্দেশক্রমে প্রেরণ করা হলো।’’ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী ও জামুকার চেয়ারম্যান আ ক ম মোজাম্মেল হক এ বিষয়ে সাংবাদিকদের জানান, টিপু মুন্সীর মুক্তিযোদ্ধা সনদ জাল প্রমাণিত হওয়ায় তা বাতিলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। দ্রুত এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হবে। মন্ত্রী বলেন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় দ্রুত তাকে বর্ধিত মেয়াদের চাকরি থেকে অব্যাহিত না দিলে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। গত মাসে এ বিষয়ে জামুকার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলেও রহস্যজনকভাবে সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়নি। তার উপর দুদকে মোঃ হাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তনাধীন থাকা সত্ত্বেও ১৭/১১/১৬ তারিখে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব মোঃ শহীদ উল্লা খন্দকার স্বাক্ষরিত প্রধান প্রকৌশলী পদে পদোন্নতির জন্য সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের বিবেচনার জন্য প্রেরিত চিঠির ৬নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছেÑ “দুর্নীতি দমন কমিশন এবং এ মন্ত্রণালয়ে সংরক্ষিত তথ্য অনুযায়ী অনুচ্ছেদ-৪ এ বর্ণিত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি সংক্রান্ত কোনো অভিযোগ/মামলা অনুসন্ধানাধীন/তদন্তনাধীন নেই।” অনুচ্ছেদ-৪ এর ২ নম্বরেই রয়েছে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (বর্তমানে প্রধান প্রকৌশলী পদে চলতি দায়িত্বে নিয়োজিত) মোঃ হাফিজুর রহমান মুন্সির নাম।  
গত ৭ নভেম্বর দুর্নীতি দমন কমিশনের উপ-পরিচালক মলয় কুমার সাহা স্বাক্ষরিত দুদকের এক চিঠিতে (স্মারক নং-দুদক/বিঃ অনুঃ ও তদন্ত-২/১৩১-২০১৬) দুদুকের পরিচালক মীর মোঃ জয়নুল আবেদীন শিবলীকে গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী হাফিজুর রহমান মুন্সীর বিরুদ্ধে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ গ্রহণ, দুর্নীতি ও অবৈধ উপায়ে কোটি কোটি টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগের তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়েছে। চিঠিতে দুর্নীতি দমন কমিশন, প্রধান কার্যালয়, ঢাকার যাচাই-বাছাই কমিটির স্মারক নং-দুদক/অভি: যাচাই-বাছাই/৫৮৮-২০১৬/৪৪৯৮৯ তারিখ ৭-১১-২০১৬ খ্রি: সূত্র উল্লেখপূর্বক বলা হয়েছে, “উপর্যুক্ত বিষয়ে উল্লিখিত অভিযোগটি অনুসন্ধান করার জন্য আপনাকে অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা নিয়োগ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। মহাপরিচালক (বিশেষ তদন্ত), দুর্নীতি দমন কমিশন, প্রধান কার্যালয়, ঢাকা তদারককারী কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করবেন।”
গণপূর্ত প্রধান প্রকৌশলী মোঃ হাফিজুর রহমান মুন্সি ওরফে টিপু মুন্সির বিরুদ্ধে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদ গ্রহণ করার অভিযোগ অতি পুরনো। এ সংক্রান্ত অভিযোগ দায়েরের পর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটি তাঁকে তলব করে শুনানি করে। কমিটির শুনানিতে সেই সময়ে দেশে হকিস্টিকের কোন প্রচলন না থাকলেও হকিস্টিক নিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন বলে দাবি করেন প্রকৌশলী হাফিজুর রহমান টিপু মুন্সী। এরপর মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক আতাউল গণি ওসমানী তাকে সনদপত্রও দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই সনদে দু’টি বানান ভুল পাওয়া যায়। অথচ অন্যান্যদের সনদে বানান দু’টি সঠিক আছে। সংসদীয় কমিটির সুপারিশের প্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয়ের তদন্তে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এরপরও সনদ বাতিলে গড়িমসি করায় এনিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে সংসদীয় কমিটি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ‘দেশ রক্ষা বিভাগ, স্বাধীনতা সংগ্রামের সনদপত্র’ মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়ে মন্ত্রণালয় থেকে সাময়িক সনদ নিয়েছিলেন গণপূর্ত অধিদপ্তরের চলতি দায়িত্বে থাকা প্রধান প্রকৌশলী হাফিজুর রহমান টিপু মুন্সী। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এক বছর বর্ধিত মেয়াদে চাকরিও করছেন তিনি। কিন্তু তিনি ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করে। পরে মন্ত্রী তার দপ্তরে শুনানি গ্রহণকালে দেখতে পান, ওই প্রকৌশলীর দেশ রক্ষা বিভাগ, স্বাধীনতা সংগ্রামের সনদপত্রে উজ্জ্বল ও সংগ্রাম বানান দু’টি ভুল। জাল সনদে উজ্জ্বল বানান লেখা হয়েছে ‘উজ্জল’ ও সংগ্রামের বানান লেখা হয়েছে ‘সংগামের’। এছাড়া সনদপত্রে যে ক্রমিক নম্বর উল্লেখ করা হয়েছে, তার ফন্ট এর সঙ্গে প্রকৃত সনদপত্রের ফন্ট-এর কোন মিল নেই।
শুনানির পর জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে পাঠানো মন্ত্রীর স্বাক্ষরিত আদেশনামায় বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, এতেই প্রমাণিত হয়, হাফিজুর রহমান মুন্সীর দাখিলকৃত আতাউল গণি ওসমানীর দেশ রক্ষা বিভাগ, স্বাধীনতা সংগ্রামের সনদপত্রটি সঠিক নয়। এতে আরো বলা হয়েছে, ওই জাল সনদের ভিত্তিতে তাকে গেজেটভুক্ত করা সঠিক হয়নি। তাই হাফিজুর রহমান মুন্সীর মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়।
সূত্রগুলো জানায়, বিষয়টি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য গত ৬ সেপ্টেম্বর জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে (জামুকা) পাঠানো পর দুই মাসে একাধিক বৈঠকেও এ বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি জামুকা। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে সংসদীয় কমিটি। কমিটির একাধিক সদস্য সাংবাদিকদের বলেন, সংসদীয় কমিটির সুপারিশের প্রেক্ষিতে মন্ত্রী নিজে শুনানি গ্রহণের পর মন্ত্রণালয় ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদ বাতিলের সিদ্ধান্ত নিলেও জামুকা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে গড়িমসি করাটা অনৈতিক। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী নিজেই জামুকার চেয়ারম্যান হওয়ার পরও মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না হওয়া দুঃখজনক। এর সাথে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের পদোন্নতির সুপারিশে প্রধান প্রকৌশলী হাফিজুর রহমান মুন্সির বিরুদ্ধে দুর্নীতি সংক্রান্ত কোনো অভিযোগ/মামলা অনুসন্ধানাধীন/তদন্তনাধীন নেই বলে সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডে উপস্থাপনের জন্য চিঠিতে অনেকেই বিস্মিয় প্রকাশ করেছেন। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরীর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি ব্যস্ত আছেন বলে এসএমএস এর মাধ্যমে জানান।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ