Inqilab Logo

মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

গাড়ি পার্কিংয়ে ফুটপাতই ভরসা

মতিঝিলের বাণিজ্যিক ভবনগুলোতে নেই পর্যাপ্ত কার পার্কিং স্পেস

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ২৬ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১২:১৩ এএম, ২৬ নভেম্বর, ২০১৬


রাজধানীর মতিঝিল এলাকার বহুতল ভবনগুলোর বেশিরভাগেরই কার পার্কিং স্পেস নেই। যাও দু’য়েকটি ভবনের রয়েছে সেগুলোও বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার হচ্ছে। ওই এলাকার দৈনন্দিন প্রয়োজনে গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য ফুটপাতই এখন তাদের শেষ ভরসা। এক হিসেবে দেখা গেছে, মতিঝিল-দিলকুশা বণিজ্যিক এলাকার ৯০ ভাগ ভবনেই কারপার্কিং স্পেস নেই। নকশা অগ্রাহ্য করে পার্কিং ছাড়াই এসব বহুতল ভবন গড়ে উঠলেও রাজউক নিশ্চুপ। অনুমোদিত নকশায় এসব বহুতল ভবন গড়ে উঠলেও নির্ধারিত পার্কিং স্পেস বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। রাজউকের নাকের ডগায় শত শত বহুতল বাণিজ্যিক ভবন কীভাবে নকশাবহির্ভূতভাবে নির্মাণ করা হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আর এ কারণে পুরো মতিঝিল-দিলকুশা এলাকায়ই এখন যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং করা হচ্ছে। এতে মারাত্মক ব্যাহত হচ্ছে এ বাণিজ্যিক এলাকার স্বাভাবিক কার্যক্রমে। এখানকার সহস্রাধিক অফিসের কর্মকর্তা ও সেবাগ্রহীতার কয়েক হাজার গাড়ি প্রতিদিন পার্কিং করা হচ্ছে ব্যস্ততম সড়কে। এ কারণে দিনভর তীব্র যানজটে দুঃসহ ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে এ এলাকা দিয়ে চলাচলকারীদের।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মতিঝিলে বহুতলবিশিষ্ট ভবন রয়েছে ১৫৭টি। এর মধ্যে শুধুমাত্র ১৭টিতে আছে পার্কিং স্পেস। বাকি ১৪০টি ভবনেই গাড়ি রাখার কোনো ব্যবস্থা নেই। কারপার্কিং স্পেসে বিভিন্ন ধরনের অফিস, রেস্তোরাঁ এবং দোকানপাট তুলে বাণিজ্যিক কাজকর্ম পরিচালনা করা হচ্ছে। অবাক করা বিষয় হচ্ছে, রাজউক ভবন বহুতল হলেও নেই কোনো কারপার্কিং স্পেস ব্যবস্থা।
রাজউকে সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে জানা গেছে, মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকার মতো এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকার ভবনগুলো কারপার্কিং ছাড়া কীভাবে তৈরি হলো সেটা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সড়কে অবৈধ গাড়ি পার্কিং বন্ধের বিষয় নিয়েও তারা সোচ্ছার হচ্ছে। সড়কে অবৈধ পার্কিং বন্ধ করতে পূর্বাণী হোটেলের পেছনে বহুতলবিশিষ্ট একটি কারপার্কিং ভবন গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করছে বলেও রাজউক থেকে জানা যায়।
মতিঝিল এলাকার বেশিরভাগ বহুতল ভবন ৯০ দশকের শুরু থেকে পরবর্তী পর্যায়ে নির্মিত হয়েছে। সে সময় এসব ভবনে পার্কিং স্পেস রাখার বাধ্যবাধকতা ছিল। তারপরও রাজউকের ছাড়পত্র নিয়েই নকশাবহির্ভূতভাবে পার্কিং ছাড়াই বহুতল ভবনগুলো নির্মিত হয়েছে। আর পার্কিং ব্যবহৃত হচ্ছে বাণিজ্যিক কাজে। এভাবে বহুতল ভবন মালিকরা অর্থ আয় করলেও রাজউক কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে নিশ্চুপ। পার্কিং না থাকায় রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালাচ্ছে রাজউক। কিন্তু ঘরের পাশেই মতিঝিলের পার্কিং স্পেস উদ্ধারে তেমন কোনো তৎপরতাই নেই।
তবে কিছু ভবন রয়েছে ’৭০ ও ’৮০-র দশকে নির্মিত, যা মতিঝিলের মোট ভবনের ১০ শতাংশের বেশি হবে না। ওই সময় পার্কিং স্পেস রাখার বাধ্য-বাধকতা ছিল না। এছাড়া গুটিকয়েক ভবন রয়েছে ’৫০-’৬০-র দশকের। রাজউক ভবন তার অন্যতম। একসময় এটি বাংলাদেশ টেলিভিশন ভবন ছিল। এরপর ডিআইটি অফিস; পরে নাম পরিবর্তিত হয়ে রাজউক কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এ প্রতিষ্ঠানেরও কোনো গাড়ি পার্কিং স্পেস নেই। তবে কিছু ওপেন স্পেস রয়েছে। সেখানে রাজউকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গাড়ি রাখা হয়। রাজউকে বিভিন্ন প্রয়োজনে যারা গাড়ি নিয়ে আসেন তাদেরকে যত্রতত্র পার্কিং করতে হয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, দৈনিক বাংলা থেকে শাপলা চত্বর পর্যন্ত সড়কের দু’পাশে বহুতল ভবনের সংখ্যা ৬৪টি। এর মধ্যে ৬টি ভবনে কারপার্কিং রয়েছে। শাপলা চত্বর থেকে ইত্তেফাক মোড় পর্যন্ত সড়কে ভবনের সংখ্যা ৩৬টি। এর মধ্যে কারপার্কিং স্পেস আছে ৩টিতে। রাজউক ভবন থেকে আমেরিকান লাইফ ইন্স্যুরেন্স পর্যন্ত সড়কে ২৩টি ভবন। এর মধ্যে ৪টিতে কারপার্কিং স্পেস রয়েছে। ইউনুছ সেন্টার থেকে পিপলস টাওয়ার পর্যন্ত সড়কের উভয়পাশে ৩৪টি ভবন। এর মধ্যে পার্কিং স্পেস আছে মাত্র ৪টিতে।
জানা গেছে, ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় ভবন নির্মিত হচ্ছে ঢাকা মহানগর ইমারত (নির্মাণ, উন্নয়ন, সংরক্ষণ ও অপসারণ) বিধিমালা-২০০৮ অনুসরণ করে। এ বিধিমালা অনুসরণ করে বাধ্যতামূলকভাবে কার-পার্কিংয়ের সংকুলান রেখেই নকশা অনুমোদন করছে রাজউক। ১৯৯০ সালের শুরু থেকে ভবন নকশা অনুমোদনের ক্ষেত্রে কারপার্কিংয়ের শর্ত অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
বিস্ময়কর বিষয় হলো, মতিঝিল এলাকার ১১০ নম্বর প্লটে ২২তলা ভবন, ১২৫/এ প্লটে ১৫তলা ভবন, ১০৭ নম্বর প্লটে ১২তলা, ১/বি নম্বর প্লটে ১২তলা, ৮৩, ৮৪ নম্বর প্লটে ১০তলা এবং ৭৩ নম্বর প্লটে ১১তলা বিশিষ্ট বাণিজ্যিক ভবনে গাড়ি রাখার নির্দিষ্ট কোনো জায়গা নেই। এসব ভবনের পাশের সড়কেই যত্রতত্রভাবে গাড়ি পার্কিং করা হচ্ছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, মতিঝিল এলাকার অর্ধেকের বেশি সড়ক সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত অবৈধ পার্কিংয়ের দখলে থাকে। যে কারণে সৃষ্টি হয় তীব্র যানজট। এ সময় ১০ মিনিটের পথ পাড়ি দিতে আধা ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা বা তার চেয়েও বেশি সময় লাগে, যা নাগরিক জীবনকে বিষিয়ে তোলে।
সিটি সেন্টারে অব্যবস্থাপনা : মতিঝিলের যানজট নিরসনে নির্মিত বহুতল কারপার্কিং সিটি সেন্টার কোনো কাজে আসছে না। তবে তা বাণিজ্যিকভাবেই ব্যবহৃত হচ্ছে। অব্যবস্থাপনার কারণেই আধুনিক এই কারপার্কিংয়ে কেউ গাড়ি রাখতে আগ্রহী হচ্ছেন না। প্রতিদিন যেসব গাড়ি পার্কিং করা হয় তার সবই ভবনের বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের গাড়ি। যদিও সিটি কর্পোরেশনের নিজস্ব জমিতে চালু হওয়া মতিঝিলের সিটি সেন্টারের নিচের ১০টি ফ্লোর কারপার্কিংয়ের ব্যবস্থা রেখে নির্মাণ করা হয়। শর্তানুসারে বেজমেন্টসহ মোট ১০তলা বিশিষ্ট বহুতল কারপার্কিং কাম বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করে ওরিয়ন গ্রুপ। ২০০৯ সালে শেষ হয় ৩৭তলা বিশিষ্ট এই বহুতল ভবনটি। ওই বছরই নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ওরিয়ন গ্রুপ তাদের শর্তানুসারে ২৫টি ফ্লোর নিজেরা রেখে বাকি ১২টি ফ্লোর ঢাকা সিটি কর্পোরেশনকে বুঝিয়ে দেয়। নিজেদের তত্ত্বাবধানে সিটি সেন্টারের কারপার্কিং ব্যবস্থাটি চালু করে ডিএসসিসি। প্রতি ঘণ্টা ১০ টাকা হারে প্রায় দেড় হাজার গাড়ি পার্কিংয়ের সুবিধা থাকলেও দিনে ২০/৩০টির বেশি গাড়িও পার্ক করছে না কেউ। উল্টো, ভবনের সামনে অবৈধভাবে শত শত গাড়ি পার্ক করে রাখা হয়েছে।
এদিকে ৩৭ দিলকুশায় সিটি কর্পোরেশনের অপর একটি জমিতে ২০০৫ সালে আরেকটি বহুতলবিশিষ্ট কারপার্কিং কাম বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের জন্য এমআর ট্রেডিংয়ের সঙ্গে চুক্তি করে সিটি কর্পোরেশন। বিভিন্ন অনিয়ম ও শর্ত ভঙ্গ করে রাজউকের নকশা অনুমোদন না নিয়ে ৩২তলা পর্যন্ত ভবন নির্মাণ করে প্রতিষ্ঠানটি। অন্যদিকে সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে চুক্তি থাকলেও বেজমেন্টের ২টিসহ মোট ৫টি ফ্লোরে কারপার্কিংয়ের কোনো সুবিধাই রাখেনি প্রতিষ্ঠানটি। এ নিয়ে আদালতে মামলা চলছে। এছাড়া সাধারণ বীমা ভবনে ৬০০টি গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা (ঘণ্টাপ্রতি ভাড়া ভিত্তিতে) ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। সরেজমিন দেখা গেছে, সিটি ট্রেড সেন্টারে ৫০টি ও সাধারণ বীমা ভবনে মাত্র ২০টি গাড়ি পার্কিং করা হয়েছে।
প্রকৌশল বিশেষজ্ঞ ম. ইনামুল হক বলেন, কার পার্কিংয়ের জায়গা না রেখে ভবনের নকশা অনুমোদন দেয়া রাজউকের অপরিকল্পিত এবং অদূরদর্শিতামূলক কাজের পরিচয়। তবে এখন সে সমালোচনা করে কোনো লাভ নেই। সমাধানের পথ বের করতে হবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, রাজউকের ব্যর্থতার পাশাপাশি যৌক্তিক কারণও রয়েছে। ’৬০, ’৭০ বা ’৮০-র দশকে রাজউক পার্কিং স্পেস ছাড়া অনেক আবাসিক ভবনের নকশা অনুমোদন দিয়েছে। এটা অবশ্য সে সময়ের বাস্তবতায় ঠিক ছিল। যদিও ভবিষ্যৎ চিন্তা করলে এমনটি করা ঠিক হয়নি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ