Inqilab Logo

শুক্রবার ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বানভাসিদের মাথাপিছু সরকারি বরাদ্দ ২ টাকা

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ২০ জুন, ২০২২, ১২:০১ এএম

সারাদেশের বিভিন্ন জেলায় বন্যায় আক্রান্ত হয়েছেন দেড় কোটির বেশি মানুষ। দুর্গতদের সহায়তায় গণমাধ্যমে ব্যপক প্রচারণা চালানো হচ্ছে। সরকারি অনেক কর্মকর্তার ছুটি বাতিল করা হয়েছে। অথচ বেশির ভাগ এলাকায় দুর্গতরা দু’দিনে এক বেলা খাবারও পাচ্ছেন না। খাবার পানির তীব্র সংকট। এমনকি অনেক দুর্গত জানিযেছেন, তিন দিন থেকে খাবার পানি পাননি এবং দিনে এক বেলা চিড়া খেয়ে দিনযাপন করছেন। তবে সরকার সমর্থিত কিছু মিডিয়া প্রচার করছে সারাদেশে দুর্গতদের জন্য ব্যপকভাবে ত্রাণ বিরতণ করা হচ্ছে। বাস্তবে দেখা যায় উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোর বন্যাদর্গতরা এখনো কোনো ত্রাণ পাননি। কুড়িগ্রাম, রংপুর, গাইবান্ধা, জামালপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, নিলফামারি, লালমনিরহাটসহ কয়েকটি জেলায় বন্যাদুর্গত এলাকার মানুষ ত্রাণের জন্য হাহাকার করছেন। তবে সিলেট ও সুনামগঞ্জের দুই জেলায় বন্যার্তদের সরকারি ভাবে ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। অন্য বন্যাকবলিত জেলা গুলোতে ১০ লাখ টাকা ও ১০ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার দেওয়া হয়েছে। যা দুর্গতদের মাথাপিছু ভাগে পড়ে এক টাকা ৮০ পয়সা। সরকারি ভাবে যে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তা অপ্রতুল।

বন্যার্তদের আহাজারি চলছে। বাড়ছে পানি। ডুবছে জনপদ। বিদ্যুৎ নেই। খাবার নেই। নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার নেই তেমন ব্যাস্থা। পরিবার-পরিজন নিয়ে দুঃসহ সময় পার করছেন পানিবন্দি মানুষজন। সময় যত যাচ্ছে বাড়ছে বিপদ, বাড়ছে উৎকণ্ঠা। সরকারি ভাবে সিলেট ও সুনামগঞ্জের দুই জেলায় ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা করে অর্থ সহায়তা দেওয়া হয়েছে। বাকী বন্যাকবলিত অন্যসব জেলায় ১০ লাখ টাকা ও ১০ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বন্যার্তদের জন্য গতকাল রোববার ২০ কোটি টাকা দিয়েছেন। এদিকে সিলেট বিভাগের ক্ষয়ক্ষতি বেশি হলেও উত্তরাঞ্চলের জেলা গুলোর ক্ষয়ক্ষতির তেমন তথ্য নেই দুযোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর কাছে। উত্তরাঞ্চলের কতটি জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে তা বলতে পারেনি।

সারাদেশে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি। ভারতীয় পাহাড়ি ঢলে দোকানপাট তলিয়ে যাওয়ায় সিলেটে নিত্যপণ্যের সংকট দেখা দিয়েছে। বেশি দামেও মিলছে না চাল-ডালসহ নিত্যপণ্য। এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকায় দেখা দিয়েছে মোমবাতি ও দেশলাই সংকট। বন্যার পানিতে বহু দোকান তলিয়ে যাওয়ায় এ সংকট দেখা দেয়। দেশের বিভিন্ন জেলায় বন্যায় আক্রান্ত হয়েছেন দেড় কোটি মানুষ। বন্যার কারণে নাজুক সিলেট ও সুনামগঞ্জের পরিস্থিতি। সরকারি ভাবে যে ত্রাণ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তা বানভাসী মানুষের জন্য খুবেই সামান্য। বানের পানি গ্রাস করেছে ১২টি জেলায়র ৭৫টি উপজেলার সব সড়ক, বেড়িবাধ এবং গ্রামীণ রাস্তা ঘাট। পানিতে ভেসে গেছে বাড়িঘর। এ পর্যন্ত বন্যায় দুজনের প্রাণহানি ঘটেছে। সিলেটের ৬০ শতাংশ এবং সুনামগঞ্জের ৯০ শতাংশ এলাকা পানিতে প্লাবিত হয়েছে। ৪০ লাখ মানুষ পানিবন্দী এবং আগামীতে আরো বাড়বে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা উদ্ধার অভিযান চালাচ্ছেন। সেনাবাহিনীর ৩২টি, নৌবাহিনীর ১২টি, ফায়ার সার্ভিসের ৮টিসহ মোট ৫২টি বোট উদ্ধার অভিযান চালাচ্ছে। সুনামগঞ্জে ৭৫ হাজার এবং সিলেটের ৩০ হাজার মানুষকে উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া সিলেটে বেড়াতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের ২১ জন শিক্ষার্থীকে উদ্ধার করেছে সেনাবাহিনীর তিনটি বোট। এনামুর রহমান বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় সিলেটে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও সুনামগঞ্জে অবনতি হয়েছে। আজ সোমবার পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টিপাত থাকবে। ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী বলেন, নতুন করে নীলফামারী, নেত্রকোনা, রংপুর, কিশোরগঞ্জ, শেরপুর, জামালপুর, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জসহ আরও ১২টি জেলা বন্যাকবলিত হয়েছে। বন্যার্তদের জন্য যে সরকারি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তা জনপ্রতি দুই টাকা করে ভাগে পড়েছে।

বন্যাকবলিত জেলাগুলো হচ্ছে, রংপুর, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, শেরপুর, জামালপুর, হবিগঞ্জ, সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল। এর মধ্যে রয়েছে সুনামগঞ্জে ৭০ হাজার ও সিলেটে ৩০ হাজার মানুষ। আরও অনেক মানুষ এখনও পানিবন্দি। সেখানে সেনাবাহিনীর সহায়তায় জেলা প্রশাসনের ত্রাণ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।

বানের পানিতে বাড়িঘর ডুবে যাওয়ার তাদের অনেকে আশ্রয় নিয়েছে ঘরের চালা কিংবা কলার ভেলায়। অনেক এলাকায় পানির তোড়ে ভেসে গেছে ঘরের ধান-চাল, আসবাব, গবাদিপশু। দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্যসংকট। বানের পানিতে কোনোমতে ভেসে থাকা মানুষ উদ্ধারের আর্তি জানাচ্ছে। আবার অনেক এলাকার কোনো তথ্যও মেলেনি তিন দিনে। বিদ্যুৎ ও মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন থাকায় কেউ কারও খোঁজ নিতে পারছে না। নৌকাসহ বিভিন্ন ধরনের নৌযানের সংকটের কারণেও উদ্ধারকাজ ঠিকমতো করা যাচ্ছে না।

সিলেটের সীমান্তবর্তী কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার প্রায় শতভাগ এলাকাই এখন ভয়াবহ বন্যায় বিপর্যস্ত। সিলেট- কোম্পানীগঞ্জ- ভোলাগঞ্জ সড়কসহ উপজেলার সবগুলো সড়ক পানির নিচে। উপজেলা সদরে অবস্থিত সরকারি অফিস, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হাঁটু থেকে গলাসমান পানি। গ্রামগুলো যেন পুরোটাই ডুবে যাচ্ছে। দূর থেকে কেবল গাছপালার পাতা আর ওপরের কিছু অংশ চোখে পড়ে। কোম্পানীগঞ্জের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক সাব্বির আহমদ শনিবার সন্ধ্যায় জানান, সিলেট জেলার মধ্যে এই উপজেলার বেশিরভাগ মানুষ তুলনামূলক নিম্ন আয়ের। তারা পাথর কোয়ারি, পাথর ভাঙার মিলে দিনমজুরের কাজ করেন। এই অভাবী মানুষ বন্যায় চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় জীবনশঙ্কায় রয়েছেন। উপজেলা জুড়ে খাদ্যসংকট চরমে।

কোম্পানীগঞ্জের ইসলামপুর গ্রামের তোফাজ্জল হোসেন বলেন, পরিবারের ১২ জন সদস্য নিয়ে চরম উৎকণ্ঠায় আছি। ঘরের মধ্যে কোমরসমান পানি। এর ওপরে বাঁশের মাচা তৈরি করে সেখানে আছি। রান্নাবান্নার কোনো সুযোগ নেই। শুকনো খাবার শেষ হয়ে গেছে। এখন ত্রাণের অপেক্ষায় আছি। গোয়াইনঘাট উপজেলার সালুটিকরের হানিফ মিয়া জানান, পরিবারের নারী-শিশু ও গবাদিপশু জৈন্তাপুরে এক আত্মীয়ের বাড়িতে পাঠিয়ে তিনি একটি ছোট নৌকা নিয়ে বাড়িতে অবস্থান করছেন। তার আধাপাকা ঘরটিও যেকোনো সময় ভেঙে যেতে পারে বলে তিনি আশাঙ্কা করছেন। তিনি বলেন, ক্ষেতের ফসল গেছে, ঘরের ধান-চাল, আসবাবও শেষ। এখন যদি ঘরটিও ভেঙে যায় তাহলে আমরা কোথায় যাব।

সিলেটে বন্যার্তদের উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতা প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান পানিবন্দি অবস্থায় যারা সংকটাপন্ন, তাদের উদ্ধারে সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসন মিলে কাজ করছে। গত শুক্রবার থেকে রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত জেলার সদর উপজেলা, কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর থেকে কয়েক হাজার লোককে উদ্ধার করে নিরাপদ আশ্রয়ে আনা হয়েছে। পাশাপাশি ত্রাণসহায়তাও দেওয়া হচ্ছে। তবে আরও ত্রাণ বরাদ্দের জন্য ঊর্ধ্বতন র্কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।

সিলেট সেনানিবাসের জিওসি মেজর জেনারেল হামিদুল হক জানান, সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলায় বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। ভয়াবহ বন্যাকবলিত সিলেটের ৩টি ও সুনামগঞ্জের ৫টি উপজেলায় শুক্রবার থেকে উদ্ধারকাজ পরিচালনা করছে সেনাবাহিনীর ৯টি ইউনিট।

সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার ড. মুহম্মদ মুশাররফ হোসেন ইনকিলাবকে বলেন, সিলেট ও সুনামগঞ্জের চলমান বন্যা অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে, বিশেষ করে ভাটির জনপদ সুনামগঞ্জে বড় বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। অগণিত মানুষ পানিবন্দি। এই বিপর্যয় মোকাবিলায় বিভাগীয়, জেলা ও সংশ্লিষ্ট উপজেলা প্রশাসন সর্বোচ্চ আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। পাশাপাশি সেনাবাহিনীও সহায়তায় নেমেছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ