Inqilab Logo

সোমবার, ০৩ জুন ২০২৪, ২০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ২৫ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

বীমা নিয়ন্ত্রক সংস্থার চেয়ারম্যান মোশাররফের পদত্যাগ

আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগ নতুন চেয়ারম্যান হলেন সাবেক সচিব জয়নুল বারী

অর্থনৈতিক রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১৬ জুন, ২০২২, ১২:০১ এএম

আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগে নানা আলোচনার মধ্যে পদত্যাগ করেছেন বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) চেয়ারম্যান এম মোশাররফ হোসেন। গত মঙ্গলবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে তিনি পদত্যাগপত্র জমা দেন। পরে মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ গতকাল এক প্রজ্ঞাপনে তা গৃহীত হওয়ার কথা জানিয়ে আইডিআরএ চেয়ারম্যানের পদ শূন্য ঘোষণা করে। সেই সঙ্গে আইডিআরএ’র নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয়া হয়। সাবেক সচিব মোহাম্মদ জয়নুল বারীকে নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ দিয়ে বুধবার প্রজ্ঞাপন জারি করে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।

ড. এম মোশাররফ হোসেন ২০১৮ সালের ৪ এপ্রিল আইডিআরএ’র সদস্য (লাইফ) হিসেবে নিয়োগ পান। এরপর ২০২০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর তাকে তিন বছরের জন্য সংস্থাটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। সে হিসেবে ২০২৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তার মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। তবে মেয়াদ শেষ হওয়ার এক বছর আগেই তিনি পদত্যাগ করলেন। আইডিআরএ’র চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পাওয়ার পর এম মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। চেয়ারম্যানের ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব পেয়েই ক্ষমতার অপব্যবহার করে অযোগ্য বক্তিকে একটি বিমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিএই) হিসেবে নিয়োগ দেন মোশাররফ হোসেন।

এছাড়া চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পেয়েই ডেল্টা লাইফ নিয়ে বিতর্কে জড়ান তিনি। ২০২০ সালের ৮ ডিসেম্বর ডেল্টা লাইফের পক্ষ থেকে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ করা হয়, আইডিআরএ চেয়ারম্যান এম মোশাররফ হোসেন ৫০ লাখ টাকা ঘুস দাবি করেছে। দুদকে অভিযোগ করার পর ২০২১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি সংবাদ সম্মেলন করেও একই অভিযোগ করা হয়। এই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ডেল্টা লাইফের সাবেক সিইও আদিবা রহমান। ডেল্টা লাইফ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে এমন অভিযোগ করার এক সপ্তাহের মাথায় ১১ ফেব্রুয়ারি কোম্পানিটিতে প্রশাসক নিয়োগ দেয় আইডিআরএ। আইডিআরের সাবেক সদস্য সুলতান-উল-আবেদীন মোল্লাকে প্রথম প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়। চার মাস না যেতেই গত বছরের জুনে তার নিয়োগ বাতিল করে নতুন প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়। দ্বিতীয় প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয় সরকারের সাবেক যুগ্ম সচিব মো. রফিকুল ইসলামকে।

তবে ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে গত বছরের ১০ অক্টোবর প্রশাসক পদ থকে পদত্যাগ করেন মো. রফিকুল ইসলাম। এরপর অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে জীবন বিমায় তৃতীয় প্রশাসক নিয়োগ দেয়া হয়। এ দফায় প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ পান আইডিআরএ’র আরেক সাবেক সদস্য মো. কুদ্দুস খান। ডেল্টা লাইফে এ প্রশাসক নিয়োগ নিয়ে আদালতে মামলা চলমান রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে সম্প্রতি বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ড. মোশাররফ এবং তার স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে ৫টি ব্যাংক একাউন্টে মোট ৩০টি হিসাব পরিচালনার দুর্নীতি ও অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে বলে আদালতে জমা দেয়া প্রতিবেদন উল্লেখ করেছে। এর মধ্যে ১৮টি হিসাবে ২০১৭ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সময়ে জমা হয়েছে প্রায় ৪০ কোটি ৮১ লাখ টাকা।

আদালতে দাখিল করা বিএফআইইউ’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ড. মোশাররফ এবং তার স্ত্রী জান্নাতুল মাওয়া ২০২০ সালের ৭ ডিসেম্বর ‘মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এন্ড কোম্পানি’র নামে নগদ ৫০ লাখ টাকার দু’টি এফডিআর করেন, যার সাথে ড. মোশাররফের ঘুষ গ্রহণের অভিযোগের যোগসূত্র থাকতে পারে বলে সন্দেহ করে বিএফআইইউ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লাভস এন্ড লাইভ অর্গানিকস লি. এবং গুলশান ভ্যালি এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লি. এর বাইরে কাশফুল ডেভেলপার্স লি. নামে আরো একটি প্রতিষ্ঠানের তথ্য পেয়েছে বিএফআইইউ। এখানেও কর্মচারীদের কল্যাণের জন্য গ্রাচুইটি ফান্ড এবং প্রভিডেন্ট ফান্ড গঠন করেন ড. মোশাররফ। পাশাপাশি ফান্ড দু’টি পরিচালনার জন্য ৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করা হয়, যার চেয়ারম্যান হন তিনি নিজে, সেক্রেটারি তার স্ত্রী জান্নাতুল মাওয়া এবং অন্যতম সদস্য ড. মোশাররফের শাশুড়ি লাভলি ইয়াসমিন।

প্রতিবেদনটিতে আরো বলা হয়, ৩টি প্রভিডেন্ট ফান্ড ও ৩টি গ্রাচুইটি ফান্ড অর্থাৎ ৬টি ফান্ডের ব্যাংক হিসাবগুলোতে জমা হওয়া ৩২ দশমিক ৯১ লাখ টাকার মধ্যে ৮ দশমিক ৭৫ কোটি টাকা নগদ উত্তোলন করা হয় এবং ১৬ দশমিক ৮৬ কোটি টাকা ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ লি. বরাবর পে-অর্ডার করা হয়। বাকি ২৩ শতাংশ টাকা বিভিন্ন একাউন্টে ট্রান্সফার এবং ড. মোশাররফের নিজের নামে ৬টি এফডিআর/টিডিআর করা হয়। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, বিএফআইইউ ২০২১ সালের ১৪ অক্টোবর দুর্নীতি দমন কমিশনে এ বিষয়ে একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদন পাঠিয়েছে। দুদকে পাঠানো ওই প্রতিবেদনে ড. মোশাররফের পেশা, অর্থের উৎস ও হিসাব খোলার উদ্দেশ্যের সাথে লেনদেনের ব্যাপক অসামঞ্জস্যতা রয়েছে এবং এ সকল লেনদেনের সাথে ঘুষ ও দুর্নীতির সম্পৃক্ততা থাকতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। একইসঙ্গে প্রতিবেদনটিতে, ব্যাংক হিসাবে ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ লেনদেন, প্রভিডেন্ট/গ্রাচুইটি ফান্ড হিসাবে লেনদেনের মাধ্যমে কর ফাঁকির প্রয়াস গ্রহণ এবং বেনামে ৫০ লাখ টাকার এফডিআর খোলার সময় অর্থের উৎস গোপন, ছদ্মাবৃত্ত বা আড়াল করা এবং এক্ষেত্রে তিনজন ব্যাংক কর্মকর্তার সহায়তা বা পরামর্শ প্রদানের বিষয়ে অনুসন্ধান/তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা পূর্বক প্রযোজ্যক্ষেত্রে সন্দেহভাজন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর আওতায় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করার সুপারিশ করেছে বিএফআইইউ।

এদিকে গত ১ জুন দুদক থেকে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে আইডিআরএ চেয়ারম্যানের কাছে সম্পদের হিসাব চাওয়া হয়েছে। নোটিশ পাওয়ার ২১ কার্যদিবসের মধ্যে তাকে দুদকের কাছে সম্পদ বিবরণী জমা দিতে বলা হয়েছে। এম মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে শেয়ার ব্যবসা করার অভিযোগও রয়েছে। একদিকে তিনি কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) কোটা সুবিধা নিয়ে শেয়ার কেনেন, অন্যদিকে তিনি বিমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রধান হয়েও বিভিন্ন বিমা কোম্পানির শেয়ার কিনেছেন। এমন কিছু কোম্পানির শেয়ারে তার বিনিয়োগ ছিল, যেগুলোর দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ে। এছাড়া আইডিআরএ চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে পুঁজিবাজারে কোটি কোটি টাকা লেনদেন, দুর্নীতি, অর্থপাচারের অভিযোগের ভিত্তিতে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, গত বছর নভেম্বরে দুদক ও বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) কাছে তা জানতে চায় হাই কোর্ট।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ