Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উচ্চবিত্তের হাতে ৯০ শতাংশ সম্পদ

১৯৬০ সালে জিডিপি ৪.৩০ বিলিয়ন ডলার : ২০১৫ সালে ১৯৫.০৮ বিলিয়ন ডলার : ধন বৈষম্য প্রবল : নিম্ন ও মধ্যবিত্তের হাতে মাত্র ১০ শতাংশ

মোবায়েদুর রহমান | প্রকাশের সময় : ২৩ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

সর্বশেষ খবর মোতাবেক, বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। ফলে অর্থনীতির স্বাভাবিক সূত্র অনুযায়ী এক দিকে যেমন কর্মসংস্থান বাড়ছে, অন্যদিকে তেমনি আয়ও বাড়ছে। তত্ত্বগতভাবে এর অবধারিত পরিণতি হিসেবে দেশে শিল্প-বাণিজ্যের প্রসার ঘটার কথা এবং ব্যবসা-বাণিজ্য আরও চাঙ্গা হওয়ার কথা। সেই একই অর্থনীতির সূত্র অনুযায়ী প্রবৃদ্ধির হার যখন ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে, তখন ভোগ্যপণ্যের চাহিদাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাস্তবেও দেখা যাচ্ছে যে, বিশেষ বিশেষ শ্রেণীর মানুষের কেনাকাটা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এগুলো সবই পরিসংখ্যানগতভাবে প্রতিষ্ঠিত।
অর্থনীতির আরও কতগুলো সূচকে ক্রমবর্ধমান প্রবৃদ্ধি দেখা যায়। গত বছর ব্যাংকের আমানত ১৪.০৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৮ লক্ষ ৫৮ হাজার কোটি টাকা। এর আরেকটি অর্থ এই দাঁড়ায় যে, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তরা এবং উচ্চবিত্তদের একটি ভগ্নাংশ অন্য কোথাও বিনিয়োগ করা বিপজ্জনক মনে করে বলে তারা ঝাঁকে ঝাঁকে ব্যাংকে ও সঞ্চয় পত্রে বিনিয়োগ করছে। যারা বিদেশে আছেন তাদের অনেকে স্টক মার্কেটে বিনিয়োগ করে আকর্ষণীয় রিটার্ন পাচ্ছেন। কিন্তু বাংলাদেশে স্টক মার্কেটে ২ বার ভয়াবহ ধস নামার পর নতুন করে সেখানে বিনিয়োগ করতে আর কেউ সাহস পাচ্ছেন না। বরং যাদের কিছু বিনিয়োগ ছিল তাদের সিংহভাগ সেই বিনিয়োগ উঠিয়ে নিচ্ছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান মোতাবেক গত অর্থ বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক সমূহে আমানত বেড়েছে ১৬.৩৬%, বেসরকারি ব্যাংকে ১৩.৭৬% এবং বিদেশী ব্যাংকে ৮.১৯%। অন্যত্র বিনিয়োগের পরিধি এতই সংকুচিত হয়েছে যে সাম্প্রতিক সময়ে আমানতের হার দারুণভাবে কমানো সত্ত্বেও আমানতের পরিমাণ ১৮ শতাংশ বেড়েছে। দেড় বছর আগেও ব্যাংকের স্থায়ী আমানতের সুদের হার ছিল ৯ শতাংশ। সেটি এখন সর্বোচ্চ মেয়াদে ৬ শতাংশ। তারপরেও আমানত বৃদ্ধি পাচ্ছে না।
সঞ্চয় পত্রের বিক্রয় বৃদ্ধি
গত বছর তো বটেই, চলতি অর্থ বছরের প্রথম প্রান্তিকে অর্থাৎ প্রথম ৩ মাসে সঞ্চয় পত্রের বিক্রয় দারুণভাবে বেড়েছে। মাত্র এই ৩ মাসেই সঞ্চয় পত্র বিক্রয় হয়েছে ১১ হাজার ৬৫০ কোটি টাকার। গত বছরের এই সময়ের তুলনায় সেটি ৭৪.৩৭ শতাংশ বেশি। শুধুমাত্র সেপ্টেম্বরেই বিক্রি হয়েছে ৩ হাজার ৮৫৪ কোটি টাকা। দেখা গেছে যে, যারা সঞ্চয় পত্রে বিনিয়োগ করছেন তাদের অধিকাংশই অবসরপ্রাপ্ত সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা ও কর্মচারী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, প্রবাসী বাঙালী প্রমুখ। সঞ্চয় পত্রে সুদের হার স্থায়ী আমানতের চেয়ে অনেক বেশি বলে সকলে এখন সঞ্চয় পত্রের দিকেই ঝুঁকে পড়ছেন। যারা বড়লোক নয়, তারা সঞ্চয় পত্রের মধ্যে ভদ্রভাবে বেঁচে থাকার একটি পথ খুঁজে পেয়েছেন। এদের সংখ্যা বিপুল। সংখ্যার বিপুলতা দেখেই সরকার সম্ভবত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে সঞ্চয় পত্রের সুদের হার আপাতত হ্রাস করা হবে না। এসব বিষয় বিবেচনা করেই সরকারও এখন সঞ্চয় পত্র বিক্রয় লব্ধ আমানত থেকে ঋণ নিচ্ছেন। এই ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৫ হাজার কোটি টাকা। এখন সেটি দ্বিগুণ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
কিন্তু এই প্রবৃদ্ধিতে সর্বশ্রেণীর মানুষের যেরূপ উল্লসিত হওয়ার কথা, বাস্তবে কিন্তু সেটি ঘটছে না। ক্রমবর্ধমান প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি ধনী ও গরীবের ধন বৈষম্য বাড়ছে। একথা ঠিক যে বাংলাদেশে ’৭১ সালের তুলনায় এই ২০১৬ সালে কোটিপতির সংখ্যা শতভাগ নয়, হাজার ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। তাদের সংখ্যা ১০ শতাংশেরও কম। কিন্তু ঐ ১০ শতাংশ ধনিক গোষ্ঠীর হাতে দেশের মোট সম্পদের অন্তত ৯০ শতাংশ পুঞ্জিভূত হচ্ছে। পক্ষান্তরে অবশিষ্ট ৯০ শতাংশ মানুষের হাতে ১০ শতাংশেরও কম সম্পদ থাকছে।
কিন্তু প্রত্যাশিত কর্মসংস্থান হচ্ছে না
বাংলাদেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার বাড়ছে ঠিকই, কিন্তু সেই অনুপাতে কর্মসংস্থান বাড়ছে না। ফলে এই প্রবৃদ্ধি সর্বসাধারণের কাছে প্রত্যাশিত সুফল বয়ে আনছে না। পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় যে, ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। কিন্তু এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হারে বাড়ছে না কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধি। বরং কমছে। ২০১৬ সালে প্রকাশিত এমপ্লয়মেন্ট ডায়াগনস্টিক শীর্ষক পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, ১৯৯৯-২০০০ থেকে ২০০৫-০৬ সময়ে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ৫ দশমিক ৬৩ শতাংশ। একই সময়ে কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধি ছিল ৩ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০০৫-০৬ থেকে ২০১০ সময়ে গড় প্রবৃদ্ধি বেড়ে দাঁড়ায় ৬ দশমিক ১১ শতাংশে। আর এ সময় কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধি ছিল ৩ দশমিক ৩২ শতাংশ। ২০১০ থেকে ২০১৩ সময়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধি আরো বেড়ে হয় ৬ দশমিক ২ শতাংশ। কিন্তু কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধি না বেড়ে বরং কমে যায়। এই রিপোর্টটি প্রকাশ করেছে এশিয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। সহযোগিতা করেছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)।
শিল্পায়ন
সরকারিভাবে বলা হয় যে, প্রত্যাশিত গতিতে শিল্পায়ন হচ্ছে না বলে কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধি আনুপাতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে না। অর্থাৎ শিল্পায়নের গতি মন্থর। কবে শিল্পায়ন গতিবেগ পাবে সেটিও সঠিকভাবে কেউ বলতে পারছেন না। তাই প্রবৃদ্ধির এটি একটি দুর্বল স্থান।
বেসরকারি বিনিয়োগ খুব কম
একথা সর্বজন বিদিত যে প্রবৃদ্ধি বাড়লেও বিনিয়োগ, বিশেষ করে বেসরকারি বিনিয়োগ এখন একেবারেই তুচ্ছ ও নগণ্য। বিশ্ব ব্যাংক ‘দারিদ্র্য ও অসাম্য’ শীর্ষক একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। ঐ রিপোর্ট থেকে দেখা যায় যে, বাংলাদেশে বিনিয়োগ পরিবেশের অভাব রয়েছে। এছাড়া বিদ্যুৎ সংযোগ, সম্পদ রেজিস্ট্রেশন, ঠিকাদারের সঙ্গে সমস্যা মেটাতে অধিক সময় লাগায় ব্যবসা শুরু করতে সময় লাগে। এ পরিবেশের উন্নতি ঘটাতে হবে। না হলে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের হার বৃদ্ধি পাবে না। বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়বে না এবং কর্মসংস্থান না বাড়লে যে উন্নয়ন বা প্রবৃদ্ধি ঘটবে সেটিই হবে এক পেশে। ধন বৈষম্য বাড়ছে
বিভিন্ন জরিপ রিপোর্ট এবং মিডিয়ার খবরে দেখা যায় যে, দেশে বর্তমানে রয়েছে ২ কোটি মানুষ, যাদেরকে বলা হয় হত দরিদ্র। এরা দুই বেলা পেট পুরে খেতে পায় না। আর রয়েছে ৪ কোটি মানুষ, যারা হত দরিদ্র না হলেও তারা বাস করে দারিদ্র্য সীমার নিচে। দেশের মোট সম্পদের ৯০ ভাগ রয়েছে উচ্চবিত্তের দখলে। এদের সংখ্যা ৫৫ লাখ। অবশিষ্ট ১০ ভাগ সম্পদ রয়েছে ১৫ কোটি ৪৫ লাখ লোকের আয়ত্তে। এই পরিসংখ্যান থেকেই বোঝা যায় যে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের ওপরে গেলেও জাতীয় সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে অসাম্য বা বৈষম্য কি প্রবল। বিশ্ব ব্যাংকের রিপোর্ট থেকে দেখা যায় যে, ২০১৫ সালে বাংলাদেশের জিডিপি ছিল ১৯৫.০৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশী টাকায় ১৫ লক্ষ ৬০ হাজার কোটি টাকা। ১৯৬০ সালে বাংলাদেশের জিডিপি ছিল ৪.৩০ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশী টাকায় ৩৪ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এই ১৫ লক্ষ ৬০ হাজার কোটি টাকার ৯০ শতাংশ অর্থাৎ ১৪ লক্ষ ৪ হাজার কোটি টাকা ৫৫ লক্ষ ধনবানদের দখলে। অবশিষ্ট অর্থ অর্থাৎ ১ লক্ষ ৫৬ হাজার কোটি টাকা ৯০ শতাংশ মানুষের আয়ত্তে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জিত হলেও ধন বৈষম্য কত প্রবল সেটি এই পরিসংখ্যানে বোঝা যায়।
Email: [email protected]



 

Show all comments
  • Sourob ২৩ নভেম্বর, ২০১৬, ১১:৩৩ এএম says : 0
    din din doni ra aro doni hosse ar vaki ra kono rokom beche ase
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ