Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মজলুমের পক্ষে আপিল বিভাগের ল্যান্ডমার্ক নির্দেশনা

৫৪ ধারা একটি পৈশাচিক আইন : ফৌজদারি আইন একটি ড্রাকোনিয়ান ল’

মোবায়েদুর রহমান | প্রকাশের সময় : ১৯ নভেম্বর, ২০১৬, ১১:৪৩ পিএম

যারা অভিযুক্ত কিন্তু অভিযোগ প্রমাণিত নয়, তাদের সুরক্ষা এবং ন্যায় বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ যে ১৯ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন সেগুলো যে কোনো বিচারে ল্যান্ডমার্ক ও ঐতিহাসিক। এসব নির্দেশনা দিতে গিয়ে আপিল বিভাগ যেসব মন্তব্য করেছেন এবং পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন সেগুলো প্রশাসনের, বিশেষ করে পুলিশ প্রশাসনের, শৈথিল্য এবং পুলিশী স্বৈরাচারের ভিত কাঁপিয়ে দেয়ার মত। ১৯ দফা সম্বলিত সুপ্রিম কোর্টের এই রায়টির কলেবর ৩৯৬ পৃষ্ঠা। এত বিশাল একটি রায়ের বিস্তারিত বিবরণ হয়ত একদিনে জানা যাবে না। কিন্তু যতই দিন যাবে, ততই দেখা যাবে যে বহুদিন পর সুপ্রিম কোর্ট মজলুম ও নির্যাতিতদের পাশে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের এসব যুগান্তকারী নির্দেশনা ও পর্যবেক্ষণের একটি হলো এই যে, সংবিধানে দেশের নাগরিকগণকে যেসব অধিকার দেয়া হয়েছে সেগুলো থেকে তাদেরকে বঞ্চিত করা দেশের স্বাধীনতা এবং স্বাধীনতার সাথে জড়িত আর সব অধিকার এবং মূল্যবোধকে অস্বীকার করার শামিল। সন্দেহের বশে কোনো ব্যক্তিকে খেয়াল খুশিমত গ্রেফতার করা এবং রিমান্ডে নিয়ে তাকে নির্যাতন করার বিরুদ্ধে পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট এবং বিচারকদের উদ্দেশ্যে ১৯ দফা গাইড লাইন ইস্যু করা হয়।
৫৪ ধারা ১টি পৈশাচিক আইন
সুপ্রিম কোর্টের গাইড লাইনে ফৌজদারি আইনের ৫৪ ধারা সম্পর্কে যে মন্তব্য করা হয়েছে সেটি বিগত ২৫০ বছরে আর কেউ করেনি। বলা হয়েছে যে, এটি একটি পৈশাচিক আইন। এই আইনে কোন ব্যক্তিকে নিছক সন্দেহের বশে গ্রেফতার করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ফৌজদারি আইনের অন্যান্য অনেক বিধিতে আটক ব্যক্তিকে রিমান্ডে নেয়া হয় এবং জীবন ও সম্পত্তির মৌলিক অধিকার পরিপন্থী আটকাদেশ দেয়া হয়। যদি পুলিশ রিপোর্টে বলা হয় যে, উক্ত ব্যক্তিকে নিবর্তনমূলক (চৎবাবহঃরাব) আইনে গ্রেফতার করা হয়েছে, তাহলে এখন থেকে বিচারপতিগণ সেই ব্যক্তিকে আটক রাখার কোন নির্দেশ প্রদান করবেন না। এক্ষেত্রে আটক ব্যক্তি যদি চায় তাহলে তার নির্বাচিত উকিলের সঙ্গে তাকে কথা বলতে দিতে হবে এবং তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের সাথে দেখা করার সুযোগ দিতে হবে। এ ব্যাপারে নির্দেশনায় পরিষ্কার বলা হয়েছে, “আমরা যদি আইনের শাসন এবং জনগণের অধিকারকে অস্বীকার করি তাহলে আমরা অবশ্যই আমাদের দীর্ঘ প্রত্যাশিত স্বাধীনতাকে অস্বীকার করব’’ (“ওভ বি ফবহু ঃযব ৎঁষব ড়ভ ষধি ধহফ ঃযব ৎরমযঃ ড়ভ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব, বি রিষষ ংঁৎবষু ফরংৎবংঢ়বপঃ ড়ঁৎ ষড়হম পযবৎরংযবফ রহফবঢ়বহফবহপব,”)। ঐসব নির্দেশনায় স্পষ্ট করে বলা হয় যে, আমরা যদি জনগণের মৌলিক অধিকার সুনিশ্চিত করতে না পারি এবং যদি পুলিশকে তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার করতে দেয়া হয়, তাহলে এদেশে সাংবিধানিক আইন এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
এসব নির্দেশনার পটভূমি
আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সমূহের ক্ষমতার স্বেচ্ছাচারী অপব্যবহারের বিরুদ্ধে ইতোপূর্বে হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছিলেন, সেই রায়কে বহাল রেখে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ গত মে মাসে তাদের রায় প্রদান করেন। গত ১০ নভেম্বর আপিল বিভাগের ৩৯৬ পৃষ্ঠাব্যাপী পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল প্রদত্ত রায়ের মাধ্যমে হাইকোর্ট বিভাগ ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি আইনের কতিপয় বিধানকে সংশোধনের জন্য সরকারকে বলেন। উল্লেখ্য, ১৯৯৮ সালে তৎকালীন সরকারের আমলে ডিবি পুলিশ ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী এলাকা থেকে ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্র শামীম রেজা রুবেলকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করে এবং ব্যাপক পুলিশী নির্যাতনে পুলিশ হেফাজতেই তার মৃত্যু হয়। রুবেলদের বাসা ছিল শান্তিবাগে এবং আদিনিবাস ছিল ফেনীর দাগনভূঁইয়া উপজেলার বৈঠারপাড়া নামক গ্রামে। এই ঘটনায় বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টসহ কয়েকটি মানবাধিকার সংস্থা হাইকোর্টে রিট আবেদন দায়ের করে। ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল বিচারপতি হামিদুল হকের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় গ্রেফতার এবং রিমান্ড সংক্রান্ত ১৬৭ ধারার বিধান ৬ মাসের মধ্যে সংশোধন করার জন্য দিকনির্দেশনাসহ এক যুগান্তকারী রায় দেন। তৎকালীন সরকার উক্ত রায় বাস্তবায়ন না করে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেন। প্রায় তের বছর পর সুপ্রিম কোর্ট ঐ আপিলটি গ্রহণ করে হাইকোর্ট কর্তৃক প্রদত্ত গাইড লাইনের সাথে কয়েকটি নতুন ধারা সংযোজন করে মামলাটি নিষ্পত্তি করেছেন। গাইড লাইনগুলোর মধ্যে দশটি আছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য আর ৯টি গাইড লাইন আছে ম্যাজিস্ট্রেট ও বিচারকদের জন্য।
একটি ড্রাকোনিয়ান আইন
সুপ্রিম কোর্টের রায় শুধু ভবিষ্যতের জন্যই সুদূর প্রসারী তাৎপর্য বহন করে না, বরং এই রায় অতীতের ঘাটতি সমূহও সঠিকভাবে তুলে ধরেছে। ঐ রায়ে বলা হয় যে, নিজেদের ক্ষমতা সংহত করার জন্য ব্রিটিশ উপনিবেশবাদী শাসক গোষ্ঠী ফৌজদারি আইন জারি করেছিল। পুলিশী ক্ষমতার অপব্যবহার করে তারা তাদের শাসন সংহত করে। সেই সময় দেশে কোনো সংবিধান ছিল না এবং জনগণের মৌলিক অধিকার ছিল একটি অলীক কল্পনা। একটি উপনিবেশবাদী শক্তিকে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে এবং অপর উপনিবেশবাদী শক্তিকে ৩০ লক্ষ শহীদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে অপসারণের পর আমরা কোনো অপরাধীকে একটি ড্রাকোনিয়ান আইন দ্বারা আটক এবং তার বিরুদ্ধে মামলা করতে পারি না। সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ে আরও বলা হয়, যে উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য সেদিন ফৌজদারি আইন প্রণীত হয়েছিল সেইসব উদ্দেশ্য এখন আর নাই। আরও বলা হয় যে, ৫৪ ও ১৬৭ ধারার কতিপয় উপধারা এবং ফৌজদারি আইনের ৩টি অধ্যায় সংবিধানের সাথে এবং মাজদার হোসেন মামলার রায়ের সাথে অসংগতিপূর্ণ। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, মাজদার হোসেন মামলার রায় বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ রায় হিসাবে খ্যাত। এগুলোর মধ্যে রয়েছে তদন্ত এবং বিচারে ক্রিমিনাল কোর্টের আওতা এবং ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে অভিযোগ দায়ের এবং আপিল প্রভৃতি।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব
সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে কঠোর ভাষায় সতর্ক করা হয়েছে। বলা হয়েছে, কোন পুলিশ অফিসার নিজের খেয়াল খুশিমত কোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতার করতে পারবেন না। শুধু একথা বলাই যথেষ্ট নয় যে, অভিযুক্ত ব্যক্তি একটি বিচার্য অপরাধে জড়িত রয়েছেন বলে তার কাছে খবর আছে। তার কাছে যে নালিশ আসবে সেটির তদন্ত করার পরে যে তথ্য পাওয়া যাবে সেই তথ্যের ভিত্তিতেই তিনি তার গ্রেফতারের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন।
কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশাবলী
এই ১৯ দফা ইতোপূর্বে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। আমরা তার পুনরাবৃত্তি করতে যাচ্ছি না। আমরা শুধুমাত্র কয়েকটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা নিচে উল্লেখ করছি।
(১) গ্রেফতারের নথি প্রস্তুত করতে হবে এবং সেই নথিতে আটক ব্যক্তির স্বাক্ষর থাকতে হবে।
(২) আটক ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ আত্মীয়কে ১২ ঘণ্টার মধ্যেই খবর দিতে হবে।
(৩) যদি দাবি করা হয় তাহলে যে অফিসার গ্রেফতার করবেন তাকে তার পরিচয়পত্র দেখাতে হবে।
(৪) আটক ব্যক্তিকে আইনজীবীর সাথে পরামর্শ করা এবং ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের সাথে দেখা করার সুযোগ দিতে হবে।
(৫) আটক ব্যক্তিকে আদালতে হাজির করার সময় যদি আটকের নথি উপস্থাপন করা না হয়, তাহলে মুক্তি দিতে হবে।
(৬) নতুন মামলার কপি ছাড়া কোনো ব্যক্তিকে নতুন মামলায় গ্রেফতার দেখানো যাবে না।
(৭) কোনো পুলিশ অফিসার বেআইনিভাবে গ্রেফতার করলে সেই অফিসারের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
(৮) নিবর্তনমূলক কারণে কাউকে গ্রেফতার করলে তাকে আটক রাখার কোনো নির্দেশ দেয়া যাবে না।



 

Show all comments
  • মাহমুদা ২০ নভেম্বর, ২০১৬, ১:৫০ এএম says : 0
    আশা করি এই নির্দেশনাগুলো এখন মেনে চলা হবে।
    Total Reply(0) Reply
  • Tania Nawshaba ২০ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:১৪ পিএম says : 0
    সুপ্রিম কোর্ট মজলুম ও নির্যাতিতদের পাশে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছে।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ