Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ফুড সাপ্লিমেন্টের রমরমা ব্যবসা

হাসান সোহেল | প্রকাশের সময় : ১৯ নভেম্বর, ২০১৬, ১১:২৩ পিএম


নীতিমালা নেই, চিকিৎসকরা ব্যবস্থাপত্রে লিখছেন, ফার্মেসিতেও অবাধে বিক্রি হচ্ছে

দেশের ওষুধ যখন সুনামের সাথে বিশ্ব বাজারে স্থান করে নিচ্ছে। ঠিক তখনই ফুড সাপ্লিমেন্টের নামে দেশের বাইরে থেকে আনা মানহীন ওষুধ বাড়াচ্ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। রাজধানীসহ সারা দেশে ওষুধের ফার্মেসিগুলোতে এসব ভেজাল ও নিম্নমানের ভিটামিন ও ফুড সাপ্লিমেন্টের রমরমা ব্যবসা চলছেই। এক শ্রেণির চিকিৎসককে প্রভাবিত করে রোগীদের প্রেসক্রিপশনে লিখিয়ে নেয়া হচ্ছে এগুলো। কিছু কিছু কোম্পানি ওষুধ প্রশাসনের দেওয়া বৈধ লাইসেন্সের আড়ালে নামে-বেনামে অবৈধ ওষুধ ও ফুড সাপ্লিমেন্ট উৎপাদন ও বাজারজাত করে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য করছে। এসব ফুড সাপ্লিমেন্ট ক্রয় করে চিকিৎসা সেবার নামে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছে মানুষ। ভেজাল ও নিম্নমানের এসব ফুড সাপ্লিমেন্ট বিক্রি বন্ধ করতে দুই বছর পূর্বে উদ্যোগ নেয় ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর। তদারকি প্রতিষ্ঠানটি ব্যবস্থাপত্রে ফুড সাপ্লিমেন্ট না লেখার জন্য চিকিৎসকদের বিভিন্ন সংগঠনের কাছে চিঠি দেয়। কিন্তু দুই বছর অতিবাহিত হলেও এ নির্দেশ কোন কাজে আসেনি। স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয় বিভিন্ন সময়ে এটা বন্ধে উদ্যেগ নিলেও তা আলোচনা পর্যায়েই শেষ হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিক্রয় নীতিমালা না থাকলেও চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রে ঠিকই জায়গা করে নিচ্ছে নিউট্রিশনাল সাপ্লিমেন্ট বা ফুড সাপ্লিমেন্ট। যদিও এর বেশিরভাগই নিম্নমানের। এতে প্রতিদিনই স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে সাধারণ মানুষ। আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে হৃদরোগ, লিভার, কিডনিজনিত ও ক্যান্সারের মতো রোগের।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব প্রফেসর ডা. ইকবাল আর্সলান বলেন, দুষ্কৃতকারী ও লোভী কিছু চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্রে ফুড সাপ্লিমেন্ট লিখছেন। এরা দেশ ও জাতির শত্রু। এদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হবে। এজন্য বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল আইন সংশোধনের উদ্যেগ নেয়া হয়েছে। এসব চিকিৎসককে চিহ্নিত করতে প্রতিটি হাসপাতালে তদারকি কমিটি গঠনের চিন্তা করছেন বলে উল্লেখ করেন তিনি।
সরেজমিনে বিভিন্ন ফার্মেসি ঘুরে দেখা যায়, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন ওষুধের দোকানে বিক্রি হচ্ছে ফুড সাপ্লিমেন্ট। চিকিৎসকরাও এখনো ব্যবস্থাপত্রে এসব লিখে যাচ্ছেন। এমনকি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা অনেক রোগীকে ওষুধের পাশাপাশি ফুড সাপ্লিমেন্ট দেয়া হচ্ছে। ক্রেতাদের মতে, চিকিৎসকরা ব্যবস্থাপত্রে লিখছেন তাই ক্রয় করতে হচ্ছে। তবে ভেজাল ও নিম্নমানের ফুড সাপ্লিমেন্ট যাতে চিকিৎসকরা ব্যবস্থাপত্রে না লিখতে পারেন সে ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপের দাবি তাদের।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানীর ওষুধের দোকানগুলোয় ফুড সাপ্লিমেন্ট হিসেবে ভিটামিন ‘এ’, ‘বি’ ‘সি’, ‘ডি’, ‘ই’সহ মাল্টিভিটামিন বিক্রি হচ্ছে। বিভিন্ন জিংক, ফাইবার ও মিনারেল পাউডারও বিক্রি হচ্ছে ফুড সাপ্লিমেন্ট হিসেবে। চিনির বিকল্প হিসেবেও পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন ধরনের সুগার পাউডার।
সূত্র মতে, বিদেশ থেকে বিভিন্ন ধরনের ভেজাল ও নিম্নমানের ফুড সাপ্লিমেন্ট আমদানি করা হচ্ছে। অথচ সেগুলোই চকচকে মোড়কে ওষুধ হিসেবে নানা নামে বিক্রি করা হয় দেশের বাজারে। এগুলোর বেশিরভাগেরই গুণগতমান নিয়ে রয়েছে অভিযোগ। ওষুধ সেবনের পর রোগীর সমস্যা দেখা দেয়ার ঘটনাও ঘটছে। যদিও এতো ফুড সাপ্লিমেন্টের প্রয়োজনীয়তা আসলেই আছে কি না তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে খোদ চিকিৎসকদেরই।
বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির সাবেক এক নেতা জানান, বাজারে হাতেগোনা পাঁচ-ছয়জন আমদানিকারক রয়েছে, যারা উন্নত দেশ থেকে ফুড সাপ্লিমেন্ট এনে বাজারজাত করছেন। তবে দেশের ভেতরে দেড় থেেেক দুই শতাধিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এরা বিদেশী ফুড সাপ্লিমেন্টের কৌটায় ভরে তা চড়া দামে বিক্রি করছেন। এতে সাধারণ জনগণ শারীরিক ও আর্থিক উভয়ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।  
ওষুধ প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, ব্যবস্থাপত্রে ফুড সাপ্লিমেন্ট না লেখার জন্য ২০১৪ সালের অক্টোবরে চিকিৎসকদের বিভিন্ন সংগঠনের কাছে চিঠি দেয় তারা। লক্ষ্য ছিল ভেজাল ও নিম্নমানের এসব ফুড সাপ্লিমেন্ট বিক্রি বন্ধ করা। কিন্তু এর পরও দেশের বিভিন্ন ওষুধের দোকানে বিক্রি হচ্ছে ফুড সাপ্লিমেন্ট। যার বেশিরভাগই চীন থেকে এনে বিক্রি করা হচ্ছে।
ওষুধ প্রশাসনের একজন পরিচালক জানান, চিকিৎসকরা শুধু ওষুধ প্রেসক্রাইব করবেন। তাদের প্রেসক্রিপশনে ফুড সাপ্লিমেন্ট প্রেসক্রাইব করার নিয়ম নেই। ফার্মেসিতেও এসব ফুড সাপ্লিমেন্ট বিক্রির ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ রয়েছে। কিন্তু কার্যকর কোনো তদারকির ব্যবস্থা না থাকায় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন ফার্মেসিতে অবাধে বিক্রি হচ্ছে এসব। ওষুধ প্রশাসন দাবি করে ফুড সাপ্লিমেন্টের বিষয়টি তদারকির এখতিয়ার তাদের নয়। এটি দেখবে স্বাস্থ্য অধিদফতর কিংবা সিভিল সার্জন অফিস। কিন্তু মাঠপর্যায়ে আসলে কোনো তদারকির ব্যবস্থাই নেই। বিএসটিআইয়ের বাধ্যতামূলক পণ্যের তালিকায় না থাকায় এগুলোর ক্ষেত্রে বিএসটিআইয়েরও কর্তৃত্ব নির্ধারণ করা যাচ্ছে না।  
শরীর দুর্বল মনে হওয়া এবং হাত-পা ব্যথার কারণে সৈয়দ আলী নামের এক রোগী সম্প্রতি দেশের বৃহত্তর চিকিৎসা সেবা প্রতিষ্ঠান ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসার জন্য আসেন। চিকিৎসককে দেখিয়ে ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী ওসুধ নেন। ব্যবস্থাপত্রে একটি ফুড সাপ্লিমেন্টও ছিলো বলে জানান তিনি। তিনি জানান, বাসায় গিয়ে ওষুধের প্যাকেট খুলে দেখা গেলো- ফুড সাপ্লিমেন্টটির মেয়াদ আছে, অথচ নষ্ট হয়ে গেছে ভেতরের ওষুধ। বাসা দুরে হওয়ায় এটা পরিবর্তনের জন্যও আসেননি তিনি। অথচ এই ফুড সাপ্লিমেন্ট যে অননুমোদিত তা জানতেন না সৈয়দ আলী।
শুধু সৈয়দ আলী নন সম্প্রতি পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের বহির্বিভাগে চর্ম রোগের চিকিৎসা নিতে যান নারায়ণগঞ্জের ভুঁইগড় এলাকার বাসিন্দা কিশোর আজিম। চিকিৎসক তার ব্যবস্থাপত্রে চারটি ওষুধের নাম লিখে দেন। যদিও এর মধ্যে দুটিই ছিল ফুড সাপ্লিমেন্ট। শুধু আজিম নন, আরো অনেক রোগীর ব্যবস্থাপত্রে ওষুধের পাশাপাশি ফুড সাপ্লিমেন্টের নাম লিখে দেন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক। মিটফোর্ড হাসপাতাল-সংলগ্ন একটি ওষুধের দোকানে ঘণ্টাখানেক অবস্থান করে অনেক রোগীকে ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী ফুড সাপ্লিমেন্ট কিনতে দেখা যায়।
মিটফোর্ড এলাকার ওষুধ বিক্রেতা আরিফুর রহমান জানান, হাসপাতালের বহির্বিভাগে আসা অধিকাংশ রোগীর ব্যবস্থাপত্রে চিকিৎসকদের পছন্দের কোম্পানির ফুড সাপ্লিমেন্ট লেখা থাকে। রোগীর লোকজন তা কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। একটি কৌটা লিখে চিকিৎসক ১০০ থেকে ২০০ টাকা এবং দোকানিরাও প্রায় সমপরিমাণ টাকা পাচ্ছেন। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে রোগী বলে জানান তিনি।
এদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণারয়ও বিষয়টিতে একবারে নিরব। গত বছরের ১০ মে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সভাপতিত্বে ওষুধ শিল্পের উন্নয়ন বিষয়ে এক সভায় চিকিৎসকরা ব্যবস্থাপত্রে যাতে ফুড সাপ্লিমন্ট না লেখেন, সে লক্ষ্যে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ), বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি), বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল প্র্যাকটিশনার্স অ্যাসোসিয়েশন ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের সঙ্গে আলোচনা করার কথা বলা হয়। কিন্তু পরে বিষয়টি আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ থেকেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তিবিদ্যা অনুষদের সহযোগী অধ্যাপক ড. লুৎফল কবির ইনকিলাবকে বলেন, মাছ, মাংস, ডিম, শাক-সবজি ও ফলমূলসহ পুষ্টিকর খাবার খেলে এসব ফুড সাপ্লিমেন্টের কোন প্রয়োজন পড়ে না। চিকিৎসকরা ব্যবস্থাপত্রে এগুলো লিখে রোগীদের সাথে প্রতারণা করছেন।
ওষুধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ ১৯৮২-এর ১৪ (এ) (১) উপ-ধারায় বলা আছে, রেজিস্ট্রিবিহীন ওষুধ রোগীর ব্যবস্থাপত্রে কোনো চিকিৎসক লিখতে পারবেন না। তা সত্ত্বেও ফুড সাপ্লিমেন্ট লেখা হচ্ছে। এ বিষয়ে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের পরিচালক রুহুল আমিন বলেন, ফুড সাপ্লিমেন্ট বিক্রি বন্ধে তারা কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছেন। তারা চিকিৎসা-সংক্রান্ত সব সংস্থাকে কয়েক দফা চিঠিও দিয়েছেন। এসব লেখা বন্ধ করতে হলে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে বলে উল্লেখ করেন।















                                        

























































































































 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ