Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

যেখানে অভিযান সেখানেই ভেজালের কারবার

চট্টগ্রামে মারাত্মক হুমকিতে জনস্বাস্থ্য

রফিকুল ইসলাম সেলিম | প্রকাশের সময় : ১৯ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:৩৫ পিএম

অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে রান্না-বান্না, খাবারে মেশানো হচ্ছে ক্ষতিকর রঙ আর ফ্লেভার। পচাবাসি খাবার বিক্রি হচ্ছে সর্বত্রই। চট্টগ্রামের অভিজাত রেস্তোরাঁ থেকে শুরু করে ফুটপাতের খাবারের দোকানগুলোর চিত্র এখন এমন। খাদ্যদ্রব্যের পাশাপাশি জীবন রক্ষাকারী ওষুধেও ভেজাল। ভেজাল কারখানায় তৈরি ওষুধের সমান্তরালে ফার্মেসিগুলোতে মিলছে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধও। ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতেও চলছে জাল-জালিয়াতি। মেয়াদোত্তীর্ণ উপাদানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে সেখানে।
চট্টগ্রামের যেখানে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান সেখানে মিলছে এসব ভেজালের কারবার। অভিযানে জরিমানা আর খাওয়ার অযোগ্য খাদ্যদ্রব্য ধ্বংস করেও ভেজালকারীদের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। আর এতে করে মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে জনস্বাস্থ্য।
ভেজাল খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ করে অসুখ-বিসুখে আক্রান্ত হচ্ছে ভোক্তারা। অসুখ সারাতে গিয়েও ভেজালের কবলে পড়ছে তারা। ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ভুল রিপোর্ট আর ভেজাল ওষুধে বিপন্ন হচ্ছে মানুষের জীবন। কোথায় নেই ভেজালÑ গত কয়েকদিনের অভিযানে ভ্রাম্যমাণ আদালত যেখানে হাত দিয়েছে সেখানে পেয়েছে ভেজালের মিশ্রণ। মহানগরীর অভিজাত রেস্তোরাঁ হ্যান্ডির রান্নাঘরে গিয়ে চরম অপরিচ্ছন্ন, নোংরা পরিবেশে রান্না-বান্না করার দৃশ্য দেখতে পায় ভ্রাম্যমাণ আদালত।
একই চিত্র দেখা গেছে নগরীর অপর একটি রেস্তোরাঁ জামান হোটেলে। এসব রেস্তোরাঁয় খাওয়ার জন্য ভোজনরসিকদের পাশাপাশি সাধারণ ক্রেতারাও হুমড়ি খেয়ে পড়ে। অনেকে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থেকে পরিবার-পরিজন নিয়ে এসব রেস্তোরাঁয় খাবার গ্রহণ করে।
সাধারণ মানের হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোর অবস্থা আরও ভয়াবহ। পচা মাছ, গোশত রান্না হচ্ছে রেস্তোরাঁয়। মেশানো হচ্ছে ক্ষতিকারক রঙ ও উপকরণ। অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে রান্না-বান্না এবং খাওয়া পরিবেশন করা হয়। কোন কোন হোটেলে রান্নাঘরেই হোটেল কর্মীদের গোসল করতে দেখা যায়। রান্নার চুলার পাশেই রয়েছে টয়লেট। সম্প্রতি নগরীর বেশ কয়েকটি হোটেলে অভিযান চালিয়ে চরম অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ প্রত্যক্ষ করে ভ্রাম্যমাণ আদালত।
মহানগরীর বিশাল একটি জনগোষ্ঠী নিয়মিত এসব হোটেল-রেস্তোরাঁয় খাবার গ্রহণ করে। রেস্তোরাঁর পাশাপাশি বেকারী সামগ্রীতেও ভেজাল এবং মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর উপাদান ব্যবহার করা হচ্ছে। পচা ডিমে তৈরি হচ্ছে কেক। নিম্নমানের ডালডার সাথে চিনি মিশিয়ে তৈরি হয় বাটার। নোংরা এবং অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে তৈরি হয় বেকারী সামগ্রী। গত সপ্তাহে কিষোয়ান স্ন্যাকস ও ফ্যাশন ফুডসহ বেশ কয়েকটি বেকারীকে জরিমানা করে ভ্রাম্যমাণ আদালত।
মহানগরীর প্রায় প্রতিটি মিষ্টির কারখানায় গিয়ে ভেজালের মিশ্রণ, নোংরা ও অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে মিষ্টি তৈরির প্রমাণ পেয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। গত কয়েক মাসে নগরীর প্রায় প্রতিটি মিষ্টি কারখানাকে জরিমানা করেছে আদালত। সর্বশেষ নগরীর লালখান বাজারে অভিজাত হাইওয়ে সুইটস মিষ্টির কারখানায় গিয়ে মিষ্টির সিরায় ব্যাপকহারে মরা মশা-মাছি ভাসতে দেখে ভ্রাম্যমাণ আদালত। ওই কারখানাকে জরিমানা করা হয়। প্রায় প্রতিটি মিষ্টির কারখানায় অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে তৈরি হয় মিষ্টি। ব্যবহার করা হয় মেয়াদোত্তীর্ণ কিংবা নিম্নমানের উপকরণ।  
ফলের বাজারেও চলছে চরম নৈরাজ্য। ক্ষতিকর রাসায়নিক দিয়ে পাকানো হচ্ছে ফল। আপেল, আঙুর, নাসপতির মতো ফলে মেশানো হচ্ছে ফরমালিন। কলা ও পেঁপে পাকানো হচ্ছে ক্ষতিকর রাসায়নিক দিয়ে। মাছের বাজারেও ভেজালের কারবার থেমে নেই। ফরমালিন মিশিয়ে মাছ তাজা রাখা হচ্ছে। সম্প্রতি নগরীর হাটবাজারগুলোতে পাওয়া যাচ্ছে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর জেলি মিশ্রিত চিংড়ি মাছ। ওজন বাড়াতে বড় বড় চিংড়ি মাছের মাথা এবং শরীরের ভেতর এসব জেলি ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে। নগরীর কয়েকটি বাজার থেকে এ ধরনের চিংড়ি মাছ জব্দ করে ধ্বংস করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত।
শিশু খাদ্যে ভেজালের মিশ্রণ যেন একটু বেশি। যেখানে-সেখানে গড়ে উঠা কারখানায় তৈরি হচ্ছে চিপস, আচার, চকলেট। চটকদার রঙিন প্যাকেটে মুড়িয়ে বিক্রি হচ্ছে এসব খাবার। নগরীর প্রতিটি দোকানে এসব প্যাকেটজাত খাবার দেখা যায়। বিশেষ করে স্কুলের সামনে হকারদের পসরায় থাকে এ ধরনের খাবার। মানহীন প্রতিষ্ঠানেই তৈরি এসব খাবার খেয়ে শিশুরা নানান রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। আইসক্রিমেও ভেজাল এবং মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক উপাদান মেশানোর প্রমাণ মিলছে। গত সপ্তাহে দেশের নামকরা আইসক্রিম কোয়ালিটির কারখানা থেকে মেয়াদোত্তীর্ণ বিপুল পরিমাণ উপকরণ জব্দ করেছে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। ওই কারখানাটিকে ১০ লাখ টাকা জরিমানাও করা হয়। নামকরা আইসক্রিম কোম্পানীগুলোর পাশাপাশি মহানগরীর বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠা কারখানাতেও নিম্নমানের আইসক্রিম তৈরি হচ্ছে।
খাদ্য উপকরণের পাশাপাশি জীবন রক্ষাকারী পানিতেও ভেজাল রয়েছে। নগরীর যত্রতত্র গড়ে উঠা কারখানায় মিনারেল ওয়াটারের নামে সরাসরি ওয়াসা কিংবা টিউবওয়েলের পানি বোতলজাত করা হচ্ছে। কোনরকম সরকারি অনুমোদন কিংবা বিএসটিআইয়ের সনদ ছাড়াই এসব পানি উৎপাদন ও বাজারজাত করা হচ্ছে। পানির অপর নাম জীবন অথচ এসব ভেজাল পানি পান করে মানুষের জীবন হুমকির মুখে পড়ছে। একই অবস্থা লবণেও। সাধারণ লবণকে আয়োডিনযুক্ত লবণ হিসেবে প্যাকেটজাত করে বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে।
ওষুধেও এখন ভেজাল। দেশের বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠা ভেজাল ওষুধের কারখানায় তৈরি ওষুধ দেদারছে বিক্রি হচ্ছে মহানগরীর বিভিন্ন ফার্মেসিতে। মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধও বিক্রি করছে ফার্মেসি মালিকেরা। ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে নকল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ উদ্ধার করা হচ্ছে। সরকারি হাসপাতালের বিনামূল্যের ওষুধ এবং আমদানি নিষিদ্ধ বিদেশি ওষুধও মিলছে ফার্মেসিগুলোতে।
নগরীর ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে ভুল রিপোর্ট দেয়া হয় এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সীল ব্যবহার করে সেন্টারের কর্মীরাই তাদের পছন্দমতো রিপোর্ট লিখে দিচ্ছে। সম্প্রতি এসব রোগ নিরূপণী কেন্দ্রগুলোতে ব্যবহৃত উপকরণেও ভেজাল এবং মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার প্রমাণ পেয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত।
মেয়াদোত্তীর্ণ রাসায়নিক পদার্থ রিয়াজেন্ট দিয়ে রক্তসহ বিভিন্ন পরীক্ষার অভিযোগে বৃহস্পতিবার ৩টি ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে সাড়ে ৪ লাখ টাকা জরিমানা করে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো হচ্ছে মহাজন ঘাটার জনতা ডায়াগনস্টিক, হলি কেয়ার নার্সিং হোম এন্ড ডায়াগনস্টিক এবং বন্দর ল্যাব ডায়াগনস্টিক কমপ্লেক্স।
মহানগরীতে এসব ভেজালের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসন, র‌্যাব ও পুলিশের ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চলছে। একসময় শুধুমাত্র রোজায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চলতো। এখন বছরের প্রায় পুরো সময়জুড়ে অভিযান চলছে। যেখানে অভিযান চলছে সেখানেই মিলছে ভেজাল আর জাল-জালিয়াতির প্রমাণ। অভিযানেও এসব জালিয়াতি কমছে না।
কয়েকটি হোটেল-রেস্তোরাঁ ও বেকারীকে কম সময়ের ব্যবধানে দ্বিতীয় দফা অভিযান চালিয়ে আগের চিত্রই দেখতে পেয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। এতে বুঝা যায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে জেল-জরিমানার পরও পরিবেশের কোন উন্নতি হচ্ছে না। ফলে খাদ্যের মানও বাড়ছে না। ক্রেতা স্বার্থ সংরক্ষণ কমিটির নেতারা বলছেন, শুধুমাত্র ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান দিয়ে এসব ভেজালকারীদের লাগাম টেনে ধরে রাখা যাবে না। এজন্য দরকার যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিয়মিত তদারকি। তবে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে জনসচেতনতা বাড়ছে। অনেকে এসব ভেজাল পণ্য এড়িয়ে চলছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ