Inqilab Logo

শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

বাহের দ্যাশত রাত পোহায় না!

স্টালিন সরকার (রংপুর থেকে ফিরে) : | প্রকাশের সময় : ১৯ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

 ‘পথে এবার নামো সাথী/ পথেই হবে পথ চেনা...’ (সলিল চৌধুরী)। না, পরিচিত পথ অথচ মনে হয় অচেনা। বাহের দ্যাশ রংপুরের মাহিগঞ্জ থেকে পীরগাছা যাওয়ার এই পথের দু’ধারে ৫ বছর আগেও ছিল ধানক্ষেত-ডোবা-নালা, এখন গাছগাছালি বাড়িঘর। জনসংখ্যার চাপে প্রকৃতি হারিয়েছে ছন্দ। যে পথে ছিল মাইলের পর মাইল সুনসান নীরবতা; সে পথের ধারে শত শত বাড়িঘর। ভূতের ভয়ে দিনে গেলেও গা ছম ছম করতো সেখানে দিব্যি বাড়িঘর তুলে বসবাস করছে মানুষ।
পথ তো অনেক আছে। নগর, জনপদ, গ্রাম-নগরে বিস্তর পথ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। সেসব পথ ধরে কোনো জাগতিক কাজের ব্যস্ততা না থাকলে দিব্যি ঘুরে বেড়ানো যায়। পথে পথে ঘুরে বেড়ানো এক আনন্দের ব্যাপার, যদি না থাকে মানুষের মনে আতঙ্ক-উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। তার কি জো আছে! এই পথ চিনতে নেমে পথকে তো চেনা হয়ই; সেই সঙ্গে চেনা হয় পথচারীদের। নানা মতের, নানা বর্ণের পথচারী, চেনা হয় পথের দু’ধারের বাড়িঘর, উদ্যান-বৃক্ষরাজি, সান বাঁধানো পুকুর। অপরিচিত পথচারীদের সঙ্গে কথা বললে বোঝা যায় তাদের যাপিত জীবন, সংস্কৃতি-কৃষ্টি-কালচার। নিজের মধ্যে ডুবে থাকা গ্রামের সেই মানুষকে টিকে থাকতে কত বিচিত্র কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়! গণতন্ত্রের নামে ‘মসনদ দখলের লোভাতুর রাজনীতি’ গ্রামীণ জনপদের মানুষকে কত অসহায় করে ফেলেছে। হাবাগোবা, সহজ-সরল, ঝামেলা মুক্ত থাকতে অভ্যস্ত বাহের দ্যাশ রংপুরের ‘মফিজ’দের কতই না দুর্বিষহ জীবন যাপন করতে হচ্ছে। হায় আল্লাহ! হাসতে ভুলে গেছে মানুষ; তারপরও জোর করে হাসার চেষ্টা! ভাল নেই তারপরও ভাল আছি প্রমাণের প্রাণান্তকর চেষ্টা! রাজনীতির বিভাজনে পুরছে মানুষের কপাল। স্বপ্ন ভেঙ্গে খান খান। তবুও গ্রামের মানুষের বেঁচে থাকার আকুতি! দেশের গ্রাম-গঞ্জে গেলে বোঝা যায় তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে রাজধানী ঢাকার সুবিধাভোগী শিক্ষিত মানুষগুলো থাকেন কত অন্ধকারে। আয়নায় নিজ দেশের চিত্র দেখেন তারা উল্টো পিঠ। দেশের প্রকৃত চিত্র থেকে রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকরা যোজন যোজন মাইল দূরে। পত্রিকা, রেডিও, টিভি, অনলাইন মিডিয়ার বিপ্লবের পরও মনে হয় ঢাকা যেন কোনো ‘বদ্ধদ্বীপ’। ২৪ ঘণ্টা মিডিয়ার নখদর্পনে থেকেও রাষ্ট্রের প্রকৃত চিত্র এদের থেকে যাচ্ছে অজানাই।
রংপুর শহরের ঢাকা বাসস্ট্যান্ড কামারপাড়ায় নামতেই কানে ভেসে এলো আজানের ধ্বনি। ফজরের আজান। কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়ে গেছে বিভাগীয় শহর রংপুর। এরশাদ মোড়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ব্যাটারীর রিকশায় উঠে মাহিগঞ্জের সাতমাথা মোড়। সাতসকালেই বাড়ি থেকে ফোন এলো মোটরসাইকেল নিতে আসবে। এতো সকালে ২৮ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আসা! জানিয়ে দিলাম ঘণ্টাখানের পর রওয়ানা দাও; আমি কিছুপথ পায়ে হেঁটে যাব, পথেই হবে দেখা। গ্রামের পাকা রাস্তায় তখনো গাড়ি নামেনি; চায়ের দোকানপাটও খোলেনি। মাহিগঞ্জ থেকে সোজা পূর্বদিকে জন্মসূত্রে পাওয়া পায়ে হেঁটেই রওয়ানা হলাম। আধাঘণ্টা হাটার পর ফর্সা হয়ে এলো পৃথিবী। আহা কি সুন্দর দৃশ্য! শিল্পীর তুলিতে কাগজে আঁকা গ্রামীণ জনপদের কোন ছবি নয়। বাস্তব দৃশ্য। পথের অনতিদূরে মাঠ-প্রান্তরের পর প্রান্তর চোখ ধাঁধানো সোনালী ধান ক্ষেত। সবুজের মাঝে সোনালী ধানের বর্ণিল সৌন্দর্যের দৃশ্যে চোখে জুড়িয়ে যায়। বিভিন্ন জাতের পাকা ধানে পরিপূর্ণ কৃষিজমি। কোথাও সোনালী রঙে রাঙানো ধান কেটে জমিতেই বিছিয়ে দেয়া হয়েছে শুকানোর জন্য। মাঝে মাঝে ভিন্ন জাতের কালো, খয়েরিসহ নানা রঙের পাকা ধানে টইটম্বুর ক্ষেত। পিঠা খাওয়ার জন্য এক জাত। আবার মুড়ি ভাঁজার জাত কালো রঙের। সারাবছরের খোরাকি ‘ভাত’ খাওয়ার আরেক জাত। এসব বিভিন্ন রঙের ধানের ক্ষেতে এক বর্ণিল দৃশ্য দেখতে দেখতে এগোতেই মনের অজান্তে ‘গ্রাম ছাড়া ওই রাঙা মাঠের পথ/ আমার মন ভুলায় রে’ গুণগুনিয়ে গাইতে শুরু করলাম। মাহিগঞ্জ পাড় হয়ে দু’কিলোমিটার এগিয়েছি; হঠাৎ সম্বিত ফিরলো কানে এলো স্থানীয় এমপির ভাষণের ধ্বনি। কোথায় ভাষণ দিচ্ছেন এমপি এতো সাত-সকালে? না সভা-সমাবেশ নয়; রাস্তার পাশে চায়ের দোকানে মেবাইলে বাঁজছে সে ভাষণ। হেমন্তের সকালে কুয়াশা ভেজা পথের ধারে চা খেতে বসে উদ্ধার হলো মোবাইলে স্থানীয় এমপির ভাসনের মাজেজা। মেবাইলের মালিক আনোয়ার হোসেন জানালেন, তারা হামলা-মামলা-চাঁদাবাজি থেকে বাঁচতে ‘হঠাৎ আওয়ামী লীগ’ হয়ে গেছেন। আওয়ামী লীগ না করলে পদে পদে বিপদ। তাই তিনি শুধু নন; রংপুরের গ্রামগঞ্জের অধিকাংশ মানুষ নিজেদের আওয়ামী লীগার প্রমাণে মরিয়া হয়ে উঠেছে। আমি ‘আওয়ামী লীগ’ প্রমাণের জন্যই বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সমাবেশের বক্তৃতা ও স্থানীয় এমপির ভাষণ মোবাইলে রেকর্ড করে রাখেন। পথে প্রান্তরে চলতে ফিরতে হাটে বাজারে বিপদ এড়াতে নিজেদের ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের ‘আমরা তোমাদের লোক’ বোঝাতেই মোবাইলের ওই সব ভাষণ বাজান। পরে রংপুর শহর, কাউনিয়া ও পীরগাছা উপজেলার কয়েকটি হাটে এবং বাসযাত্রী সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বললে একই চিত্র পাওয়া যায়। আহা! রাজনীতির ঝঞ্ঝাট থেকে বাঁচতে নিরীহ মানুষের কতই না কৌশল!
পীরগাছার পাওটানা হাটে চোখে পড়লো অসংখ্য তোরণ ও গেইট। স্থানীয়রা জানালেন, এমপিকে স্বাগত জানাতে ৯১টি গেইট নির্মাণ করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির অর্থ বিষয়ক সম্পাদকের পদ পাওয়ায় রংপুর-৪ আসনের এমপি টিপু মুন্সিকে ১২ নভেম্বর পাওটানা হাটে সংবর্ধনা দেয়া হয়। সংবর্ধনা উপলক্ষ্যে রাস্তার মোড়ে ও উপজেলার বিভিন্ন হাটবাজারে নির্মাণ করা হয় ৯১টা তোরণ-গেইট। যারা মঞ্চের আশপাশের রাস্তায় জায়গা পাননি তারা ৭/৮ কিলোমিটার দুলে তোড়ণ-গেইট বসিয়েছেন। এমপির সংবর্ধনার এই আয়োজন সফল করতে রাস্তার পাশে বসে চুল কাটে যে নাপিত তাকেও দিতে হয় চাঁদা। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, মাঠে সোনালী ধানের বাম্পার ফলন; অথচ মানুষের মুখ হাসি নেই। যার সঙ্গে কথা হয় তিনিই দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে ওঠেন ‘ভাল নাই বাহে; বেঁচে আছি কৌশল করে’।
পরের দু’দিন রংপুর শহরের আশপাশের শহরতলীর কয়েকটি বাজারে কথা হয় স্থানীয়দের সঙ্গে। তাদের প্রায় সকলেরই একই বক্তব্য ভাল নাই বাহে। দেশের যা অবস্থা! ভয় আতঙ্ক সব সময় তাড়িয়ে বেড়ায়। সরকারি দল না করলে মামলা মোকদ্দমার ভয়। ধরে নিয়ে গিয়ে জামায়াত-শিবির তকমা দিয়ে মামলায় নাম ঢুকিয়ে দেয়। একটি দিন যায় না যে রংপুর জেলার থানাগুলোতে ৪০/৫০ জনকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না। থানায় রাতে এদের কাউকে টাকার রফাদফা করে ছেড়ে দেয়, আবার কাউকে বিভিন্ন মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে পাঠায়। শহীদ নামের একজন নিজের মোবাইলে আওয়ামী লীগের একটি সমাবেশে দেয়া এক প্রতিমন্ত্রীর ভাষণ শুনিয়ে বললেন, এসব হচ্ছে বেঁচে থাকার টেকনিক। আমরা যে আওয়ামী লীগ সেটা প্রমাণের জন্যই এভাবে বক্তব্য রেকর্ড করে রাখি। পথে ঘাটে চলতে ফিরতে এগুলো কাজ দেয়। রংপুর শহরের পায়রা চত্বরে দু’জন সাংবাদিক ও একজন কলেজ শিক্ষকের সঙ্গে আড্ডার ফাঁকে গ্রামে সাধারণ মানুষের মোবাইলে স্থানীয় এমপির ভাষণ ও আওয়ামী লীগের সমাবেশের বক্তব্যের রেকর্ড প্রসঙ্গ উঠতেই সাংবাদিক জানান, পুলিশি গ্রেফতার, চাঁদাবাজির ভয়ে সবাই আওয়ামী লীগ হিসেবে চিহ্নিত হতে মরিয়া। সরকারি দলের সীল গায়ে থাকলে নানান ঝামেলা থেকে রেহাই মেলে। যারা কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে হঠাৎ আওয়ামী লীগ হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। মূলত পরিবেশ পরিস্থিতি মানুষকে এই কৌশলে বাধ্য করেছে। ওই আড্ডায় জানা গেল গ্রামগঞ্জে জামায়াতের লোকজন এখন মামলা-মোকদ্দমা থেকে রেহাই এবং ঝামেলা মুক্ত থাকতে আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলছেন। তবে রংপুরের ৯ উপজেলার গ্রামগুলো ঘুড়লে আপনি হাজার হাজার মানুষ পাবেন যারা মোবাইলে আওয়ামী লীগের এমপি ও সরকারের মন্ত্রীদের বক্তব্য রেকর্ড করে রেখেছেন। পথে ঘাটে হাঁটতে ওরা মোবাইলের ওই রেকর্ড বাজিয়ে নিজেদের আওয়ামী লীগের লোক হিসেবে জাহির করেন।
ঢাকায় রংপুরের মানুষ ‘মফিজ’ হিসেবে পরিচিত। চালচলনে সরলতা, কথাবার্তায় সহজ-সরল, জাপিত জীবনে নির্ভেজাল, ঘোষপ্যাচহীন। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, মস্তানি, ঠকবাজি, রাজনৈতিক সহিংসতা, হানাহানি এগুলোর সঙ্গে রংপুরের সাধারণ মানুষের তেমন পরিচিতি ক’বছর আগেও ছিল না। কিন্তু চলমান ক্ষমতাকেন্দ্রীক সুবিধাবাদী সংঘাতময় রাজনীতি গ্রামের সাধারণ মানুষের বিপাকে ফেলেছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারীর নির্বাচন এবং কয়েক মাস আগে হয়ে যাওয়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে গ্রামের মানুষের পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন ভেঙ্গে দিয়েছে। রাজনীতির কারণে ভাইয়ে ভাইয়ে, ভাইয়ে বোনে, আত্মীয়-স্বজনে, চাচা ভাতিজা, স্বামী-স্ত্রী, শ্যালক-দুলাভাই, মামা-ভাগ্নের মধ্যে বিরোধ এখন প্রকাশ্য। একদিকে ভেঙ্গে যাচ্ছে পারিবারিক বন্ধন; অন্যদিকে ভীতি আতঙ্ক মানুষকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। মানুষ অপেক্ষা করছে আর কতদিন পর হবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তাদের বিশ্বাস নির্বাচনের মাধ্যমেই তাদের চলমান যাপিত জীবনের সব অন্ধকার কেটে যাবে। ওই নির্বাচনের প্রত্যাশায় প্রহর গুণছে। শহরের শাপলা চত্বর থেকে এরশাদ মোড়ের দিকে যাচ্ছি, পাশের এক বাড়ি থেকে কানে ভেসে এলো কবি ফররুখ আহমেদের কালজীয় কবিতার পংক্তি ‘রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি/ এখনো তোমার আসমান ভরা মেঘে/ সেতারা, হেলার এখনো ওঠেনি জেগে/ তুমি মাস্তলে, আমি দাঁড় টানি ভুলে/ অসীম কুয়াশা জাগে শূন্যতা ঘেরি/ রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ