Inqilab Logo

শুক্রবার ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সর্বত্রই মাদকের ছড়াছড়ি

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১৯ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১২:৫৯ এএম, ১৯ নভেম্বর, ২০১৬

মাদকের ভয়াল থাবায় ধ্বংস হচ্ছে দেশের যুবসমাজ। রাজধানী থেকে গ্রাম-গঞ্জ সর্বত্রই মাদকের ছড়াছড়ি। মাদকাসক্ত সন্তান খুন করছে পিতা-মাতাকে, পিতা খুন করছে সন্তানকে। ভাইয়ের হাতে ভাই, ছাত্রের হাতে শিক্ষক। মাদকের কারণে তছনছ হচ্ছে পরিবার, ভাঙছে সংসার, বাড়ছে পারিবারিক দ্বন্দ্ব-বিভেদ। দিন দিন মাদক ব্যবসার বিস্তারের কারণে ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য রাজধানী ও শহরাঞ্চল ছাপিয়ে এখন অজপাড়াগাঁয়েও সহজলভ্য। সীমান্ত পথে আসছে হাজার হাজার কোটি টাকার ইয়াবা, হেরোইন, গাঁজা, আফিম, কোকেন, ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক। আর এসব মাদকের অধিকাংশই সেবন করছে দেশের যুবসমাজ। মাদকের টাকা যোগাতে গিয়ে এরা জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন অপরাধে। অস্ত্র ব্যবসা, চাঁদাবাজি, খুন-খারাবি, ধর্ষণ অপহরণসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে দেশের উচ্চবিত্ত থেকে দিনমজুর। সংশ্লিষ্টরা এ জন্য মাদকের সহজলভ্যতাকেই দায়ী করছেন। তাঁরা বলছেন, মাদকের কারণে পারিবারিক ঝগড়া-বিবাদ এবং খুনাখুনিও বাড়ছে। পুলিশ কর্মকর্তার আদরের মাদকাসক্ত মেয়ে ঐশীর হাতে পিতা-মাতা খুনের ঘটনাই প্রমাণ করে মাদকের ভয়াবহতা কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। এই মরণ নেশা মাদক ব্যবসায় সহযোগী হিসেবে কাজ করছেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, রাজনৈতিক নেতাকর্মীসহ পুলিশের কিছু অসাধু সদস্যও। ফলে মাদক ব্যবসার বিস্তার ঘটছে দিন দিন। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাসহ একাধিক সংস্থার কর্মকর্তারা এমনটি জানিয়েছেন।
বিশিষ্ট আইনজীবী ও মানবাধিকার নেত্রী এডভোকেট এলিনা খান বলেছেন, মাদক এখন ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। দেশের বেশীর ভাগ অপরাধমূলক ঘটনার সাথেই মাদক সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। বিশেষ করে ইয়াবা এখন তরুণ-তরুণীদের মাঝে মহামারীর আকারে ছড়িয়ে পড়ছে। তিনি বলেন, নিয়ন্ত্রণহীন মাদকের হিংস্্র থাবাই এখন দেশজুড়েই, ক্রমেই হয়ে উঠেছে সর্বগ্রাসী। ভয়াল মাদক তারুণ্য, মেধা, বিবেক, লেখাপড়া, মনুষ্যত্বÑ সবকিছু ধ্বংস করে দিচ্ছে। বিনষ্ট করে দিচ্ছে স্নেহ-মায়া, ভালোবাসা, পারিবারিক বন্ধন পর্যন্ত। মাদকাসক্ত সন্তানের হাতে বাবা-মা, ঘনিষ্ঠ স্বজন নির্মম হত্যাকা-ের শিকার হচ্ছেন, নেশাখোর পিতা মাদক সংগ্রহে ব্যর্থ হওয়ার ক্রোধে নিজ সন্তানকে খুন করছে অবলীলায়। নেশার টাকা না পেয়ে স্ত্রীকে আগুনে পুড়িয়ে মারা, মাকে গলা কেটে হত্যা করা, আদরের সন্তানকে বিক্রি করে দেয়ার মতো মর্মস্পর্শী ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। দ্রুত এর লাগাম টেনে না ধরলে একদিন এ জাতি মেধাশূন্য হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গত ৫ বছরের মধ্যে নেশাখোর ছেলেদের হাতে অন্তত ৩৮৭ জন পিতা-মাতা নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন। একই সময়ে মাদকসেবী স্বামীর হাতে প্রাণ গেছে ২৫৬ জন নারীর। মাদক সেবনের বিরোধের জের ধরে এসময়ের মধ্যে ৫ হাজার ৭৮০টি বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটেছে। মাদকাসক্ত প্রেমিক-প্রেমিকার হাতে খুন হয়েছেন ৬৭০ জন তরুণ-তরুণী। মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে গত তিন বছরে ৩২১ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে।
বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক বলেছেন, সীমান্তে মাদক আসা বন্ধ করতে হবে। দেশের ভিতরে মাদক তৈরী হচ্ছে না। দেশের বিভিন্ন সীমান্ত পথে ইয়াবাসহ নানা ধরনের মাদক আসছে। পুলিশ সারা দেশে মাদক বিরোধী অভিযানে তৎপর রয়েছে। তবে কিছু অসৎ পুলিশ সদস্য মাদক ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা করে এমন অভিযোগও রয়েছে। আমরা বিভিন্ন সময় এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নিয়েছি। তিনি বলেন, কতিপয় সদস্যদের জন্য পুলিশের ভাবমর্যাদা ক্ষুণœ হচ্ছে, এমনও অভিযোগ রয়েছে অনেক পুলিশ সদস্য মাদকের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তারা অনেকে মাদক সেবন করে। ইতিমধ্যে দু’চারজন ধরাও পড়েছে, চাকরিও চলে গেছে এবং মামলার আসামি হয়েছে। এসব সদস্যদের জন্য পুলিশের সমস্ত অর্জন মøান হয়ে যাচ্ছে। কোন পুলিশ সদস্য অবৈধ কাজে জড়িত হলে তাদের বিরুদ্ধে আরো কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সারাদেশে বর্তমানে প্রায় ৩৫ হাজার মাদক সংক্রান্ত মামলা ঝুলে আছে। র‌্যাব ও পুলিশের হাতে তদন্তাধীন মামলার সংখ্যা ২৪ হাজারেরও বেশি। এরমধ্যে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হাতে তদন্তাধীন মামলা রয়েছে প্রায় ৮ হাজার। মামলা হলেও সাক্ষী-প্রমাণের অভাবে ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে অভিযুক্তরা। আইন-শৃংখলা বাহিনীর কাছে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অবৈধ মাদক আমদানির জন্য প্রতি বছর ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি দেশি মুদ্রা পাচার হচ্ছে। কিন্তু ফ্যামেলি হেলথ ইন্টারন্যাশনালের পরিসংখ্যানে বলা হয়, প্রতি বছর ভারত থেকে প্রায় ৩৪৭ কোটি টাকার বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য দেশে আসে। এরমধ্যে শুধু ফেন্সিডিলই আসে ২২০ কোটি টাকার। শতকরা ৬০ ভাগ মাদকাসক্ত মাদকের টাকা জোগাড় করতে গিয়ে জড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকা-ে।  
বাংলাদেশের মাদক পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের একটি জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে কমপক্ষে ৬৫ লাখ মানুষ সরাসরি মাদকাসক্ত। এদের মধ্যে ৮৭ ভাগ পুরুষ, ১৩ ভাগ নারী। এক লাখেরও বেশি মানুষ নানাভাবে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। প্রভাবশালী ব্যক্তি থেকে শুরু করে নারী এবং শিশু-কিশোররাও জড়িত মাদক ব্যবসার সঙ্গে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর মাসুদা এম রশিদ চোধুরী বলেন, নৈতিক শিক্ষার অবক্ষয়ের কারণে তরুণ-তরুণী বা ছাত্র-ছাত্রীরা মাদকাসক্ত হচ্ছে। আগে ছেলে-মেয়েদের যেভাবে ধর্মীয় শিক্ষা দেয়া হতো এখন তা দেয়া হচ্ছে না। ধর্মীয় শিক্ষার অভাবে নীতি নৈতিকতা কিংবা মূল্যবোধের শিক্ষা পাচ্ছে না আমাদের ছেলে মেয়েরা। এছাড়া বাবা-মা তাদের সন্তাদের সময় দিচ্ছে না। তারা কোথায় কি করছে তা সঠিকভাবে তদারকি করছে না পিতা-মাতা। তিনি বলেন, আইন-শৃংখলা বাহিনী তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করলে মাদ কেনা বেচা এত সহজলভ্য হতো না।  
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৪৬ লাখ বলে স্বীকার করা হয়েছে। আসক্তদের মধ্যে বেশিরভাগই তরুণ। অধিদপ্তরের জরিপে বলা হয়, আসক্তদের শতকরা ৯১ ভাগ কিশোর ও তরুণ।  মাদকাসক্তদের শতকরা ৪৫ ভাগ বেকার এবং ৬৫ ভাগ আন্ডার গ্র্যাজুয়েট। মাদকাসক্তের সংখ্যা ১৫ ভাগ উচ্চশিক্ষা।
ফ্যামেলি হেলথ ইন্টারন্যাশনালের পৃথক পরিসংখ্যান সূত্রে জানা যায়, দেশে সুই-সিরিঞ্জের মাধ্যমে মাদকসেবীর সংখ্যা প্রায় এক লাখ। এ মাদকাসক্তরা শিরায় মাদক গ্রহণ করায় এইচআইভি ঝুঁকির মধ্যে বেশি থাকে।
একটি গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, প্রতি বছর যে পরিমাণ অবৈধ মাদকদ্রব্য দেশে ঢুকছে তার মাত্র শতকরা ১০ ভাগ উদ্ধার সম্ভব হয়। র‌্যাবের তথ্য অনুযায়ী কেবল তাদের হাতেই ২০০৯ সালে ৪ লাখ ৬০ হাজার ৩৪ বোতল ফেন্সিডিল উদ্ধার হয়েছে। এ সময় ১৪ হাজার ২৫ বোতল বিদেশি মদ, ৩৫ হাজার ৭০৮ ক্যান বিয়ার, ২ হাজার ৮৪২ কেজি গাঁজা, ৪২ হাজার ২৮৪টি ইয়াবা, ৩৪.১৭৫ কেজি হেরোইন ও প্রায় ৫৮ হাজার নেশাজাতীয় ইনজেকশন উদ্ধার করা হয়েছে। এসময় গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৫ হাজার ৫৯১ জনকে।
রাজধানীতে মাদক ব্যবসার ‘বাজার’ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে এমন ১১৬ জন প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর তালিকা করেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। বিভিন্ন থানা এলাকায় অনুসন্ধান চালিয়ে এই তালিকা করা হয়েছে। তবে মাঠ পর্যায়ের এসব ব্যবসায়ীর গডফাদাররা এখনও পর্দার আড়ালেই রয়ে গেছে। প্রকৃত মাদক ব্যবসায়ীদের অনেকের নামই তালিকায় নেই। এসব তালিকা হালনাগাদ করতেও তেমন আগ্রহ প্রকাশ করে না আইন-শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা।
র‌্যাবের মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালনায় বিশেষ ভূমিকা রাখা একাধিক কর্মকর্তা জানান, ইদানিং মাদকাসক্তদের কাছে ফেন্সিডিল ও ইয়াবা ট্যাবলেটের কদর সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করা গেছে। এত আটক এত গ্রেফতার-তবু যেন মাদকের প্রসার থামানো যাচ্ছে না বলেও মন্তব্য করেন র‌্যাব কর্মকর্তারা।



 

Show all comments
  • আসিফ ১৯ নভেম্বর, ২০১৬, ১১:২৮ এএম says : 0
    মাদকের গ্রাস থেকে দেশের যুব সমাজকে বাঁচাতে হবে
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ