Inqilab Logo

সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বাড়ছে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার

মফস্বলেও ছড়িয়ে পড়েছে : প্রকাশ্য ঘটনা ঘটিয়ে অনেকেই ধরাছোঁয়ার বাইরে : বেশিরভাগ অস্ত্র আসছে ভারত থেকে

নূরুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ১৮ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১০:০৩ এএম, ১৮ নভেম্বর, ২০১৬

তুচ্ছ ঘটনায় আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, আধিপত্য বিস্তার, লুটপাট, চাঁদাবাজিসহ যে কোনো তুচ্ছ ঘটনায় অস্ত্রের ব্যবহার করছে দলীয় সন্ত্রাসীরা। অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার রাজধানী বা জেলা শহরের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, মফস্বলেও ছড়িয়ে পড়েছে। গত ১৪ নভেম্বর আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার চরাঞ্চলে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষেও  অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার দেখা গেছে। ত্রিমুখী সংঘর্ষের ওই ঘটনায় চারজন নিহত ও অর্ধশতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছে। এর আগে গত ২৭ অক্টোবর রাজধানীর গুলিস্তানে অবৈধ দোকান উচ্ছেদের সময় মহানগর ছাত্রলীগের দুই নেতা প্রকাশ্যে অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার করেছিল। তুচ্ছ ঘটনায় প্রকাশ্যে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার র‌্যাব-পুলিশকে ভাবিয়ে তুলেছে। এতে করে জনমনে আতঙ্ক বেড়েছে। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে সাধারণ মানুষ। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক আইজিপি আবদুল কাইয়ুম ইনকিলাবকে বলেন, যারা কথায় কথায় অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার করছে তারা প্রভাবশালী এবং নিজেদেরকে আইনের ঊর্ধ্বে মনে করে। এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নিলে এরকম ঘটনা ঘটতেই থাকবে। তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলাবাহিনীকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে না দিলে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রশ্রয়ে অবৈধ অস্ত্রধারীদের দৌরাত্ম্য বাড়তেই থাকবে। এজন্য রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেয়া জরুরী হয়ে পড়েছে।
পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার মতে, এখন যেসব অস্ত্র ব্যবহার করা  হচ্ছে সেগুলোর বেশিরভাগই বিদেশি। আগে দেশীয় অস্ত্রের ব্যবহার দেখা গেলেও এখন কমে গেছে। নতুন চকচকে এসব অস্ত্রের বেশিরভাগই আসছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে। গোয়েন্দাদের মতে, দেশের ১৮টি জেলার ৩০টি সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে এসব অবৈধ অস্ত্র আসছে। ইদানিং আবার অনলাইনেও অস্ত্র বেচাকেনা চলছে।  
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সাড়ে সাত বছরে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে সারাদেশে নিহত হয়েছে ৫৫ জন। এসব কোন্দলে ব্যবহার হয়েছে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র। গত ২৭ অক্টোবর রাজধানীর গুলিস্তানে ফুটপাতের অবৈধ দোকান উচ্ছেদের সময় মহানগর ছাত্রলীগের দুই নেতা অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার করেছিলেন। তারা হলেন, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখার সাধারণ সম্পাদক সাব্বির হোসেন ও ওয়ারী থানা শাখার সাধারণ সম্পাদক আশিকুর রহমান। তাদের অস্ত্রবাজির ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর প্রশাসনের টনক নড়ে। ঘটনার একদিন পর তাদেরকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। এরপর মামলা হতে আরও দু’দিন লাগে। এই সুযোগে একজন দেশের বাইরে পালিয়ে যায়। অপরজনকে এখনও গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। গত ১ নভেম্ব^র চট্টগ্রাম মহানগরীর আবাদ এলাকায় ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষের ঘটনায় দিনভর চলে অস্ত্রহাতে সন্ত্রাসীদের প্রকাশ্য মহড়া। পুলিশ এ ঘটনায় তাৎক্ষণিক কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। ঘটনার পরদিন জালাল নামে একজন গ্রেফতার হয়। তার কাছে থেকে চারটি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। তবে অস্ত্র নিয়ে মহড়া দেয়া দুইজন ফয়সল আহমদ রাজ ও সুমন ওরফে দাতলা সুমন এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। গত ৪ মে রাজধানীর নিউমার্কেট সংলগ্ন চন্দ্রিমা সুপার মার্কেটে কেনাকাটা করতে গিয়ে ব্যবসায়ীদের সাথে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের কিছু কর্মীর কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। এ সময় ছাত্রলীগের কর্মীরা লাঠি ও অস্ত্র ব্যবহার করে। ৩১ জুলাই কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষের দিনই চট্টগ্রাম কলেজের সামনে ছাত্রলীগের দুই পক্ষে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, গুলিবর্ষণ ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে ক্যাম্পাস ও আশপাশের এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। নগর ছাত্রলীগের এক নেতাসহ ৩ জন গুলিবিদ্ধ ও এক সাধারণ শিক্ষার্থী ককটেলের স্পিøন্টারে আহত হন। গত বছরের এপ্রিলে দিনাজপুরে হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে অস্ত্রের ব্যবহার হয়। এ ঘটনায় মিলটন ও জাকারিয়া নামের দুই ছাত্রলীগ নেতা নিহত হন। দীর্ঘদিনেও ওইসব অস্ত্রধারী গ্রেফতার হয়নি। গত বছরের ১৮ মার্চ পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার মুলাডুলি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষের ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে বাঁধন খন্দকার নামে ছাত্রলীগের এক নেতা নিহত হয়। এ ঘটনায় থানায় মামলা হলেও অস্ত্রধারীরা গ্রেফতার হয়নি। ২০১২ সালের ২ অক্টোবর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ-শিবিরের মধ্যে সংঘর্ষ চলাকালে অস্ত্র¿ উঁচিয়ে গুলিবর্ষণ করতে দেখা যায় তৎকালীন ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক তৌহিদ আল হোসেন তুহিনকে। গ্রেফতার তো দূরের কথা পরের বছর রাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ পান এই নেতা। গত বছরের ২৪ ডিসেম্ব^র রাজধানীর বকশিবাজারে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার হাজিরার দিন বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর অস্ত্রসহ হামলা করে ছাত্রলীগ নেতারা। মিডিয়ায় এদের অস্ত্রহাতে ছবি প্রকাশিত হলেও এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় সন্ত্রাসীরা বিদেশ থেকে অস্ত্র আনছে। এজন্য বিপুল পরিমাণ টাকা ব্যয় হলেও আয়ের উৎস থাকায় তারা মোটা অংক খরচ করেই অস্ত্র কিনছে। চাহিদার কারণেই সংঘবদ্ধ একাধিকচক্র বিভিন্ন দেশ থেকে অবৈধ পথে প্যাকেটজাত নতুন অস্ত্র আনছে। বিভিন্ন পন্থায় সেগুলো চলে যাচ্ছে হাতে হাতে। মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন অভিযানে সম্পৃক্ত থাকা র‌্যাব, পুলিশ, গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, গত দু’বছরে উদ্ধারকৃত আগ্নেয়াস্ত্রগুলোর বেশিরভাগই ছিল নতুন-চকচকে।  ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, আগে বিভিন্ন অভিযানে ভাঙ্গাচোরা, পুরাতন এবং দেশে তৈরি পাইপগান মার্কার অস্ত্রশস্ত্রই বেশি পাওয়া যেতো। কিন্তু ইদানিং সন্ত্রাসীদের হাতে উঠে এসেছে অপেক্ষাকৃত ছোট আকৃতির এবং অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন অস্ত্র। সূত্র জানায়, অস্ত্র ব্যবসায়ীরা কয়েকটি বিশেষ রাষ্ট্র থেকে প্যাকেটজাত অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র আনছে। কয়েক হাত হয়ে সেগুলো ছড়িয়ে পড়ছে সারাদেশে। তবে বেশিরভাগ অস্ত্র আসছে ভারত থেকে।
সূত্র জানায়, দেশের ১৮ জেলার ৩০টি সীমান্ত পয়েন্ট এখন অস্ত্র ও মাদক কেনাবেচা চলে। সেসব স্থানে ইয়াবা, ফেনসিডিলের যেমন খোলামেলা কেনাবেচা চলে, তেমনি চলে অস্ত্রের বেচাকেনা। বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট ফাঁকি দিয়ে ঢুকে পড়ছে ছোট আকারের আগ্নয়াস্ত্রসহ,  ‘আরজিএস’ গ্রেনেড, একে-৪৭ রাইফেলের মতো অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রও। সূত্র জানায়, গত বছর একটি গোয়েন্দা সংস্থার এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, দেশজুড়ে অস্ত্রশস্ত্র সহজলভ্য হয়ে পড়েছে। বেশ কিছু পয়েন্টে অস্ত্র কেনাবেচা চলছে প্রায় প্রকাশ্যেই। অপর একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের বিভিন্ন সীমান্তের অন্তত ২৬টি পয়েন্ট দিয়ে আরজিএস গ্রেনেড, একে-৪৭ রাইফেল, নাইন এমএম এর মতো মারাত্মক ধরনের অস্ত্রশস্ত্রও অবাধে ঢুকে পড়ছে। এসব পয়েন্টে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), সীমান্ত থানাগুলোর পুলিশ ও বিভিন্ন গোয়েন্দা নজরদারি নিশ্চিত করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকেও বিশেষ নির্দেশনা জারি করা হয়।





























































































































 

Show all comments
  • shihab ১৮ নভেম্বর, ২০১৬, ১১:০৪ এএম says : 0
    necessary steps must be taken to decrease this rate as soon as possible before any casualties
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ