Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

গাছি সঙ্কটে যশোরের ঐতিহ্য খেজুরের গুড় শিল্প মৃত্যুমুখে

মিজানুর রহমান তোতা | প্রকাশের সময় : ১৮ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

খেজুরের রস হচ্ছে যশোরের যশ। ঐতিহ্যটি দিনে দিনে হারিয়ে যাচ্ছে। এখন রীতিমতো মৃত্যুমুখে। বাঁচানোর কোনো উদ্যোগ নেই। এখানকার বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষ শীতকাল এলেই হা-হুতাশ করে থাকেন। চারদিকে জোরেশোরে উচ্চারিত হয় নানা প্রশ্ন ‘শিল্পটি কি কোনোভাবেই বাঁচানো যাবে না, এভাবে শেষ হয়ে যাবে, একটু কি উদ্যোগ নেয়া যায় না, ঐতিহ্য নিয়ে গর্বের জায়গাটা এভাবে নষ্ট হয়ে যাবে।’ এসবের উত্তর খুঁজে পান না তারা।
শুধু যশোর নয়, একসময় দেশ ছাপিয়ে উপমহাদেশের মধ্যে শীর্ষস্থানের রেকর্ড গড়ে যশোরের খেজুরের রস ও গুড়। ইংল্যান্ডের মি. নিউ হাউজ যশোরের চৌগাছার তাহেরপুরে এসে ১৮৬৪ সালে প্রথম খেজুরের রস থেকে বাদামি চিনি উৎপাদন করে ব্যাপক সাড়া ফেলেন। সেই থেকে যশোরের আশপাশে ঝিনাইদহ, মাগুরা ও নড়াইলের বিভিন্ন গ্রামে ক্ষুদ্র শিল্প হিসেবে গড়ে ওঠে খেজুরের রস থেকে গুড় ও নলেন পাটালির কারখানা। কেন হারিয়ে যাচ্ছে এই ঐতিহ্য আর  কেনইবা বিরাট সম্ভাবনাময় খেজুরের গুড় শিল্প বাঁচানোর উদ্যোগ নেই তার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে সংশ্লিষ্টদের গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য পাওয়া গেছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো: ফয়েজ উদ্দীন তার অভিজ্ঞতার আলোকে জানান, খেজুরের রস থেকে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে বাদামি চিনি উৎপাদন করে যশোর বিপ্লব সৃষ্টি করে। একদিনে এটি হয়নি। দিনে দিনে সম্ভাবনার নানা দিক গবেষণা করে সফলতা আসে। কিন্তু বিপ্লবের কিছুদিন পর মুখ থুবড়ে পড়ে। একপর্যায়ে যশোরের তাহেরপুরের কারখানাটি বন্ধ হয়ে যায়। তবে গ্রামে গ্রামে ক্ষুদ্র কারখানা যেখানে স্থানীয় পদ্ধতিতে রস জ্বালিয়ে গুড় ও পাটালি তৈরি বহুকাল থেকেই চলে আসছে। বর্তমানে সেটিও মৃত্যুমুখে। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের মাঠ কর্মকর্তারা অন্যান্য বিষয় যেভাবে ওপর-নিচে যোগাযোগ করে থাকেন, এটির ক্ষেত্রে মোটেও হয় না। কোনো নির্দেশনাও থাকে না ওপর মহলের। পারতপক্ষে কেউ খোঁজ রাখেন না এ ব্যাপারে। মাঠপর্যায়ের একজন কর্মকর্তা জানালেন, আমি দীর্ঘদিন চাকরি করছি, ওপরের কোনো কর্মকর্তা কখনো বলেননি খেজুরগাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে কেন, বাড়ানো যায় কিভাবে, সমস্যার সমাধানইবা কি। তার মতে, সাংবাদিকরা মৌসুমি রিপোর্ট করে থাকেন। আসলে মহা সঙ্কটে শিল্পটি। তার ওপর শিল্পটির করুণ অবস্থার অন্যতম প্রধান কারণ গাছি সঙ্কট। বিভিন্ন পেশা বংশপরম্পরায় চলে থাকে। গাছিদের ক্ষেত্রে তা হচ্ছে না। গাছির ছেলে গাছি হচ্ছেন না। যেসব গাছি আছেন তারা খেজুর গাছে বাদরের মতো ঝুলে রস সংগ্রহের জন্য সকাল-বিকাল পরিশ্রম করেন এখন বয়সের ভাড়ে তারা পেরে উঠছেন না। তাছাড়া সিংহভাগ গাছির মাজায় ও হাঁটুতে ব্যথা স্থায়ী হয়ে গেছে। যশোরের সদর উপজেলার ডাকাতিয়া মাঠপাড়ার গাছি আলী হোসেন ময়না জানান, আমি খেজুরগাছ থেকে রস সংগ্রহের সাথে জড়িত প্রায় ৪০ বছর। এখন কোনোরকমে ২টি ছোট গাছ ঝেড়েকুটে রস সংগ্রহের জন্য বাঁশের নলি ও ভাড় ঝুলাতে পারছি। আগে আমি নতুন খয়েরতলা, ডাকাতিয়া, নওদা গ্রামের প্রায় ৫০-৬০টি গাছ থেকে রস সংগ্রহের কাজ করতে পারতাম। তিনি বললেন, আর পারি না। তাছাড়া সেরকম গাছও নেই। গ্রামে গ্রামে সারি সারি খেজুর গাছ যেভাবে দেখা যেত, এখন দেখা যায় না। তার মতে, অল্পকিছু গাছি যশোরের ঐতিহ্য ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। তাও কতদিন স্থায়িত্ব হবে তা নিয়ে যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছে।
সূত্র জানায়, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ২০১৪ সালের মাঠ জরিপ অনুযায়ী যশোর অঞ্চলে ২ হাজার ৮৩৮ হেক্টরে খেজুরগাছের সংখ্যা ছিল ১৭ লাখ ৮২ হাজার ৫৭০টি। গুড় উৎপাদন হতো ২৫ হাজার ৯শ’ মেট্রিক টন। সূত্রমতে, আগের জরিপে (১৯৯৮)-এর সংখ্যা ছিল প্রায় দ্বিগুণ। দ্রুত কমে যাচ্ছে খেজুরগাছের সংখ্যা। ইটভাটায় জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার হওয়ায় খেজুরগাছ সাবাড় হচ্ছে। তাছাড়া নতুন করে কোনো খেজুরগাছ লাগানো হচ্ছে না। সূত্রমতে, গ্রামাঞ্চলে বাড়ির আঙ্গিনায় ও মাঠে জমির আইলে কিংবা বাগানে অযতœ-অবহেলায় ও সম্পূর্ণ বিনা খরচে বেড়ে ওঠে ‘মধুবৃক্ষ’ খেজুরগাছ। প্রতি বছর শীত মৌসুমের ৩-৪ মাস মানুষের রসনা তৃপ্তির যোগান দেয়। খেজুরের রস জ্বালিয়ে পাতলা ঝোলা গুড়, নলেন গুড়, মিছরিদানার গুড় ও পাটালি তৈরির দৃশ্য অনেকটাই অভিনব মনে হয়। পুরো শীতে গ্রামীণ জীবনের প্রাত্যহিক এই উৎসব চলে আসছে আবহমানকাল ধরে।
কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা প্রদীপ হামজা দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, খেজুরগাছের পেছনে লুকিয়ে আছে অর্থনৈতিক উন্নয়নের এক বিরাট সম্ভাবনা। সরকারিভাবে কাজে লাগানো হলে আবারো বিপ্লব সৃষ্টি করা যাবে। দেশের সড়কপথ, রেলপথ, জমির আইল, পতিত জমি ও বাড়ির আঙ্গিনায় কোটি কোটি খেজুরগাছ লাগানো সম্ভব। মাত্র ৪ বছরে খেজুর গাছে  রস দেয়া শুরু হয়। কোনো খরচ লাগে না। কোনোরূপ পরিচর্যা ছাড়াই গাছ দ্রুত বেড়ে ওঠে। তিনি বললেন, গবেষণা করে দেখেছি বিরাট সফলতা আনা সম্ভব এই খাতে।
সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও উদ্যোগ নেয়া হলে দেশের চাহিদা পূরণ ছাড়াও প্রতি বছর বিদেশে গুড় ও পাটালি রফতানি করে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা আয় করা সম্ভব বলে কৃষি বিশেষজ্ঞরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তাদের কথা, এর জন্য বাড়তি খরচ কিংবা আবাদি জমি নষ্ট করার প্রয়োজন পড়বে না। তাতে উন্মোচিত হবে দেশের অর্থনীতির এক নতুন দ্বার। এ জন্য দরকার শুধু উদ্যোগ। এই উদ্যোগ নিতে পারে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। তাদের মাঠপর্যায়ে যে জনবল রয়েছে তাদের কাজে লাগিয়ে মাঠজরিপ ও গাছিদের উদ্বুদ্ধ করে মৃত্যুমুখ থেকে বাঁচানো যায় ঐতিহ্যবাহী শিল্পটি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ