ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
গতকাল ১৭ নভেম্বর মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ৪০তম মৃত্যুবার্ষিকী যথাযথ মর্যাদায় উদযাপিত হয়েছে। মওলানা ভাসানী তার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে কখনো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার লোভ করেননি। ইচ্ছা করলে রাষ্ট্রের যে কোনো উচ্চ পদের অধিকারী হতে পারতেন, কিন্তু তা তিনি পরিহার করেছেন। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা লাভ ও ভোগ করার মোহে সারা দুনিয়ায় যখন ব্যাকুলতা-অস্থিরতা বিদ্যমান, সে সময় মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী জনসমর্থনের শীর্ষে অবস্থান করেও জনগণ ও তার দলের স্বার্থে কাজ করলেও নিজে কখনো উচ্চ পদের প্রত্যাশী ছিলেন বলে জানা যায় না। রাজনীতিতে গণমানুষের স্বার্থের কথা, জনগণের অধিকার আদায় এবং সমাজকল্যাণ ইত্যাদি মুখরোচক জনপ্রিয় বাক্য উচ্চারণ করা প্রচলিত প্রচারণার আকর্ষণীয় দিক হলেও ব্যক্তি জীবনে মওলানা ভাসানীর মধ্যে তা বিদ্যমান ছিল না। ক্ষমতা লাভের তীব্র প্রতিযোগিতা-প্রতিদ্বন্দ্বিতার যুগে ক্ষমতাবিমুখ এরূপ নেতা বিশ্বে কজন পাওয়া যাবে তা বলা কঠিন নয়, সহজ। মওলানা ভাসানীর বাস্তব জীবনের একটি বড় বৈশিষ্ট্য ও অনুকরণীয় আদর্শ ছিল লেবাস বা পোশাক। তার এ পোশাকী আদর্শ অনেককে মুগ্ধ করত। তিনি রাজনীতি বিশারদ, শ্রমিক মজদুরের জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। তিনি ইসলাম ধর্মের পোশাকী ঐতিহ্যের কট্টর অনুসারী ছিলেন। তিনি বিদেশ সফরকালে কখনো এ পোশাকী ঐতিহ্যকে বিসর্জন দেননি। তিনি চীনের মতো দেশ সফর করেছেন তার প্রিয় লম্বা কোর্তা, লুঙ্গি এবং তালের আশের টুপি পরিধান করে। তার এ পোশাকী ঐতিহ্য কখনো কোথাও কোনো সুযোগ-সুবিধাকে প্রশ্রয় দিয়েছে বলে জানা নেই। এ প্রসঙ্গে ১৯৫৪ সালে প্রত্যক্ষ করা একটি ঘটনা মনে পড়ছে। তখন যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী প্রধান স্লোগান ছিল ‘হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দী’ এবং ‘নৌকা’। ছাত্র হিসেবে আমরা অনেক জনসভায় যোগদান করতাম। যুক্তফ্রন্টের পক্ষ হতে চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে এক জনসভার আয়োজন করা হয় এবং বেশ কদিন থেকে জোর প্রচারণায় বলা হয় তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বড় বড় নেতা যোগদান করবেন। স্থানীয় অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সকল প্রখ্যাত নেতা উপস্থিত থাকবেন। ছাত্র হিসেবে সমগ্র দেশের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবর্গকে একই সময় একই স্থানে একনজর দেখার আগ্রহ, কৌতূহল ছিল। নির্দিষ্ট দিন দুপুর ৩টায় জনসভা শুরু হওয়ার সংবাদ পূর্ব থেকেই জানা ছিল। ৩টার পূর্বে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটি হয়ে যায়। আগত নেতৃবর্গের দর্শন লাভ বরার জন্য অনেকে সভা মঞ্চের কাছাকাছি স্থান লাভের জন্য আগেই চলে যায়। লালদীঘি ময়দানে শ্রোতা-দর্শকেদের সমাগম বাড়তে থাকে। মঞ্চে পাতানো আসনগুলো পূরণ হতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মঞ্চের আসনে নেতৃবর্গ আসন গ্রহণ করেন। সকলের নাম মনে পড়ছে না। চেনা নেতৃবর্গের মধ্যে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
জনসভায় উৎসুক হাজার হাজার লোকের সমাবেশ। ময়দানে তিল ধারণের জায়গা ছিল না। জনসভা শুরু হওয়ার পর কয়েকজন বক্তার বক্তৃতা শেষে আসরের নামাজের জন্য কয়েক মিনিটের বিরতি ঘোষণা করা হয়। কিছুক্ষণের জন্য জনসভার একাংশ চলে যায়, অনেকে বসে থাকে। আবার কেউ কেউ ফেরিওয়ালাদের কাছ থেকে বুট-বাদাম কিনে চাবাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আবার অনেকের দৃষ্টি সভা মঞ্চের দিকে। দেখা গেল, মঞ্চে তখন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানীসহ আরো কয়েকজন নাম না জানা নেতা ছাড়া আর কেউ নেই। লক্ষ্য করা গেল, মওলানা ভাসানী মঞ্চ হতে নিচে নেমে জায়নামাজ পেতে একাকী নামাজের জন্য দাঁড়িয়ে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে সোহরাওয়ার্দী সাহেবও তার সামনে টেবিলে রাখা জিন্নাহ ক্যাপটি মাথায় রেখে নামাজে মওলানা সাহেবের একতেদা করলেন। মঞ্চে উপবিষ্ট বাকিরাও নামাজে শরিক হলেন। নামাজ শেষে জনসভার কার্যক্রম পুনরায় শুরু হয় এবং সন্ধ্যা পর্যন্ত চলতে থাকে।
তৎকালীন পাকিস্তানের শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবর্গকে জীবনে এই প্রথমবার চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক লালদীঘি ময়দানে দেখার ও তাদের অমিয় বাণী শ্রবণ করার সুযোগ হলেও তাদের মর্মবাণী অনুধাবন করার বয়স তখন হয়নি। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানি নেতৃবর্গ উর্দুতে বক্তৃতা করেন। বাংলায় যারা বক্তৃতা করে। তাদের মধ্যে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ভাঙা ভাঙা বাংলা বক্তৃতা অনেককে মুগ্ধ করে। শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ কণ্ঠের জোরালো বক্তৃতা এবং মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর বক্তৃতা মনে রাখার মতো। ঢাকার জীবনে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর বহু বক্তৃতা শোনার সৌভাগ্য হয়েছে এই লেখকের। কিন্তু নিকট থেকে দেখার সুযোগ কখনো হয়নি। আর নিকট থেকে দেখার সুযোগ যখন হলো তখন পিজি হাসপাতালের সামনে তিনি কফিনে ঢাকা। মওলানার কফিন দেখার সাথে জড়িত রয়েছে এই লেখকের ব্যক্তি জীবনের এমন একটি ঘটনা, যা গর্ব করার মতো। তা হচ্ছে, তার জীবনের সর্বশেষ ঐতিহাসিক ভাষণ যা ছাপা হলেও তিনি মক্কা মোকাররমায় হাজিদের উদ্দেশে পেশ করতে পারেননি। এ ঘটনার একটি দীর্ঘ পটভূমিকা রয়েছে, যার খোলাসা নি¤œরূপ :
গত রমজান মাসে ইন্তেকালকারী মাসিক মদীনা সম্পাদক মাওলানা মুহিউদ্দীন খান ছিলেন ঢাকার জীবনে এই লেখকের অন্তরঙ্গ বন্ধু। তিনি ছিলেন মরহুম মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর একান্ত ভক্ত। তার সাথে যোগাযোগ-সম্পর্কও ছিল খান সাহেবের খুবই। ইন্তেকালের আগে মওলানা ভাসানী যখন পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, তখনো মাওলানা মুহিউদ্দীন খান ঘন ঘন তাকে দেখতে যেতেন। ওই বছরই মওলানা ভাসানীর হজে যাওয়ার কথা ছিল। একদিন মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের সাথে দেখা হলে তিনি জানালেন, এবার মওলানা ভাসানী একদল সঙ্গীসহ হজে গমনের নিয়ত করেছেন এবং সেখানে হাজিদের উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। সারা দুনিয়া থেকে হজের মৌসুমে মক্কায় মুসলমানদের সমাগম ঘটে থাকে এবং তারা সবাই নানা ভাষার। মওলানা সাহেবের ভাষণ হবে বাংলা যা অন্যান্য ভাষাভাষীদের বোধগম্য নয়। মাওলানা খান বলেন, তিনি মওলানা ভাসানীকে তার ভাষণটি আরবিতে অনুবাদ করার প্রস্তাব দিয়েছেন এবং তাতে তিনি সম্মত হয়েছেন। এ জন্য লোক ঠিক করতে বলেছেন। মাওলানা খান বললেন, আমি তাকে আপনার নাম-পরিচয় দিয়েছি। আপনি সম্মত থাকলে আপনাকে তার কাছে নিয়ে যেতে আমাকে বলেছেন। আমার ব্যস্ততার কথা জানিয়ে সময় জানতে চাইলে তিনি বললেন, সময় খুব বেশি হাতে নেই, নভেম্বরের মাঝামাঝি তার হজে যাওয়ার কথা, তিনি ভাষণটি সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন। সময়ের ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্ত দেখে তিনি আমাকে বললেন, ভাষণটির রচনা এখনো শেষ হয়নি, আপনি মওলানা সাহেবের সাথে দেখা করার সময় না পেলে আমি মওলানা সাহেবকে বলে যতটুকু ভাষণ প্রস্তুত হয়েছে তা আপনাকে এনে দেব। কথা অনুযায়ী, মাওলানা খান প্রথমাংশ আনেন এবং কয়েক দিন পর বাকি অংশও এনে দেন। এবার তিনি আরো জানালেন, ভাষণটি অনুবাদের পর তা টাইপ করার ব্যবস্থাও আপনাকে করতে হবে। অতঃপর ভাষণটির অনুবাদ ও তা পুস্তিকা আকারে ছাপিয়ে যথাসময়ে মাওলানা খানকে প্রদান করা হলো।
‘ছাওতু বাংলাদেশ’ শীর্ষক পুস্তিকাখানা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর হস্তগত হলে তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হন বলে মাওলানা খান জানান এবং তারই মাধ্যমে আমার জন্য মোবারকবাদ এবং উপহার হিসেবে কিছু সম্মানী প্রেরণ করেন।
ইতোমধ্যে ১৭ নভেম্বর মওলানা সাহেবের হজে গমনের তারিখও জানা যায়। যার সাথে কখনো দেখা করার সৌভাগ্য হয়নি, বিমানবন্দরে (তখন বিমানবন্দর তেজগাঁওয়ে) বিদায় জানাতে গিয়েছিলাম। সেই হজযাত্রীবাহী জাহাজ ওড়ার কথা মাগরিবের পরপর। মওলানা সাহেবের দলের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন সম্ভবত বজলুল সাত্তার। তিনি অন্যান্য সঙ্গীসহ মওলানা সাহেবের ভাষণের ছাপানো পুস্তিকার কপিগুলো বিমানবন্দরে উপস্থিত। যাত্রী-দর্শনার্থী সবাই মওলানা সাহেবের আগমনের প্রতীক্ষায়। তার আসতে কেন বিলম্ব ঘটছে, সবার মধ্যে এই আলোচনা ও ব্যাকুলতা। শেষে বেদনাদায়ক খবর এলো। তিনি মক্কা যাত্রার আগেই সর্বশেষ মহাযাত্রায় চলে গেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
মরহুম মওলানার হজযাত্রী দল ‘ছাওতু বাংলাদেশ’ নিয়ে মক্কাধামে যাত্রা করে। আর বিমানবন্দরে উপস্থিত মওলানা সাহেবের ভক্ত-দর্শনার্থীরা ছুটলেন পিজি হাসপাতালের দিকে। আমিও তাদের সঙ্গে শামিল হয়ে মওলানাকে কফিনে দেখে মর্মাহত অবস্থায় প্রত্যাবর্তন করি। পরের দিন বিশাল জানাজা অনুষ্ঠান শোকে তাকে শেষ বিদায় জানানো হয়।
১৯৭৬ সালের ১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চের পর মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী মাত্র ৬ মাস জীবিত ছিলেন। তার অন্তিমকাল কেটেছে পিজি হাসপাতালে। এ সময় তিনি দেশ ও দেশের জনগণের চিন্তায় ছিলেন অস্থির। বিশেষত বাংলাদেশকে মরুভূমিতে পরিণত করার গভীর ষড়যন্ত্রের ফসল ফারাক্কা বাঁধ হতে কীভাবে বাংলাদেশের মানুষকে রক্ষা করা যায় সেই দুশ্চিন্তায় তার দিন অতিবাহিত হতো। তাই তিনি শয্যাশায়ী অবস্থায় দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ ছিলেন যে, তিনি হজে গমন করে বিশ্ব মুসলিমকে বাংলাদেশে উদ্ভূত করুণ পরিস্থিতি অবহিত করবেন এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সৃষ্ট সমস্যার বাস্তব চিত্র তুলে ধরবেন। তার প্রণীত সর্বশেষ ভাষণে তা স্পষ্ট প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি মুসলিম নেতৃবর্গকে আহ্বান জানিয়েছিলেন : আপনারা বাংলাদেশে এসে সরেজমিন প্রত্যক্ষ করে যান, ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করে বাংলাদেশকে কীভাবে মরুভূমিতে পরিণত করার ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। ভাষণের উপসংহারে মওলানা ভাসানী মুসলিম বিশ্বের নেতৃবর্গের নিকট আহ্বান জানিয়েছিলেন যে, ঢাকায় একটি আন্তর্জাতিক ইসলামী সম্মেলন অনুষ্ঠান করা উচিত, যাতে ফারাক্কা ইস্যুসহ মুসলিম বিশ্বের নানা সমস্যার সমাধানের উপায় বের করা যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্য, মওলানার সেই আশা পূরণ হয়নি। এমন কি তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সেই ঐতিহাসিক সর্বশেষ ভাষণটিও তিনি সরাসরি উপস্থাপন করতে পারেননি। মালাকুল মওত তাকে সেই সুযোগ দেয়নি। জানা যায়, ভাষণটি সউদী আরবের কোনো কোনো আরবি পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল এবং লন্ডনেও এ ভাষণ প্রচার হয়েছিল। বাংলাদেশে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ত্রৈমাসিক আরবি মুখপত্র ‘মাজ্যল্লা’-এর ১৯৭৬ সালের প্রথম ও দ্বিতীয় সংখ্যায় দীর্ঘ ভাষণের অংশবিশেষ প্রকাশ হয়েছিল। মওলানা ভাসানী স্মরণে আজ এসব কথা মনে পড়েছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।