Inqilab Logo

বুধবার ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ২১ কার্তিক ১৪৩১, ০৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পবিত্র শবে কদর হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম খুৎবা পূর্ব বয়ান

শামসুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ২২ এপ্রিল, ২০২২, ৩:২৭ পিএম

আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, " শবে কদর হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম; সে রাতে ফেরেশতাগণ ও রূহ (জিবরাঈল আ.) অবতরণ করেন প্রত্যেক কাজের জন্য তাদের রবের অনুমতিক্রমে। (সূরা কদর, আয়াত: ৩-৪)। মহান আল্লাহ এ বরকতময় রজনীতে মানবজাতির হিদায়াতের বাহক পবিত্র কোরআন অবতীর্ণ করেছেন। এর চেয়ে বড় কোনো নিয়ামতের কথা মানুষ কল্পনাও করতে পারে না। আজ জুমার বয়ানে মসজিদের পেশ ইমাম এসব কথা বলেন। রমজানের তৃতীয় জুমায় সারাদেশের মসজিদগুলোতে মুসল্লিদের ঢল নেমেছিল। মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভ ও গুনা মাফের জন্য মসজিদে মসজিদে মোনাজাতে মুসল্লিদের মাঝে কান্নাররোল পড়ে যায়। নগরীর মসজিদে গাউছুল আজমেও প্রচুর মুসল্লির সমাগম ঘটে।

ঢাকার শেওড়াপাড়া কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের ইমাম ও খতিব মুফতি সিফাতুল্লাহ রহমানি আজ জুমার বয়ানে বলেন, লাইলাতুল কদর এমন একটি রাত, যে রাতে আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক বস্তুুর সঠিক পরিমাণ নির্ধারণ করেন। এ বিষয়ে মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন, "হা-মীম, শপথ সুস্পষ্ট কিতাবের, আমি এই কিতাব অবতীর্ণ করেছি এক মুবারক রাতে, আমি অবশ্যই সতর্ককারী। এ রাতে প্রত্যেক হিকমতপূর্ণ বিষয় স্থির করা হয়, আমার আদেশক্রমে, আমি রাসূল প্রেরণকারী। তোমার রবের অনুগ্রহে, তিনি তো সর্বশ্রোতা। (সূরা দুখান, আয়াত: ১-৬)। আল্লাহ তায়ালা অন্য এক স্থানে বলেন: " শবে কদর হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম; সে রাতে ফেরেশতাগণ ও রূহ (জিবরাঈল আ.) অবতরণ করেন প্রত্যেক কাজের জন্য তাদের রবের অনুমতিক্রমে। (সূরা কদর, আয়াত: ৩-৪)।

খতিব বলেন,লাইলাতুল কদর একটি বরকতময় রজনী। মহান আল্লাহ তায়ালার নিকট যে রাতের অনেক মহত্ব ও ফযিলত রয়েছে। তার মহত্বের প্রমাণ স্বরূপ এটাই যথেষ্ট যে, মহান আল্লাহ এ রাতে মানবজাতির হিদায়াতের বাহক পবিত্র কোরআন অবতীর্ণ করেছেন। এর চেয়ে বড় কোনো নিয়ামতের কথা মানুষ কল্পনাও করতে পারে না। তাছাড়া পবিত্র কোরআনে লাইলাতুল কদরকে ১ হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর বলে ঘোষণা করেছে। 'লাইলাতুল কদর' এর ফযিলত সম্পর্কে মহান আল্লাহ তায়ালা সূরাতুল কদর নামে একটি সূরাই নাযিল করেছেন। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন: "নিশ্চয় আমি কোরআন অবতীর্ণ করেছি শবে কদরে (মর্যাদাপূর্ণ রাতে) আর শবে কদর সম্বন্ধে তুমি কী জানো? শবে কদর হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম; সে রাতে ফেরেশতাগণ ও রূহ (জিবরাঈল আ.) অবতরণ করেন প্রত্যেক কাজের জন্য তাদের রবের অনুমতিক্রমে, (এ রাতে) শান্তিই শান্তি, ফজর উদয় হওয়া পর্যন্ত। (সূরা কদর, আয়াত: ১-৫)।
হযরত আনাস বিন মালেক রা. থেকে বর্ণিত: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, "যখন লাইলাতুল কদর আসে তখন জিবরাঈল আ. অন্যান্য ফেরেশতাগণসহ পৃথিবীতে অবতরণ করেন এবং প্রত্যেক ঐ বান্দার জন্য রহমত ও মাগফিরাতের দোয়া করতে থাকেন যারা দাঁড়িয়ে, বসে মহান আল্লাহর স্বরণ ও ইবাদতে লিপ্ত থাকে। (শুয়াবুল ঈমান লিল বায়হাকী, হাদীস: ২৪৪৪)।

গুলিস্তানস্থ ফুলবাড়িয়া রেলওয়ে জামে মসজিদের খতিব আল্লামা মুহিউদ্দীন রাব্বানী জুমার খুৎবায় বলেন, রমজানের শেষ দশকের ইতিকাফ সুন্নতে মুআক্কাদা আলাল কেফায়া। অর্থাৎ মহল্লার জামে মসজিদে কোনো রোজাদার মুসলিম ইতিকাফ করলে সবার পক্ষ থেকে এ ধরনের সুন্নত আদায় হবে। তাই এলাকাবাসীর কেউ যদি ইতিকাফ না করে তা হলে সুন্নত ছেড়ে দেয়ার কারণে সবার সুন্নত তরকের গুনাহ হবে। ইতিকাফের মাহাত্ম্য ও তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভি (রহ.) বলেন, ‘মসজিদে ইতিকাফ হচ্ছে হৃদয়ের প্রশান্তি, আত্মার পবিত্রতা ও চিত্তের নিষ্কলুষতা; চিন্তার পরিচ্ছন্নতা ও বিশুদ্ধতা। ফেরেশতাকুলের গুণাবলি অর্জন এবং লাইলাতুল কদরের সৌভাগ্য ও কল্যাণ লাভসহ সব ধরনের ইবাদতের সুযোগ লাভের সর্বোত্তম উপায়। এ জন্য রাসূল (সা.) নিজে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ইতিকাফ পালন করেছেন এবং তাঁর বিবিরাসহ সাহাবায়ে কেরামের অনেকেই এই সুন্নতের ওপর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমল করেছেন।’ (হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা : ২/৪২)।

পবিত্র কোরআনে হজরত ইবরাহিম (আ.) ও ইসমাইল (আ.) এর কথা উল্লেখ করে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি ইবরাহিম ও ইসমাইলকে আদেশ করলাম, তোমরা আমার গৃহকে তাওয়াফকারী, ইতিকাফকারী ও রুকু-সিজদাকারীদের জন্য পবিত্র করো।’ (সূরা : বাকারা, আয়াত : ১২৫)। ইবনে উমার (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সা.) রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন।’ (মুসলিম, হাদিস নম্বর ১১৭১)। মদিনায় অবস্থানকালে রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রতিবছরই ইতিকাফ পালন করেছেন। শত ব্যস্ততা সত্তে¡ও রমজানে তিনি ইতিকাফ ছাড়েননি। আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসূল (সা.) প্রতি রমজানে ১০ দিন ইতিকাফ করতেন, তবে যে বছর তিনি ইন্তেকাল করেন, সে বছর তিনি ২০ দিন ইতিকাফে কাটান।’ (বুখারি, হাদিস : ১৯০৩)। ইতিকাফ একটি মহৎ ইবাদত। এ ইবাদত স্বেচ্ছায় পালনীয়। ইসলামী শরিয়তে বিনিময় দিয়ে ভাড়া করে ইবাদত করানোর সুযোগ নেই। টাকার বিনিময়ে ইতিকাফ করা ও করানো সম্পূর্ণ নাজায়েজ। এভাবে ইতিকাফ করানোর মাধ্যমে মহল্লাবাসী দায়মুক্ত হয় না। (রদ্দুল মুহতার : ২/৫৯৫, ফাতাওয়া মাহমুদিয়া : ১৭/১৭১)।
রমজানের সবচেয়ে ফজিলতপূর্ণ দিন হলো শেষ ১০ দিন। কেননা এ দশকেই রয়েছে পবিত্র শবেকদর। বিশেষ হেকমতের কারণে শবেকদরের দিনক্ষণ ঠিক করে দেয়া হয়নি। এর মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ইবাদতের প্রতি মনোনিবেশ করতে বলা হয়েছে। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে সওয়াবের আশায় শবেকদরে ইবাদত করবে, তার আগের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।’ (মুসলিম, হাদিস : ৭৬০; বুখারি, হাদিস : ২০১৪)। যারা এ রাতের রহমত ও বরকত থেকে বঞ্চিত, তারা সবচেয়ে হতভাগা। এই রাতে সূর্যাস্তের পর আল্লাহ তায়ালা প্রথম আসমানে অবতরণ করে বান্দাদের ডেকে ডেকে বলেন, ‘কে আছ অসুস্থ আমার কাছে চাও আমি শেফা দান করব, কে আছ অভাবগ্রস্ত আমার কাছে চাও আমি প্রাচুর্য দান করব, কে আছ বিপদগ্রস্ত আমার কাছে চাও আমি বিপদমুক্ত করে দেব।’ বিশেষত শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোতে রমজানের অন্যান্য রাতের তুলনায় বেশি বেশি ইবাদত, নফল নামাজ, তাসবিহ-তাহলিল ও কোরআন তেলাওয়াত করা চাই। শবেকদরের একটি বিশেষ আমল হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, “আমি রাসূল (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করেছি, ‘হে আল্লাহর রাসূল! যদি আমি শবেকদর পেয়ে যাই, তবে আল্লাহর কাছে কী দোয়া করব?’ রাসূল (সা.) বলেন, ‘এই দোয়া পড়বা আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুয়্যুন তুহিব্বুল আফওয়া ফা’ফু আন্নি।” অর্থ : হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাকারী এবং আপনি ক্ষমা করা পছন্দ করেন। সুতরাং আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন। আল্লাহ আমাদের সকলকে এই পুণ্যবান সময়কে ইতিকাফের মাধ্যমে কাজে লাগানোর তৌফিক দান করুন।

মিরপুরের বাইতুল আমান কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের খতিব মুফতি আবদুল্লাহ ফিরোজী আজ জুমার খুৎবা পূর্ব বয়ানে বলেন, রহমত মাগফিরাত ও নাজাতের বারিধারায় বিধৌত হয়ে পাপের পঙ্কিলতা থেকে পরিচ্ছন্ন ও শুদ্ধ হওয়ার মাস রমজান চলছে। রমজানের গুরুত্বপূর্ণ শেষ দশক আমাদের সামনে সমাগত। শেষ দশকে ইতিকাফের মাধ্যমে একজন গুনাহগার বান্দা আল্লাহর কাছে সম্মানিত হয়ে যায়। জাহান্নাম থেকে মুক্তির মহা নেয়ামত অর্জিত হয় শেষ দশকের ইতিকাফের মাধ্যমে। ইতিকাফ একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যমÐিত ইবাদত। ইতিকাফের মাধ্যমে মানুষ দুনিয়ার সবকিছু ছেড়ে আক্ষরিক অর্থেই আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যায়। হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রা. বর্ণনা করেন, নবী কারীম সা. আজীবন রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করেছেন। তার ইন্তেকালের পর তার স্ত্রীগণও ইতিকাফ করতেন। (বুখারী, মুসলিম)। খতিব আরও বলেন, ইতিকাফের অন্যতম উদ্দেশ্য হল শবে কদর প্রাপ্তি। রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করলে শবে কদর প্রাপ্তি নিশ্চিত হয়ে যায়। হযরত আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে সওয়াবের নিয়তে কদরের রাত জেগে ইবাদত করবে, তার অতীতের গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে। (বুখারী)। শবে কদর রমজানের মধ্যেই। রাসূলে কারীম সা. বলেছেন: ‘তোমরা রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোতে শবে কদরকে তালাশ করো। (মুসলিম)। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে আমল করার তৌফিক দান করেন, আমীন।
রাজধানী ঢাকার কামরাঙ্গীরচর রহমতিয়া জামে মসজিদের খতিব মুফতি সুলতান মহিউদ্দীন জুমার বয়ানে বলেছেন, লাইলাতুল কদর বা কদরের রাত্রিতে সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানি কিতাব পবিত্র কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে। শবে কদরের রাতে ইবাদত করা হাজার মাস ইবাদত করার চেয়েও বেশি ফজিলত রাখে। শবে কদরের ফজিলত অন্য কোন উম্মতকে দেয়াা হয়নি, শুধু আখেরি নবীর উম্মতকেই দেয়া হয়েছে। শ্রেষ্ঠ নবীর শ্রেষ্ঠ উম্মত উম্মতগণ অল্প হায়াত পেয়েও অন্যান্য উম্মতের চেয়ে নেকিতে পিছিয়ে না থাকে সেজন্যই এই উম্মতকে এ ফজিলতপূর্ণ রাত্রি দান করা হয়েছে। কদরের রাত্রি নির্দিষ্ট করা হয়নি। তবে রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রজনীতে তালাশ করতে প্রিয়নবী সা. ইরশাদ করেছেন। আল্লাহ আমাদের সকলকে এ মহান নেয়ামত কদর অর্জনে বেশি করে ইবাদাত-বন্দেগি করার তৌফিক দান করুন, আমীন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ