বাংলা সাহিত্যে মহররম
ম. মী জা নু র র হ মা নআরবি মাস ‘মহররম’-এর ১০ তারিখ প্রতিটি মুসলমান ব্যক্তি-মানসে শোক দিবস হিসেবে চিহ্নিত। এই দিন ইরাকের ফোরাত নদীর
ড. আ ফ ম খা লি দ হো সে ন
মহররম মাসের দশম তারিখ ইতিহাসে ‘আশুরা’ নামে অভিহিত। প্রাচীনকালের নানা জনগোষ্ঠীর নিকট ‘আশুরা’ পবিত্র ও মর্যাদাপূর্ণ। ইহুদীদের নিকট ‘আশুরা’ জাতীয় মুক্তি দিবস হিসেবে পরিচিত। ‘আশুরা’র মর্যাদা ইসলামেও স্বীকৃত। মুসলমানগণ রোযা পালনের মাধ্যমে ‘আশুরা’র মাহাত্ম্য স্মরণ করে থাকে। আশুরার দিনে পৃথিবীর বহু চাঞ্চল্যকর ঘটনা সংঘটিত হয়। আসমান-জমিন, আরশ-কুরসী ও আদি পিতা আদম (আ.)-এর সৃষ্টি, ধরা পৃষ্ঠে প্রথম বারিবর্ষণ, হযরত নূহ (আ.)-এর জাহাজ মহাপ্লাবন শেষে জুদী পাহাড়ে অবতরণ, ফিরআউনের নির্যাতন থেকে হযরত মূসা (আ.) কর্তৃক ইহুদীদের উদ্ধার, দুরারোগ্য ব্যাধি হতে হযরত আয়ূব (আ.)-এর সুস্থতা লাভ, মৎস্য উদর হতে হযরত ইউনুস (আ.)-এর নির্গমণ, হযরত সুলায়মান (আ.)-কে পৃথিবীর একচ্ছত্র রাজত্ব প্রদান, নমরুদের অগ্নিকু- হতে হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর নিষ্কৃতি, হযরত ইয়াকুব (আ.)-এর চক্ষুজ্যোতি পুনঃপ্রাপ্তি, কূপ হতে হযরত ইউসুফ (আ.)-কে উদ্ধার, হযরত ইদরিস (আ.) ও হযরত ঈসা (আ.)কে আসমানে উত্তোলন, কারবালায় হযরত হোসাইন (রা.)-এর শাহাদাতসহ বিপুল ঐতিহাসিক ঘটনার নীরব সাক্ষী ‘আশুরা’ (মুফতী আশফাক আলম কাসেমী, ফাযায়েলে মুহাররম, পৃ. ৩৫-৩৬)।
মদীনায় হিযরতের পর রাসূলুল্লাহ (সা.) লক্ষ্য করেন যে, ইহুদীরা ‘আশুরা’ দিবসে রোযা রাখছে। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন এটা কোন দিন যাতে তোমরা রোযা রেখেছ? তারা বলল, এটা এমন এক মহান দিবস, যেদিন আল্লাহ তা‘য়ালা হযরত মুসা (আ.) ও তার সম্প্রদায়কে মুক্তি প্রদান করেছিলেন, ফেরাউনকে তার সম্প্রদায়সহ ডুবিয়ে মেরেছিলেন। তাই হযরত মুসা (আ.) কৃতজ্ঞতা স্বরূপ এদিন রোযা রাখেন, এ জন্য আমরাও রোযা রাখি। এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, “তোমাদের চেয়ে আমরা মূসা (আ.)-এর অধিকতর ঘনিষ্ঠ ও নিকটবর্তী। অতঃপর রাসূলুলল্লাহ সা. রোযা রাখেন এবং অন্যদেরও রোযা রাখার নির্দেশ দেন” (সহীহ মুসলিম, ১/৩৫৯)।
হযরত আবু হোরায়রা (রা)-হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, “রমযানের পর সব রোযার (নফল) মধ্যে আশুরার রোযা সর্বশ্রেষ্ঠ” (জামে তিরমিযী ১/১৫৬)। পবিত্র আশুরার দিন রোযা রাখার ফযিলত সম্পর্কে তিনি আরো বলেন, “আমি আশা করি যে ব্যক্তি ‘আশুরা’ দিবসে রোযা রাখবে তার এক বছরের বছরের গুনাহের কাফ্ফারা (ক্ষমা) হয়ে যাবে” (মুসলিম, ১/৩৬৭)। আশুরার দিন রোযা রাখলে ইহুদীদের সাথে সাদৃশ্য হয়ে যায় বিধায় রাসূলুল্লাহ (সা.) তার আগের দিন বা পরের দিন আরেকটি রোযা রাখার পরামর্শ দেন (মুসনাদ আহমদ)।
শায়খুল হাদীস আল্লামা মুফতি তাকী ওসমানী বলেন, হাদীসের এক দুর্বল বর্ণনায় আছে আশুরার দিন কেউ যদি পরিবার-পরিজনের জন্য অপেক্ষাকৃত ভাল ও উন্নত খাবারের ব্যবস্থা করে আল্লাহ তায়ালা তার রুজিতে বরকত দান করবেন (ইসলাহী খুতবাত, ১৪খ-, পৃ. ৬২-৬৩)
৬৮০ খ্রিস্টাব্দের ১০ অক্টোবর (৬০ হিজরীর ১০ মহররম) কারবালা প্রান্তরে মহানবীর দৌহিত্র হযরত হোসাইন (রা.) মর্মান্তিক শাহাদাত ‘আশুরা’কে তাৎপর্যম-িত করে। খিলাফত ব্যবস্থার পুনর্জ্জীবন ছিল হযরত হোসাইন (রা.)-এর সংগ্রামের মূল লক্ষ্য। মুসলিম জাহানের বিপুল মানুষের সমর্থন ছিল তাঁর পক্ষে। হযরত হোসাইন (রা.)-এর গৃহীত পদক্ষেপ ছিল বীরত্বপূর্ণ। মদীনার পরিবর্তে দামিস্কে রাজধানী স্থানান্তর, উমাইয়াদের অনৈসলামিক কার্যকলাপ, কুফাবাসীদের বিশ্বাসঘাতকতা সর্বোপরি ইহুদী আবদুলল্লাহ ইব্ন সাবা’র ষড়যন্ত্র কারবালা হত্যাকা-ের জন্ম দেয়। ইয়াজিদের বিরুদ্ধে কুফাবাসীদের সাহায্যের প্রতিশ্রুতিতে আশ্বস্ত হয়ে হযরত হোসাইন (রা.) স্ত্রী, পুত্র, বোন ও ঘনিষ্ঠ ২০০ অনুচর সহকারে ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দে কুফার উদ্দেশ্যে রওনা হন। ফোরাত নদীর তীরবর্তী কারবালা নামক স্থানে পৌঁছলে কুফার গভর্নর ওবায়দুল্লাহ ইব্ন যিয়াদ তাঁকে বাধা প্রদান করে। রক্তপাত বন্ধের উদ্দেশ্যে ইমাম হোসাইন (রা.) তিনটি প্রস্তাব পেশ করেন, প্রথমত তাঁকে মদীনায় ফিরে যেতে দেয়া হোক নতুবা দ্বিতীয়ত, তুর্কী সীমান্তের দূর্গে অবস্থান করতে দেয়া হোক; তৃতীয়ত, অথবা ইয়াজিদের সাথে আলোচনার জন্য দামেস্কে প্রেরণ করা হোক। কিন্তু ওবায়দুল্লাহ ইব্ন যিয়াদ নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে তার হাতে আনুগত্যের শপথ নিতে আদেশ দেন। হযরত হোসাইন (রা.) ঘৃণাভরে তার এ আদেশ প্রত্যাখ্যান করেন। ঐতিহাসিক উইলিয়াম মুইর ইমাম হোসাইন (রা.)-এর প্রস্তাব সম্পর্কে বলেন, “সংলাপের এ অনুরোধ যদি মেনে নেয়া হতো, উমাইয়াদের জন্য মঙ্গল বয়ে আনতো” (ডবষষ যধফ রঃ নববহ ভড়ৎ ঃযব টসধুুধফ যড়ঁংব, রভ ঃযব ঢ়ৎধুবৎ যধফ নববহ ধমৎববফ ঃড়.)।
অবশেষে ওবায়দুল্লাহ ইব্ন যিয়াদ-এর ৪ হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী ইমাম হোসাইন (রা.)-কে অবরুদ্ধ করে ফেলে এবং ফোরাত নদীতে যাতায়তের পথ বন্ধ করে দেয়। হযরত হোসাইন (রা.)-এর শিবিরে পানির হাহাকার উঠে। তিনি ইয়াজিদ বাহিনীর উদ্দেশ্যে প্রদত্ত এক ভাষণে বলেন, আমি যুদ্ধ করতে আসিনি এমন কি নিছক ক্ষমতা দখল আমার উদ্দেশ্য নয়; খিলাফতের ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার আমার কাম্য। ১০ মুহাররম ইয়াজিদ বাহিনী তাঁর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সংঘটিত এ অসম যুদ্ধে একমাত্র পুত্র ইমাম যায়নুল আবেদীন ব্যতীত ৭০ জন পুরুষ শহীদ হন। ইমাম হোসাইন (রা.) মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই করে যান; অবশেষে শাহাদত বরণ করেন। ইমাম হোসাইন (রা.)-এর ছিন্ন মস্তক বর্ষা ফলকে বিদ্ধ করে দামেস্কে প্রেরিত হয়। ইয়াজিদ ভীত ও শঙ্কিত হয়ে ছিন্ন মস্তক প্রত্যার্পণ করলে কারবালায় পবিত্র দেহসহ তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। ইতিহাসবিদ গীবন বলেন, “সেই দুরবর্তী যুগে ও পরিবেশে হযরত হোসাইনের মৃত্যুর শোকাবহ দৃশ্য কঠিনতম পাঠকের হৃদয়ে সমবেদনার সঞ্চার করবে” (ওহ ধ ফরংঃধহঃ ধমব ধহফ পষরসধঃব ঃযব ঃৎধমরপ ংপবহব ড়ভ ঃযব ফবধঃয ড়ভ ঐঁংধুহ রিষষ ধধিশবহ ঃযব ংুসঢ়ধঃযু ড়ভ ঃযব পড়ষফবংঃ ৎবধফবৎ.)। ইতিহাস সাক্ষী ইমাম হোসাইন (রা.)-কে কারবালা প্রান্তরে যারা নির্মমভাবে হত্যা করেছিলো মাত্র ৫০ বছরের ব্যবধানে তাদের প্রত্যেকের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে করুণপন্থায়। ইায়াজি বাহিনী কর্তৃক পবিত্র মক্কানগরীর ‘কা’বাগৃহ’ অবরোধকালীন ইয়াজিদের মৃত্যুঘটে (আল্লামা মুফতী মুহাম্মদ শফী (রহ.)।
‘আশুরা’-এর শিক্ষা বহুমাত্রিক ১. অন্যায় ও অসত্যের কাছে মাথা নত না করা; ২. আলোচনা ও সংলাপের সুযোগ আসলে তা গ্রহণ করা; ৩. জালিম ও ঘাতকের বিচার পৃথিবীতে হয়ে যায়, বাকি থাকে কেবল পরকালীন বিচার: ৪. স্বৈরাচারী শাসকদের পতন অনিবার্য।
কারবালার যুদ্ধে জয়লাভ ইয়াজিদ তথা উমাইয়া বংশের জন্য ছিল পরাজয়ের নামান্তর। এ বিয়োগান্তক ঘটনা বিভিন্ন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জন্ম দেয়, পারস্যে জাতীয়তাবাদের উম্মেষ ঘটায় এবং সর্বোপরি ইসলামী রাষ্ট্রের জন্য সমূহ বিপর্যয় ডেকে আনে। কারবালার শোকাবহ হত্যাকা- মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র শিহরণ জাগিয়ে তোলে। ইমাম হোসাইন (রা.) অন্যায় ও অসাধুতার সাথে আপোষ করেননি। তাঁর এ শাহাদত গৌরবোজ্জ্বল আদর্শরূপে পরিগণিত হয়। তাই ‘আশুরা’ মুসলমানদের আত্মোপলব্ধিকে জাগ্রত করে।
স্মর্তব্য যে, আশুরাকে কেন্দ্র করে আমাদের সমাজে এমন কিছ কর্মকা- সংঘটিত হয় যা শরীয়ত সমর্থিত নয়। আলোক সজ্জা, আতশবাজি, হালুয়া-রুটি বিতরণ, দু’টি কবুতর জবাই, ‘সত্তর দানাভাত’ পাকানো, কালো কাপড় পরিধান, বিয়ে শাদী না করা, নতুন ঘর নির্মাণ বন্ধ রাখা, নতুন জামা পরিধান না করা, জারিগান, বক্ষে-পিঠে ছুরিকাঘাত এর সাথে আশুরার কোন সম্পর্ক নেই। বরং এসব বিদআতি কর্মকা- আশুরার ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে ম্লান করে দেয়।
লেখক: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ওমর গণি এম.ই.এস ডিগ্রী কলেজ, চট্টগ্রাম।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।