Inqilab Logo

মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কুড়িগ্রামে যে সংঘাতে ১৬ জন ভারতীয় রক্ষী নিহত হয়

অনলাইন ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ১৮ এপ্রিল, ২০২১, ১০:১৩ এএম

বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলা কুড়িগ্রামের একটি গ্রাম বড়াইবাড়ি। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের লাগোয়া এই গ্রামটি অবস্থিত।

২০০১ সালের ১৮ই এপ্রিল এই গ্রামে ঘটে যায় বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ।

সে সংঘর্ষে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বা বিএসএফ'র ১৬ জন সৈন্য নিহত হয় এবং বাংলাদেশের তৎকালীন সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিডিআরের (এখন বিজিবি) ২ জন সৈন্য নিহত হয়। বড়াইবাড়ি গ্রামে সীমান্তের অপর পাশে ভারতের আসাম রাজ্যের সীমান্ত।

১৮ই এপ্রিল ভোর রাতে বড়াইবাড়ি গ্রামের কয়েকজন বাসিন্দা তাদের কৃষিজমিতে সেচ কাজ দেখতে যান।

এসময় তারা দেখতে পান ধানক্ষেতে বহু সৈন্য অস্ত্র নিয়ে হাঁটছে। এই সৈন্যদের মধ্যে কয়েকজন এসে গ্রামবাসীর কাছে হিন্দি ভাষায় জানতে চান, বিডিআরের ক্যাম্প কোথায়?
তখন গ্রামবাসী বুঝতে পারেন এরা ভারতের বিএসএফের সদস্য।

বাংলাদেশের সীমান্তের ভেতরে বিএসএফ ঢুকে পড়ার খবরটি বেশ দ্রুত বড়াইবাড়ি বিডিআর ক্যাম্পে পৌঁছে দেন সাইফুল ইসলাম লাল। তিনি নিজেও আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত।

সাইফুল ইসলাম লাল যখন বিডিআর ক্যাম্পে যান তখন সেই ক্যাম্পে মাত্র আটজন বিডিআর সদস্য ছিল।

"ক্যাম্পের ভেতরে গিয়ে আমি বিডিআরকে বললাম যে বিএসএফ আমাদের এলাকায় ঢুকে পড়েছে। তখন বিডিআর সদস্যরা অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুতি নেয়। কিছুক্ষণ পরে আমি প্রস্রাব করার জন্য বাইরে এসে পুকুরের অপর পাড়ে বিএসফ সদস্যদের দেখি," বলেন সাইফুল ইসলাম লাল।

"দৌড়ে ক্যাম্পের ভেতরে ঢুকে এই খবর জানাই। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় ফায়ার। শত শত গুলি, চারিদিক থেকে গুলি। আমিও তখন অস্ত্র হাতে তুলে নিলাম।"

প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা মতে ভোর পাঁচটা থেকে তীব্র গোলাগুলির আওয়াজে প্রকম্পিত হয়ে উঠে বড়াইবাড়ি গ্রাম ও তার আশপাশের এলাকা। প্রচণ্ড গোলাগুলিতে গ্রামবাসী তাদের বাড়িঘর ফেলে পালিয়ে যেতে থাকে।

তখন এই ঘটনা খুব কাছ থেকে দেখেছেন স্থানীয় বাসিন্দা রুহুল আমিন, যিনি ২০১৪ সালে সে এলাকার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।

যেদিন বিএসএফ বড়াইবাড়ি আক্রমণ করে সেদিন স্থানীয় মানুষজনকে সংগঠিত করার কাজ করেছিলেন রুহুল আমিন।

বিএসএফকে প্রতিরোধ করার জন্য বিডিআরের সহায়তায় আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ১২জন সদস্যকে একত্রিত করেন রুহুল আমিন।

তিনি বলেন, বিএসএফ যখন বাংলাদেশের ভেতরে ঢোকে তখন অনেক গ্রামবাসী পালিয়ে গেলেও পরবর্তীতে আবার ফিরে আসে। এরপর তারা বিডিআরের সাথে মিলে বিএসএফের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।

"ভোর পাঁচটা থেকে এগারোটা পর্যন্ত বড়াইবাড়ি গ্রামে বিভীষিকা মুহূর্ত ছিল। দুপক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড গোলাগুলি হয়," বলেন রুহুল আমিন।

বড়াইবাড়ি বিডিআর ক্যাম্পের ভেতরে থাকা সাইফুল ইসলাম লাল বিবিসি বাংলাকে বলেন, ক্যাম্প থেকে তিনি দেখেছেন আনুমানিক কয়েকশ বিএসএফ সদস্য বাংলাদেশের ভেতরে প্রবেশ করেছিল।

সাইফুল ইসলাম লালের বর্ণনা মতে, বড়াইবাড়ি বিডিআর ক্যাম্পের আটজন সদস্য প্রচণ্ড মনোবল এবং সাহস নিয়ে প্রথম চারঘন্টা লড়াই চালিয়ে গেছেন।

এরই মধ্যে আশপাশের আরো দুটি বিডিআর ক্যাম্প থেকে আরো ২০জন সদস্য বড়াইবাড়িতে আসেন। তারা গ্রামের বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান নিয়ে বিএসএফকে প্রতিহত করে।

বড়াইবাড়িতে যখন তীব্র সংঘর্ষ চলছে তখন ঢাকায় তৎকালীন বিডিআর (এখন বিজিবি) সদরদপ্তরের নির্দেশনায় জামালপুর এবং ময়মনসিংহ থেকে আরো বিডিআর সদস্য পাঠানো হয় কুড়িগ্রামের বড়াইবাড়িতে।

ময়মনসিংহ এবং জামালপুর থেকে সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ বিডিআর সদস্যরা বড়াইবাড়িতে গিয়ে পৌঁছান।

রুহুল আমিন বলেন, ১৮ই এপ্রিল ভোর পাঁচটা থেকে সকাল এগারোটা পর্যন্ত একটানা গোলাগুলি হয়।

এরপর কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে আবারো শুরু হয় গোলাগুলি। এভাবে ১৮ই এপ্রিল সারাদিন এবং রাত গড়িয়ে ১৯শে এপ্রিল রাত পর্যন্ত থেমে থেমে গোলাগুলি চলে।

বড়াইবাড়ি সংঘাতে ১৬জন বিএসএফ সদস্যের মৃতদেহ পাওয়া যায় বাংলাদেশের সীমান্তের ভেতরে।

স্থানীয় বাসিন্দা এবং তৎকালীন বিডিআর সদস্যদের দাবি ছিল, সে ঘটনায় বিএসএফ'র আরো বেশি সৈন্য মারা গেলেও অনেকের মৃতদেহ তারা ভারতে নিয়ে গেছে।

বড়াইবাড়ির বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম লাল উল্লেখ করেন, যে ১৬জন সৈন্যের মৃতদেহ নিতে পারেনি সেগুলো বাংলাদেশের সীমান্তের ভেতরে ধানক্ষেতে পাওয়া যায়।

কেন রৌমারি আক্রমণ?
কুড়িগ্রাম সীমান্তে বিএসএফ আক্রমণ করার একটি পটভূমি রয়েছে।

বিডিআরের তৎকালীন মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) ফজলুর রহমান ২০১২ সালে বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, এ ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল সিলেটের পদুয়াতে। সেখানে বাংলাদেশের সীমান্তের ভেতরে ভারতের বিএসএফ একটি ক্যাম্প করে দীর্ঘদিন সে জায়গা দখল করে আছে।

সিলেটের পদুয়ায় বিএসএফের সে ক্যাম্প নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে কোন উত্তেজনা ছিল না।

২০০১ সালের প্রথম দিকে ভারতের বিএসএফ তাদের পাশের আরেকটি ক্যাম্পের সাথে সংযোগ সড়ক নির্মাণ শুরু করে বাংলাদেশের সীমান্তের ভেতর দিয়ে।

এই রাস্তা নির্মাণ নিয়ে বাংলাদেশের বিডিআর আপত্তি তুললেও ভারতের বিএসএফ তাতে কর্ণপাত না করে তাদের কাজ অব্যাহত রাখে।

এমন অবস্থায় বিডিআরের সে এলাকায় তাদের একটি অস্থায়ী অপারেশনাল ক্যাম্প স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়।

"আমরা পদুয়াতে যাই এবং সেখানে তিনটা ক্যাম্প স্থাপন করি। বিএসএফ সেখানে ছয়টা ফায়ার করে। এরপর তারা প্রায় ৭০ জনের মতো সেখানে সারেন্ডার করে। আমরা পদুয়া দখল করে নিয়েছি।"

তিনি বলেন, পদুয়ার ঘটনার জের ধরে কুড়িগ্রামের রৌমারী সীমান্তের বড়ইবাড়ি বিডিআর ক্যাম্প দখলের জন্য বিএসএফ বাংলাদেশের ভেতরে ঢোকে।


রৌমারি সংঘাত ও ষড়যন্ত্র তত্ত্ব
রৌমারি সংঘাতের পর অনেকে বিডিআরের ভূমিকাকে 'সাহসী' হিসেবে বর্ণনা করেন। আবার কেউ কেউ তখন এর ভিন্ন ব্যাখ্যা তুলে ধরেন।

বিডিআর'র তৎকালীন মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) ফজলুর রহমানের ভূমিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছিল।

অনেকে মনে করেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারকে বিপদে ফেলার জন্যই এই ঘটনা হয়েছিল।

রৌমারীর ঘটনার পর মেজর জেনারেল ফজলুর রহমানকে বিডিআরের প্রধানের পদ থেকে সরিয়ে সেনাবাহিনীতে ফেরত আনা হয়।

এরপর ২০০১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর সেনাবাহিনী থেকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয় মেজর জেনারেল ফজলুর রহমানকে।

২০১২ সালে বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে মেজর জেনারেল (অব.) ফজলুর রহমান বলেন, সে ঘটনার জন্য তাকে দায়ী করা হলেও এর কোন ভিত্তি নেই।


"অনেকে বলেন শেখ হাসিনার সরকারকে বিপদে ফেলার জন্য আমি এটা করেছিলাম। কেউ কেউ বলেন যে বাংলাদেশ ভারতের মধ্যে গণ্ডগোল সৃষ্টির জন্য আমি এটা করেছিলাম।"

জেনারেল রহমান বলেন, "আপনারাই বিচার করুন। বর্ডারে রক্ষণাবেক্ষণ করবার দায়িত্বেই আমাকে নিয়োজিত করা হয়েছে। আমি যদি ঐ সময়ে আপোষ করতাম, তাহলে এই সমালোচনা আমাকে শুনতে হতো না। আমার তো কাজই হলো সীমান্ত রক্ষা করা এবং সীমান্তের মানুষের জানমালের নিরাপত্তা দেয়া।" বিবিসি বাংলা



 

Show all comments
  • MD.BORATUZZAMAN ১৮ এপ্রিল, ২০২১, ১১:০৬ এএম says : 0
    Valo Korcen .....Apni akjon Pokrito Des Premik
    Total Reply(0) Reply
  • ম নাছিরউদ্দীন শাহ ১৮ এপ্রিল, ২০২১, ১১:৩৪ এএম says : 0
    সিমান্তে যুদ্ধ করে বিজয়ী বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের অতদ্র প্রহরী বীর সৈনিক যাকে রাষ্ট্র কতৃক জাতির শ্রেষ্ঠ ও সাহসিকতার জন্যে পুরুস্কার প্রদান করা উচিৎ ছিলো। বিচিত্র দেশ আওয়ামীলীগ বিএনপির পক্ষথেকে পুরুস্কারের ইতিহাস পড়ে মর্মাহত হলাম। ভারতীয়রা আমাদের কে কাটাতারের বেড়া দিয়ে ক্লান্ত হননি বর্ডারে পাখির মত নির্বিচারে মানুষ হত‍্যা করছে তীব্র প্রতিবাদ কোথায়। প্রতিবাদীদের করুন পরিণতির শিরোনাম হলো আন্তর্জাতিক গন মাধ্যমে।
    Total Reply(0) Reply
  • MD Akkas ১৮ এপ্রিল, ২০২১, ১২:৩৯ পিএম says : 0
    ধন্যবাদ আসলে আপনি যেদিকে যাই সেদিকেই বিপদ ছিল। আমাদের দেশ তো এ বিচার করার ক্ষমতা কবেই হারিয়েছে। আপনি একমাত্র বাংলাদেশের বন্ধু বাংলাদেশকে ভালবাসেন মাতৃভূমিকে ভালোবাসেন স্যালুট স্যার আপনাকে।
    Total Reply(0) Reply
  • Minuar Rased ১৯ এপ্রিল, ২০২১, ৯:০৪ পিএম says : 0
    Thanks sir
    Total Reply(0) Reply
  • Minuar Rased ১৯ এপ্রিল, ২০২১, ৯:০৫ পিএম says : 0
    Thanks sir
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভারত-বাংলাদেশ


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ