পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
নিকাহ এবং তালাক নিবন্ধনে বিশৃঙ্খলা চলছে। এক ধরণের নিয়ন্ত্রণহীনতাও রয়েছে নিকাহ রেজিস্ট্রারদের (কাজী) কার্যক্রমে। তাদের নিয়ন্ত্রণ, নিয়োগ, স্থায়ীকরণ, জবাবদিহিতা, শাস্তি ও প্রণোদনা নিশ্চিতকরণে প্রশ্ন রয়েছে। নিকাহ রেজিস্ট্রারদের বৈধ এবং ভুয়া বিতর্ক, অধিক্ষেত্র জটিলতা, মিথ্যা মামলা-হয়রানির জটিলতা। তদুপুরি ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে বিয়ে এবং বিচ্ছেদ নিবন্ধিত হওয়ায় নানা জটিলতার উদ্ভব হচ্ছে। ঘণীভ‚ত হচ্ছে সামাজিক সঙ্কটও। বিষয়গুলো একটি অন্যটির সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাই এক রৈখিক বিশ্লেষণ ও দৃষ্টিভঙ্গি কখনও সঙ্কটের আশু সমাধান দিতে পারবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, নিকাহ-তালাক নিবন্ধনে ডিজিটাল পদ্ধতি আরোপের আগে প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোও বিবেচনায় নেয়া।
কেস স্ট্যাডি (এক) : গতবছর ১ ডিসেম্বর ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৭৩ নম্বর ওয়ার্ডে শূন্য আসনে স্থায়ী নিকাহ রেজিস্ট্রার নিয়োগের দরখাস্ত আহ্বান করেন ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রার। এ প্রেক্ষিতে ওই ওয়ার্ডের স্থায়ী বাসিন্দা দাবি করে প্রার্থী হিসেবে আবেদন করেন মো. মহিবুল্লাহ। আবেদনে ঠিকানা উল্লেখ করেন, ‘শেখের জায়গা, বাসাবো, সবুজবাগ, ঢাকা। কিন্তু এলাকাটি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নবগঠিত ৭৫ নম্বর ওয়ার্ডের আওতায়।
একই ব্যক্তি এর আগে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৬৭ নম্বর ওয়ার্ডের নিকাহ রেজিস্ট্রার নিয়োগ লাভের জন্যও আবেদন করেন। সেখানে তিনি ঠিকানা উল্লেখ করেন, ‘দক্ষিণ টেংরা (বক্সনগর), সারুলিয়া, ডেমরা, ঢাকা। এরও আগে মো. মহিবুল্লাহ ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৬৭ নম্বর ওয়ার্ডের নিকাহ রেজিস্ট্রার পদের জন্য প্রার্থী হয়েছিলেন। সেখানে ঠিকানা উল্লেখ করেন, ‘কাজলা পাড়, দনিয়া, যাত্রাবাড়ী, ঢাকা’।
এভাবে দেখা যায়, ঢাকা দক্ষিণ সিটির যে ওয়ার্ডেই নিকাহ রেজিস্ট্রার নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়, মো. মহিবুল্লাহ সেই এলাকারই একটি ঠিকানা ব্যবহার করে প্রার্থী হয়ে যান। অথচ নিকাহ ও তালাক রেজিস্ট্রার নিয়োগের বিজ্ঞপ্তিতে প্রার্থীর যোগ্যতার শর্তই হচ্ছে আবেদনকারীকে সংশ্লিষ্ট এলাকার বাসিন্দা হতে হবে। ভোটার তালিকার তথ্য অনুযায়ী মো. মহিবুল্লাহ ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৭৫ নম্বর ওয়ার্ডের ভোটার (বাসিন্দা)। এভাবে নিজ এলাকার বাইরে গিয়ে নিকাহ রেজিস্ট্রার হিসেবে নিয়োগ নিয়েছেন অনেকে। ফলে নিকাহ রেজিস্ট্রারদের অধিক্ষেত্র নিয়ে তৈরি হচ্ছে জটিলতা।
আইন মন্ত্রণালয়ের বিচার শাখা-৭ নিকাহ রেজিস্ট্রারদের নিয়োগের বিষয়টি দেখে থাকে। পর্যাপ্ত যাচাই-বাছাই ছাড়া নিয়োগ প্রদানের অভিযোগ রয়েছে মন্ত্রণালয়ের এই বিভাগটির বিরুদ্ধে। মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে এক অধিক্ষেত্রে একাধিক নিকাহ রেজিস্ট্রার (স্থায়ী-অস্থায়ী) নিয়োগেরও অভিযোগ পাওয়া যায়।
কেস স্ট্যাডি (দুই) : ২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারি মুসলিম বিবাহ ও তালাক (নিবন্ধন) বিধিমালা, ২০০৯ (সংশোধিত বিধিমালা, ২০১৩) ও ৬ক বিধি অনুযায়ী মো. ওমর ফারুককে ঢাকার বাড্ডা ইউনিয়নের ১, ২, ৩ ও ৫নং ওয়ার্ডের অস্থায়ী নিকাহ রেজিস্ট্রার নিয়োগ দেয়া হয়। আইন মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সিনিয়র সহকারী সচিব মো. হেমায়েত উদ্দিন স্বাক্ষরিত ওই নিয়োগের ৪ নম্বর শর্তে বলা হয়, বিধি মোতাবেক স্থায়ী নিয়োগ হওয়ার সাথে সাথে অস্থায়ী নিকাহ রেজিস্ট্রি লাইসেন্স স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে। শর্তযুক্ত এই নিয়োগ আদেশটি জালিয়াতি করে নিজেকে স্থায়ী নিকাহ রেজিস্ট্রার দাবি করছেন ওমর ফারুক।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের ২০ নভেম্বর মন্ত্রণালয়ের বিচার শাখা-৭ এর সিনিয়র সহকারী সচিব বুলবুল আহমেদ ঢাকার বাড্ডা থানার ১, ২, ৩ ও ৫নং ওয়ার্ডের নিকাহ রেজিস্ট্রার হিসেবে ওমর ফারুককে একটি চিঠি দেন। এতে ওমর ফারুকের অধিক্ষেত্রটি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নবগঠিত ৩৭ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্ভুক্ত করে তার লাইসেন্সটি ৩৭ নম্বর ওয়ার্ডের অস্থায়ী নিকাহ রেজিস্ট্রার লাইসেন্স হিসেবে গণ্য করা হয়।
চিঠির কপি দেয়া হয় আইন ও বিচার বিভাগের সচিবের একান্ত সচিবকে। কিন্তু এই চিঠিটির অস্থায়ী শব্দটির স্থলে নিজেই স্থায়ী শব্দ বসিয়ে ৩৭ নম্বর ওয়ার্ডের স্থায়ী নিকাহ রেজিস্ট্রার হিসেবে মো. ওমর ফারুক এখন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে কথিত এ নিয়োগটির যথার্থতা প্রশ্নে জনৈক খায়রুল ইসলাম একটি সিআর মামলা করেন।
এ প্রেক্ষিতে বিচার-৭ শাখার সিনিয়র সহকারী সচিব শফিকুল ইসলাম গত ১৪ ফেব্রæয়ারি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে এই মর্মে মতামত দেন। তাতে তিনি উল্লেখ করেন, মো. ওমর ফারুককে নবগঠিত ৩৭ নম্বর ওয়ার্ডের অস্থায়ী নিকাহ রেজিস্ট্রার হিসেবে গণ্য করার নিয়োগ আদেশটি সঠিক। অদ্যাবধি তার নামে কোনো স্থায়ী নিকাহ রেজিস্ট্রার লাইসেন্স ইস্যু করা হয়নি। এ দু’টি ঘটনা হাজার জটিলতার দৃষ্টান্ত মাত্র। এমন বহুমাত্রিক জটিলতা নিয়ে শত শত মামলা এখন বিচারাধীন।
আইন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সারাদেশে নিকাহ-তালাক রেজিস্ট্রারদের কেন্দ্রীয় কোনো পরিসংখ্যান মন্ত্রণালয়ের হাতে নেই। কোন অধিক্ষেত্রে কাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে সেটিরও হিসেব নেই। তাই সারা দেশে নিকাহ রেজিস্ট্রারদের প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে রয়েছে বিভ্রান্তি। বাংলাদেশ মুসলিম নিকাহ রেজিস্ট্রার সমিতি জানায়, দেশে বৈধ নিকাহ-তালাক রেজিস্ট্রারের সংখ্যা ৫ হাজারের বেশি।
আরেক সংগঠন বাংলাদেশ কাজী সমিতি জানায়, এ সংখ্যা ৬ হাজারের বেশি। তবে ২০০৯ সালে প্রণীত ‘মুসলিম বিবাহ ও তালাক (নিবন্ধন) বিধিমালা’য় নিকাহ রেজিস্ট্রারদের লাইসেন্স প্রদানে অধিক্ষেত্র নির্ধারণ করে দিয়েছে। বিধিমালার বিধি-১৩ (অধিক্ষেত্র সংক্রান্ত) তে ৫ ধরণের অধিক্ষেত্র সুনির্দিষ্ট করেছে। (ক) সিটি করপোরেশনের ক্ষেত্রে একটি ওয়ার্ড। অর্থাৎ প্রতিটি ওয়ার্ড নিকাহ রেজিস্ট্রারদের একেকটি অধিক্ষেত্র। (খ) ‘ক’ শ্রেণির পৌরসভার ক্ষেত্রে দুইটি ওয়ার্ড, (গ) ‘খ’ শ্রেণির পৌরসভার ক্ষেত্রে তিনটি ওয়ার্ড, (ঘ) ‘গ’ শ্রেণির পৌরসভার ক্ষেত্রে সমগ্র এলাকা এবং (ঙ) ইউনিয়ন পরিষদ এলাকার ক্ষেত্রে একটি ইউনিয়ন। বিধি-১৪ অনুযায়ী নিকাহ রেজিস্ট্রারের কার্যালয় হতে হবে তার এলাকাধীন কোনো উপযুক্ত স্থানে।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, নিকাহ রেজিস্ট্রার নিয়োগের ক্ষেত্রে অধিক্ষেত্র সুস্পষ্ট করা হয় না। লাইসেন্সপ্রাপ্ত নিকাহ রেজিস্ট্রার থাকা অবস্থায় আরেকজনকে নিয়োগ দেয়া হয়। এ নিয়ে সৃষ্টি হয় জটিলতা। নিকাহ রেজিস্ট্রারের সহকারী হিসেবে কাজ করে অভিজ্ঞতা অর্জনের পর অনেকে নিজেই লাইসেন্স তৈরি করে নিকাহ এবং তালাক রেজিস্ট্রির কার্যক্রম চালাচ্ছেন। তারা ভুয়া কাজী হিসেবে চিহ্নিত। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতা এবং রাজনৈতিক ছত্রছায়ার অভিযোগও রয়েছে।
এ নিয়ে আসল কাজী বনাম ভুয়া কাজীর আইনি লড়াই চলছে অনেক অধিক্ষেত্রে। আর এ লড়াইরতদের দ্বারা হয়রানি ও প্রতারণার শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। অনেক নিকাহ রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে নিকাহ ও তালাক রেজিস্ট্রির সনদ বিক্রির অভিযোগ রয়েছে। ভুয়া সনদের ভিত্তিতে নিরপরাধ ব্যক্তিদের বø্যাক মেইল এবং হয়রানির অভিযোগ আছে। ভুয়া কাবিননামা, তালাকনামা দাখিল করে সম্পত্তির অধিকার দাবি, ন্যায়সঙ্গত অধিকার থেকে বঞ্চিতকরণের মতো ঘটনা ঘটছে।
বহুমাত্রিক জটিলতা, সঙ্কট আর সীমাবদ্ধতার মধ্যেই এখন নিকাহ এবং তালাক নিবন্ধন ডিজিটালাইজ করার দাবি উঠেছে। এ নিয়ে সম্প্রতি একটি রিটও হয়েছে। রিটের প্রেক্ষিতে গত ২৩ মার্চ আইন মন্ত্রণালয়সহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের প্রতি রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। বিষয়টি বিচারাধীন বিবেচনায় এ বিষয়ে সরাসরি মন্তব্য করতে আপত্তি জানিয়েছেন নিকাহ রেজিস্ট্রার সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। তবে ডিজিটালাইজেশনের পক্ষে বেশ কিছু বাস্তবতার কথা তুলে ধরেন তারা।
বাংলাদেশ কাজী সমিতির মহাসচিব মোহাম্মদ আবদুল হাই তালুকদারের মতে, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির যুগে নিকাহ রেজিস্ট্রাররা নিশ্চয়ই পিছিয়ে থাকতে পারে না। কিন্তু নিকাহ রেজিস্ট্রারদের ডিজিটালের আওতায় আনা এখনই সম্ভব নয়। কারণ এখন পর্যন্ত সাব-রেজিস্ট্রারদেরই ডিজিটাল করা যায়নি। তাদের কার্যালয় থানা সদরে। যেখানে বিদ্যুৎ, পানি, ইন্টারনেটসহ অবকাঠামোগত সকল সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। পক্ষান্তরে একটি থানায় ১৫-২০টি ইউনিয়ন রয়েছে। নিকাহ রেজিস্ট্রারদের অধিক্ষেত্র ইউনিয়ন পর্যায়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। বাংলাদেশে এখনও শতভাগ বিদ্যুতায়নের আওতায় আসেনি। পল্লী বিদ্যুতের অবস্থাও তথৈবচ। বিভাগীয় শহরগুলোতে নিকাহ রেজিস্ট্রারদের ডিজিটালের আওতায় আনা সম্ভব হলেও প্রান্তিক জনপদে এখনই এটি সম্ভব নয়।
বাংলাদেশ মুসলিম নিকাহ রেজিস্ট্রার সমিতির মহাসচিব কাজী ইকবাল হোসেনের মতে, বিদ্যমান ব্যবস্থায় বর-কনের অনেক তথ্যই নিশ্চিত হওয়ার সুযোগ নেই। বৈবাহিক তথ্যের ডাটাবেজ থাকলে এসব তথ্য তাৎক্ষণিকভাবে নিশ্চিত হওয়া যেতো। বাস্তবতা হচ্ছে, প্রান্তিক জনপদের অধিক্ষেত্রগুলোতে রয়েছেন অনেক বয়ষ্ক নিকাহ রেজিস্ট্রার। তাদের অনেকেরই তথ্য-প্রযুক্তি জ্ঞান নেই। ল্যাপটপতো দূরে থাক টাচ মোবাইলই ব্যবহার করতে পারেন না।
এ কারণে নিকাহ রেজিস্ট্রারদের ডিজিটালাইজেশনের আগে প্রশিক্ষণ এবং লজিস্টিক সাপোর্টের প্রশ্ন রয়েছে। আইন মন্ত্রণালয়ে বহু প্রকল্প রয়েছে। আমাদের দাবি কোনো একটি প্রকল্পের আওতায় আগে নিকাহ রেজিস্ট্রারদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। লজিস্টিক সাপোর্ট নিশ্চিত করতে হবে। তারপরই ডিজিটাল ব্যবস্থা কার্যকর ফল দেবে। অন্যথায় ডিজিটাল ব্যবস্থার নামে নিকাহ রেজিস্ট্রারদের কেবল হয়রানিই বাড়বে।
এদিকে নিকাহ-তালাক রেজিস্ট্রিতে শৃঙ্খলা আনয়নে কেন্দ্রীয় তথ্যভান্ডার তৈরিসহ ডিজিটালাইজড করার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন আইন ও বিচার বিভাগের সচিব মো. গোলাম সারোয়ার। তিনি ইনকিলাবকে বলেন, নিকাহ-তালাক রেজিস্ট্রিকে ডিজিটালাইজড করা এখন সময়ের দাবি। এটি বাস্তবায়ন সম্ভব হলে নিকাহ রেজিস্ট্রার এবং রেজিস্ট্রেশনে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হবে। মানুষের হয়রানিও লাঘব হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।