Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

হালদা সুরক্ষায় সিসিটিভি

মা-মাছ ডলফিন জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে বিশ্বে প্রথম উদ্যোগ প্রজনন মৌসুমের আগেই ‘বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ’ ঘোষিত এ নদীতে নজরদারি

শফিউল আলম ও রফিকুল ইসলাম সেলিম | প্রকাশের সময় : ১৪ মার্চ, ২০২১, ১২:০৫ এএম

মাছের ব্যাংক খ্যাত হালদা নদী ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার (সিসিটিভি) আওতায় আসছে। নদীর আটটি পয়েন্টে ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে ‘বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ’ ঘোষিত এই নদীর ১৬ কিলোমিটার মূল প্রজনন এবং বিচরণক্ষেত্র সিসি ক্যামেরার আওয়ায় আসবে। হালদার মা-মাছ, ডলফিনসহ নদীটির বিচরণশীল প্রাণী, জীববৈচিত্র্য সুরক্ষায় বিশে^ প্রথম এমন উদ্যোগ নেওয়া হলো।

নদীটির নিরাপত্তায় মোতায়েন করা হচ্ছে পুলিশের একটি ইউনিট। তারাই এসব ক্যামেরার মাধ্যমে সার্বক্ষণিক নজরদারি চালাবে। কর্ণফুলীর পর দেশের দ্বিতীয় প্রধান ‘অর্থনৈতিক নদী’ হিসাবে পরিচিত এ প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন কেন্দ্রে এপ্রিল মাসেই মাছের প্রজনন মৌসুম রয়েছে। তার আগেই হালদা নদীর প্রাকৃতিক প্রজনন বৈচিত্র্য সুরক্ষায় প্রযুক্তি ব্যবহার করে নজরদারির এই উদ্যোগ নেওয়া হলো। এর মাধ্যমে অবৈধ জাল পেতে মা-মাছ ধরা, ডলফিন শিকার, ইঞ্জিন চালিত নৌকার চলাচল বন্ধ, ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলনসহ নানা অপরাধ প্রতিরোধ সহজতর হবে।

নৌ পুলিশের পাশপাশি আরও দুটি সংস্থা সিসি ক্যামেরা স্থাপন করছে। এতে নদীর মাইলের পর মাইল এলাকা নজরদারির আওতায় আসবে। এর সাথে ইন্টারনেট সংযোগ থাকায় যে কোন স্থান থেকে সার্বিক পরিস্থিতি নজরদারি করা যাবে। তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণও সহজতর হবে।

চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রফেসর ও হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়ক ড. মনজুরুল কিবরীয়া গতকাল শনিবার ইনকিলাবকে বলেন, বিশে^ এ প্রথম কোন নদীতে মা-মাছ, ডলফিন, প্রাণিক‚লসহ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা বসানো হয়েছে। কেননা উন্নত বিশে^র নদ-নদী উপক‚ল সমৃদ্ধ স্থানে শুধুই জাহাজ চলাচল ব্যবস্থা (নেভিগেশন) নিয়ন্ত্রণের জন্য নৌ চ্যানেলে সিসি ক্যামেরা রয়েছে।
তিনি জানান, সরকারের উদ্যোগে হালদা নদী সুরক্ষায় ছয় কিলোমিটার এবং পিকেএসএফ (পল্লি কর্মসংস্থান প্রকল্প) এবং আইডিএফ (ইন্টিগ্রেট ডেভেলপমেন্ট ফান্ড) এর যৌথ উদ্যোগে আরো ১০ কিলোমিটার মূল প্রজনন এলাকায় সিসি ক্যামেরা বসানো হচ্ছে। গুরত্বপূর্ণ এই নদী থেকে গোপনে জাল পেতে মা-মাছ ধরা, ডলফিন হত্যা এবং বালু তোলার মতো ঘটনা প্রায় ঘটছে। এসব দেখার জন্য মাত্র ৪০ জন স্বেচ্ছাসেবী কাজ করছে। তবে এখন সিসি ক্যামেরা বসানোর ফলে এ কাজ সহজ হয়ে যাবে। রাতে দিনে নজরদারি করা যাবে। এতে অবৈধভাবে মাছ ধরা, বালু তোলার সাথে জড়িতদের মধ্যেও ভীতি তৈরি হবে।

হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ রুহুল আমিন বলেন, দীর্ঘদিন থেকে আমরা হালদা সুরক্ষায় কাজ করছি। তবে সিসি ক্যামেরায় নজরদারি করা হলে এ কাজ সহজ হয়ে যাবে। যে কোন এলাকা থেকে নজরদারি করা যাবে। তিনি বলেন, সাত্তারহাট থেকে মদুনাঘাট পর্যন্ত ২৪ কিলোমিটার নদীতে ক্যামেরা বসাতে হবে। আর এসব ক্যামেরা শুধুমাত্র হালদার সুরক্ষায় কাজে লাগাতে হবে। তাহলে এই উদ্দেশ্য সফল হবে। হালদায় অভিযান অব্যাহত আছে জানিয়ে তিনি বলেন, গতকালও পাঁচটি নৌকা এবং পাঁচ হাজার মিটার জাল জব্দ করা হয়েছে।
দেশের সহস্রাধিক নদীর মধ্যে হালদা নদীকে বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ ঘোষণা করা হয়। মুজিববর্ষের অঙ্গীকার অনুযায়ী গত ২২ ডিসেম্বর এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। সরকারি গেজেট মোতাবেক বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ তথা হালদা নদী এলাকায় ১২ দফা নিষেধাজ্ঞা ও শর্ত কার্যকর হবে।

এ সংক্রান্ত জারি করা সরকারি প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ ও পরিবেশগত মান উনয়নের মাধ্যমে রুই জাতীয় মাছের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও গাঙ্গেয় ডলফিনের আবাসস্থল সংরক্ষণের লক্ষ্যে খাগড়াছড়ি জেলার রামগড় ও মানিকছড়ি উপজেলা, চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি, রাউজান, হাটহাজারী উপজেলা এবং পাঁচলাইশ থানার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হালদা নদী এবং নদী তীরবর্তী ৯৩ হাজার ৬১২টি দাগের ২৩ হাজার ৪২২ একর জমিকে বঙ্গবন্ধু হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সিসি ক্যামেরা বসানোর ফলে হালদা সুরক্ষায় আর ধাপ অগ্রগতি হলো।

এশিয়ায় মিঠাপানির (রুই-কাতলা কার্প জাতীয়) বড় জাতের মাছের একমাত্র প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র জোয়ার-ভাটা নির্ভর নদী হালদা বিশ্বখ্যাত। বিদেশি গবেষকগণ হালদা পরিদর্শনকালে নদীটির মৎস্য-বীজের রত্ম-ভান্ডার দেখে বিমোহিত হন। এককালে ৭৬ প্রজাতির মাছ হালদায় পাওয়া যেত। ইতোমধ্যে প্রায় ২০ প্রজাতির মাছ, গাঙ্গেয় ডলফিন, বিভিন্ন প্রাণী বিপন্ন প্রায়। হালদা নদীকে সুরক্ষিত ঘোষণার ফলে রুই, কাতলা, মৃগেল, কালিকাউশ জাতীয় মা-মাছেরা অবাধে ডিম ছাড়বে। হালদা যোগান দেবে বার্ষিক হাজার কোটি টাকার ডিম-রেণু-পোনা। দেশের মিঠাপানির মৎস্যসম্পদ হবে সুসমৃদ্ধ।

হালদা নদীতে গত ২৩ মে আহরিত হয় ২৫ হাজার ৫৩৬ কেজি ডিম। যা এক যুগে সর্বোচ্চ রেকর্ড। উপযুক্ত পরিবেশ ও আবহাওয়ায় (‘জো’) ঝাঁকে ঝাঁকে রুই কাতলা মা-মাছ নদীর তলদেশ থেকে উঠে ডিম ছাড়ে। ডিম সংগ্রাহক অভিজ্ঞ জেলেরা নৌকা ও জাল নিয়ে বিশেষ কৌশলে ডিম সংগ্রহ করেন। হালদার পাড়ে কুয়াগুলোতে নিয়ন্ত্রিত পানি ও তাপমাত্রায় ডিম থেকে রেণু, পোনা ফোটানোর পর বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলসহ সারাদেশের পুকুর দীঘিতে সরবরাহ হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে হালদা নদীর প্রত্যক্ষ অর্থনৈতিক অবদান কমপক্ষে ৮শ’ কোটি টাকার।
জব্দ ৫ হাজার মিটার কারেন্ট জাল : প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীতে অভিযান চালিয়ে ৫ হাজার মিটার কারেন্ট জাল জব্দ করেছে উপজেলা প্রশাসন। অভিযানে হালদা নদী থেকে বালু উত্তোলনে ব্যবহৃত ইঞ্জিনচালিত ৩টি নৌকা ধ্বংস করা হয়। একটি নৌকার মালিককে ৫ হাজার টাকা জরিমানাও করা হয়।
গতকাল হালদা নদীর সর্তার ঘাট থেকে কালুরঘাট হালদার মুখ পর্যন্ত এলাকায় দিনভর এ অভিযান পরিচালনা করা হয়। এতে নেতৃত্ব দেন ইউএনও মো. রুহুল আমিন। তিনি বলেন, প্রজনন মৌসুমকে সামনে রেখে এই অভিযান অব্যাহত থাকবে। অভিযানে আনসার সদস্য, সমাজকর্মী শেখ মোরশেদুজ্জামান এবং আইডিএফ সদস্যরা সহায়তা করেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ