Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

যশোরের খেজুরের গুড়শিল্প

মলিন হচ্ছে যশোরের গৌরব ও ঐতিহ্য

মিজানুর রহমান তোতা | প্রকাশের সময় : ২৫ ডিসেম্বর, ২০২০, ১২:০২ এএম

কথায় আছে-যশোরের যশ খেজুরের রস। পুরো শীতে গ্রামীণ জীবনের প্রাত্যহিক উৎসব চলে আসছে আবহমানকাল ধরে। রস জ্বালিয়ে ভিজানো পিঠা ও পায়েস খাওয়ার ধুম পড়ে প্রায় প্রতিটি বাড়িতে। রসনা তৃপ্তিতে যার জুড়ি নেই। এসময় শহর থেকে গ্রামে ঢুকলেই শীতের ঝিরঝিরে বাতাসে ভেসে আসে রস-গুড়ের মিষ্টি গন্ধ। গ্রামীণ পরিবেশকে একরকম মাতিয়ে তোলে মধুবৃক্ষের রস-গুড়। কিন্তু দিনে দিনে গৌরব আর ঐতিহ্য হারিয়ে খুঁড়িয়ে চলছে যশোরের ঐতিহ্যবাহী খেজুরের গুড়শিল্প।

খেজুরের রস, গুড় ও পাটালির চাহিদা প্রতিবছরই বাড়ছে। কিন্তু উৎপাদন কম হওয়ার কারণে রীতিমতো কাড়াকাড়ি পড়ে যায় নির্ভেজাল গুড় ও পাটালি নিয়ে। অথচ একসময় বৃহত্তর যশোর অঞ্চল এতটাই খেজুরের রস গুড়ে খ্যাতি ছিল যে ইংল্যান্ডের মি. নিউ হাউজ যশোরের চৌগাছার তাহেরপুরে এসে খেজুরের গুড় থেকে চিনি উৎপাদনের কারখানা গড়ে তুলেছিলেন। ওইসময় বেশ সমৃদ্ধ ছিল যশোরের রস-গুড় শিল্প। বর্তমানে একেবারেই খুঁড়িয়ে চলছে খেজুরের গুড় শিল্পটি।

যশোরের খাজুরা এলাকার বয়োবৃদ্ধ শামসুল আলমসহ বেশ কয়েকজন জানালেন, গ্রাম মাঠে এখন সেই গাছও নেই। গাছিও নেই। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের মাঠ কর্মকর্তারা অন্যান্য বিষয় যেভাবে উপর মহলে যোগাযোগ করে থাকেন, এটির ক্ষেত্রে মোটেও হয় না। কোন নির্দেশনাও থাকে না উপর মহলের। পারতপক্ষে কেউ খোঁজ রাখেন না এ ব্যাপারে। মাঠপর্যায়ের একজন কৃষি কর্মকর্তা নাম প্রকাশ করতে নিষেধ করে জানালেন, আমি দীর্ঘদিন চাকরি করছি, উপরের কোনো কর্মকর্তা কখনো খেজুর গাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে কেন, বাড়ানো যায় কীভাবে, সমস্যার সমাধানই বা কী-এসব নিয়ে খোঁজখবর নেন না।

তার মতে সাংবাদিকরা মৌসুমী রিপোর্ট করে থাকেন। আসলে মহাসঙ্কটে শিল্পটি। তার ওপর শিল্পটির করুণ অবস্থার অন্যতম প্রধান কারণ গাছি সঙ্কট। বিভিন্ন পেশা বংশ পরম্পরায় চলে। গাছিদের ক্ষেত্রে তা হচ্ছে না। গাছির ছেলে গাছি হচ্ছেন না। যেসব গাছি আছেন তারা খেজুর গাছে বাদরের মতো ঝুলে রস সংগ্রহের জন্য সকাল বিকাল পরিশ্রম করেন এখন বয়সের ভারে তারা পেরে উঠছেন না। তাছাড়া সিংহভাগ গাছির মাজায় ও হাটুতে ব্যাথা স্থায়ী হয়ে গেছে।

যশোরের সদর উপজেলার ডাকাতিয়া মাঠপাড়ার গাছি আলী হোসেন ময়না জানান, আমি খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহের সাথে জড়িত প্রায় ৪০ বছর। এখন কোনরকমে ২টি ছোট গাছ ঝেড়ে কুটে রস সংগ্রহের জন্য বাঁশের নলি ও ভাড় ঝুলাতে পারছি। আগে আমি নতুন খয়েরতলা, ডাকাতিয়া, নওদাগ্রামের প্রায় ৫০/৬০টি গাছে থেকে রস সংগ্রহের কাজ করতে পারতাম। তিনি বললেন আর পারি না। তাছাড়া সেইরকম গাছও নেই। গ্রামে গ্রামে সারি সারি খেজুর গাছ যেভাবে দেখা যেত, এখন দেখা যায় না। তার মতে, অল্পকিছু গাছি যশোরের ঐতিহ্য ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। তাও কতদিন স্থায়িত্ব হবে তা নিয়ে যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছে।

সুত্র জানায়, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের ২০১৬ সালের মাঠ জরিপ অনুযায়ী যশোর অঞ্চলে ২ হাজার ৮শ’ ৩৮ হেক্টরে খেজুর গাছের সংখ্যা ছিল ১৭ লাখ ৮২ হাজার ৫শ’ ৭০টি। গুড় উৎপাদন হতো ২৫ হাজার ৯শ’ মেট্রিক টন। সূত্রমতে, আগের জরিপে (১৯৯৮) এর সংখ্যা ছিল প্রায় দ্বিগুণ। দ্রæত কমে যাচ্ছে খেজুর গাছের সংখ্যা। ইটভাটায় জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার হওয়ায় খেজুর গাছ সাবাড় হচ্ছে। যশোর ও শার্শাসহ কয়েকটি জায়গায় নতুন করে খেজুর গাছ লাগানো হচ্ছে। সেগুলো থেকে রস সংগ্রহ করা সম্ভব হবে আরো অনেক পরে।

সুত্রমতে, গ্রামাঞ্চলে বাড়ির আঙ্গিনায় ও মাঠে জমির আইলে কিংবা বাগানে অযতœ অবহেলায় ও সম্পুর্ণ বিনা খরচে বেড়ে ওঠে ‘মধুবৃক্ষ’ খেজুর গাছ। প্রতিবছর শীত মৌসুমের ৩/৪ মাস মানুষের রসনা তৃপ্তির যোগান দেয়। খেজুরের রস জ্বালিয়ে পাতলা ঝোলা গু ও পাটালি তৈরির দৃশ্য অনেকটাই অভিনব মনে হয়। যশোরের ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে এখনো খাজুরা, বাঘারপাড়া, ফতেপুর, ছাতিয়ানতলাসহ বিভিন্ন গ্রামের কিছু ব্যক্তি শীত মৌসুমে খেজুরের রস গুড়ের ব্যবসা চালিয়ে যান। অসাধু ব্যবসায়ীরা গুড়ে ভেজাল দিয়ে থাকেন চিনি ও সেগারিন। অবশ্য এই ভেজালের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসন থেকে কড়া হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: যশোর


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ