Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ২২ কার্তিক ১৪৩১, ০৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বরেন্দ্রর চাষাবাদে পরিবর্তনের হাওয়া

বছরজুড়েই থাকছে শাকসবজি-ফসলের আবাদ

রেজাউল করিম রাজু : | প্রকাশের সময় : ২ ডিসেম্বর, ২০২০, ১২:০০ এএম

এক সময়ের ঠা ঠা বরেন্দ্র অঞ্চলে এখন সবুজের সমারোহ। বদলে গেছে চাষাবাদের ধরণ। বছরে একবার ধান নির্ভর চাষাবাদে লেগেছে পরিবর্তনের হাওয়া। বছরজুড়েই থাকছে মওসুমী ফসলের আবাদ। জমি আর খালি থাকছে না। বরেন্দ্র লাল মাটি এখন সোনা ফলা উর্বর ভূমি। বছর দশেক ধরে বরেন্দ্র অঞ্চলের (রাজশাহী, চাপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, নাটোর) চাষাবাদে পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে।
সরেজমিন বরেন্দ্র এলাকা ঘুরতে গেলে দেশি ফলের পাশপাশি বিদেশী ফল মাল্টা, ড্রাগন, কমলার বড় বড় বাগান আর তাতে ফলের সমারোহ চমকে দেবে নিঃসন্দেহে। শুধু কি ধান? আবাদ হচ্ছে নানা শাকসবজির। আলু, ফুলকপি, পাতাকপি, লাল টকটকে টমেটো লাল শাক ও পালং শাকের বিস্তীর্ণ সবুজ ক্ষেত আর সরিষার ক্ষেতের হলুদ বরণ কারো দৃষ্টি আকর্ষণ না করেই পারে না।

যখন যে মওসুম সেই মওসুমের শাকসবজি আর ফলের দৃষ্টিনন্দন বাগান এখন সহজেই চোখে পড়ছে। সেচ সুবিধা পেয়ে বরেন্দ্রের শক্ত মাটি সোনাফলা হয়ে উঠেছে। তার বুকে যে আবাদই করা হচ্ছে তাতেই পূর্ণতা পাচ্ছে। ধান আলু, পেয়াজ, নানা শাকসবজি সরিষাসহ বিভিন্ন ডাল জাতীয় শষ্যেও বাম্পার ফলন হচ্ছে ফি বছর। বরেন্দ্র অঞ্চল একটি খাদ্য উদ্বৃত্ত ও সম্প্রসারণ কৃষি অঞ্চল হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। কৃষি বিভাগের মতে এখানকার ফসলের নিবিড়তা ২৩০ শতাংশ। সবজি চাষের জমির পরিমাণ বৃদ্ধি ও হেক্টর প্রতি সবজির উৎপাদন বৃদ্ধির কারণে কৃষি মন্ত্রণালয় দেশের মধ্যে রাজশাহীকে সবজি উৎপাদনে প্রথম হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ শামসুল হক বলেন, বরেন্দ্র অঞ্চলের চাষাবাদ মানে ভূগর্ভস্থ পানির উপর চাপ। তাই এ চাপ কমাতে বরেন্দ্র অঞ্চলে তারা ধানের পাশপাশি পানি সাশ্রয়ী ফসলের চাষ বাড়াতে কয়েক বছর ধরে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করে আসছেন। আগে বৃহত্তর রাজশাহী মানে ছিল আম। আম বাগান বিস্তার লাভেব পাশাপাশি মাল্টা, কমলা, ড্রাগন, পেয়ারা, বরই এখানকার কৃষি অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছে। বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুর সুবাদে ফসলের বাজারজাত সুবিধা বেড়ে যাওয়ায় এখন এসব সবজি ফল বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষাবাস হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে নাটোর ও রাজশাহীতে দেশের দুটি বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান ফল প্রক্রিয়াজাত প্রকল্পের সম্প্রসারণ ঘটিয়েছে। ফলে ফলের বাজারজাতসহ কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

কৃষি বিভাগের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রতিবছর ফলের বাগান বাড়ছে। ২০১৮-১৯ বছরে আমের আবাদকৃত জমির পরিমাণ ছিল ৭২৯০৯ হেক্টর। সেখানে ১৯-২০ বছরে বেড়ে দাঁড়ায় ৮১০১৫ হেক্টর জমি। সবচেয়ে বেড়েছে ধান প্রধান নওগাঁ জেলায় ১৮৬৬৬ হেক্টর জমির স্থলে দাড়িয়েছে ২৪৭৭৫ হেক্টর। এরপর চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৩১০০০ হেক্টর, রাজশাহী, নাটোরে বেড়েছে পাঁচশো হেক্টর করে। বেড়েছে মাল্টার আবাদ ২০১৮-১৯ বছরে মাল্টার আবাদকৃত জমির পরিমাণ ছিল ১৬৮ হেক্টর এ বছর এসে দাড়িয়েছে ৫৭৩ হেক্টরে। রাজশাহীতে আবাদ হয়েছে প্রায় দেড়শো হেক্টর জমিতে। এরপরই রয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ। ড্রাগন আবাদ ছিল বিগত বছরে প্রায় পনের হেক্টর জমিতে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫ হেক্টরে। এমনিভাবে বাড়ছে পেয়ারা, কাশ্মিরি আপেল কুল, পেঁপে, কলা, তরমুজসহ বিভিন্ন ফলের আবাদ। কৃষকরা বলছেন কৃষি বিভাগের হিসেবের চেয়ে বাস্তবে এর পরিমাণ অনেক বেশি। কারণ ছোট ছোট বাগান গুলো হিসাবের মধ্যে আসে না।

আম বাগান বৃদ্ধি প্রসঙ্গে বিশিষ্ট আম গবেষক ও জাতীয় পুরষ্কারপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী ড. শরফ উদ্দিন বলেন, আম আবাদে চাষিরা নতুন নতুন পদ্ধতি প্রয়োগ করছেন। এখন আর আমের অফ ইয়ার বা অন ইয়ার বলে কিছু নেই। নতুন জাতের আম দিয়ে গড়ে উঠছে নতুন বাগান। বালাই ও কীটনাশক মুক্ত আমের জন্য ফ্রুট ব্যাগিং পদ্ধতি অনুসরণ করছেন। ধানের চেয়ে আম বাগান লাভবান হিসাবে দেখছেন জোতদাররা। ফলে সারাদেশে আম বাগানের বিস্তৃতি ঘটছে। রাজশাহী অঞ্চলের আম নিয়ে হাজার কোটি টাকা বাণিজ্য আম অর্থনীতি ভাল ভূমিকা রাখছে। প্রয়োজন বিদেশে রফতানি নিয়ে সরকারি পদক্ষেপ।

নওগাঁয় শাহ কৃষি তথ্য পাঠাগার ও জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা কৃষি ক্ষেত্রে অবদান রাখার জন্য জাতীয় পুরষ্কার প্রাপ্ত মো. জাহাঙ্গির আলম শাহ এর সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, এ অঞ্চলের মানুষের কৃষি ধ্যান কৃষিই জ্ঞান। কৃষক ঠেকে এবং ঠকে নিজেরাই সমাধানের উদ্যোগ নিয়ে চাষাবাদ করে আসছে। যার কারণে কৃষি ক্ষেত্রে এ অঞ্চলে কৃষি বিপ্লব ঘটে চলেছে। তিনি নিজেও এখন শুরু করেছেন ঔষধী গাছ বাসকের।

বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষক গোদাগাড়ীর আমিনুল রফিকুল মাহবুব সিটি এলাকার সাজ্জাদ দেশীয় জাতের বারি মাল্টা-১ আবাদ করে সফল হয়েছেন। ২০১৬ সালে মাল্টার আবাদ শুরু। তাদের ভাষায় মাল্টার আবাদ লাভজনক। শুরুতে এক বিঘা জমিতে খরচ হয় পঞ্চাশ-ষাট হাজার টাকা। একবার লাগালে এ গাছ কুড়ি বছর ফল দেয়। আবার উৎপাদন খরচ আর কীটনাশক কম লাগে। এছাড়া বাড়তি হিসাবে চারা বিক্রি করে ভাল আয় হয়। তাদের সফলতা দেখে বরেন্দ্র অঞ্চলে শতাধিক কৃষক বাণিজ্যিকভাবে মাল্টা চাষে ঝুঁকেছেন। সাথে আবার অনেকে গড়ে তুলছেন কমলার বাগান।

কৃষি বিভাগের সূত্রমতে গত বছর রাজশাহীতে মাল্টার আবাদ হয় ২২২ মে. টন। এবার উৎপাদন আরো বেশী হবে। নাটোর ও নবাবগঞ্জে মাল্টার আবাদ হচ্ছে। বরেন্দ্র অঞ্চলে মাল্টার সাথে কমলার আবাদ করে সাড়া ফেলে দিয়েছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর উপজেলার ঝিলিম ইউনিয়নের জামতাড়া এলাকার মতিউর। বছর তিনেক আগে ২৬ বিঘা জমিতে পেয়ারা মাল্টার বাগান করেন। এতে লাভবান হওয়ায় শুরু করেন অষ্ট্রেলিয়া ও চীনা ম্যান্ডারিন জাতের ছয়শত কমলা লেবুর চারা রোপন করেন। সেসব গাছে এখন দৃষ্টিনন্দন ফল। বিক্রি করেছেন পাঁচলাখ টাকার ফল। বাগান পরিদর্শন করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন বরেন্দ্র অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে কমলা মাল্টার চাষ করলে আমদানী নির্ভরতা কমবে। বৈদেশিক মুদ্রা বাচার পাশপাশি মানুষ কমদামে এর স্বাদ নিতে পারবে। নাটোরের বাগাতিপাড়ায় সাজেদুর রহমান নাগপুরি জাতের কমলায় সাফল্য পেয়েছেন।

আরেক বিদেশী ফল ড্রাগন। নামটি ভয়ঙ্কর হলেও এটি পুষ্টি গুণে মানে সমৃদ্ধ ফল। সেটির আবাদ হচ্ছে বরেন্দ্র অঞ্চলে। প্রতি বছর বাড়ছে আবাদের জমি। ২০১৮-১৯ বছরে জমির পরিমাণ ছিল প্রায় পনের হেক্টর এখন তা দাঁড়িয়েছে পচিশ হেক্টরে। বাজারে শোভাপাচ্ছে দৃষ্টিনন্দন ফলটি। কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন ক্যাকটাস প্রজাতির এই গাছটির জন্য বরেন্দ্র অঞ্চলের মাটি খুবই উপযোগী। রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক (উদ্যান) এ অঞ্চলে ড্রাগন চাষের জনক। ২০১২ সালে নাটোরে প্রথম মেক্সিকান ফল ড্রাগনের চাষ শুরু করেন। এরপর রাজশাহী পাবনা বগুড়া ঢাকা নওগাঁ চাপাইনবাবগঞ্জ থেকে আগ্রহী চাষিরা এসে চারা সংগ্রহ করে নিয়ে গড়ে তুলছেন বাগান। বাণিজ্যিকভাবে বাগান গড়লে দু’যুগ ধরে আয়ের উৎস্য হিসাবে ব্যবহার করা যায়। এক বিঘা জমি থেকে প্রতি বছর পাঁচ লাখ টাকা আয় করা সম্ভব। এখানকার উৎপাদিত ড্রাগন এখন ফলের দোকানে শোভা পাচ্ছে ও মানুষের রসনা মেটাচ্ছে।

ইতোমধ্যে শাকসবজি ও মাছ আবাদে উদ্বৃত্ত অঞ্চল হিসাবে স্থান করেছে। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে প্রতিদিন শত ট্রাক মাছ ও শাকসবজি যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। জেলায় বর্তমানে ১৩০৫০ হেক্টর জমির কয়েক হাজার পুকুরে প্রতিবছর ৮৪ হাজার মে. টন মাছ উৎপাদন হচ্ছে। আর মৎস্যজীবিদের মাঝে নতুন করে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে প্রায় এক লাখ ৩০ হাজার বেকার যুবকদের।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন বরেন্দ্র অঞ্চলে যেভাবে চাষাবাস বদলে যাচ্ছে তাতে করে জোতদার ছাড়াও ক্ষুদ্র প্রান্তিক ও ভূমিহীন কৃষকদের আর্থসামাজিক উন্নয়ন হচ্ছে। সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ