Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কারসাজি বন্ধে স্টক এক্সচেঞ্জের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ

শেয়ারবাজার বিষয়ক ওয়েবিনারে বক্তারা

অর্থনৈতিক রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ৩১ অক্টোবর, ২০২০, ৬:৩৭ পিএম | আপডেট : ৬:৩৮ পিএম, ৩১ অক্টোবর, ২০২০

# বন্ধ থাকা কোম্পানির শেয়ারে কারসাজি হচ্ছে, ডিএসই কিছুই করছে না : সালমান এফ রহমান

প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বলেছেন, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সামনেই উৎপাদনহীন ও কারখানা বন্ধ থাকা কোম্পানির শেয়ারে কারসাজি হচ্ছে। কিন্তু ডিএসই কিছুই করছে না। তিনি বলেন, বর্তমানে পুঁজিবাজারে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর চেয়ে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী কম। ৮০-৮৫ শতাংশই ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা লেনদেন করে। এটা বড় দুর্বলতা। আর মিউচুয়াল ফান্ডের অংশ ৩ শতাংশ বলা হলেও লেনদেন আরও কম। আইসিবি ছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী নেই বললেই চলে। কিন্তু একটি বাজারতো একমাত্র আইসিবি দিয়ে চলতে পারে না।

শনিবার (৩১ অক্টোবর) পুঁজিবাজারের বর্তমান পরিস্থিতি এবং টেকসই উন্নয়ন নিয়ে আয়োজিত ওয়েবিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। ক্যাপিটাল মার্কেট জার্নালিস্টস ফোরাম (সিএমজেএফ) এবং বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স এসোসিয়েশন (বিএমবিএ) যৌথভাবে ওয়েবিনারের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন বিএসইসির চেয়ারম্যান প্রফেসর শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম, ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম এবং ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই)- এর প্রেসিডেন্ট শামস মাহমুদ। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বিএমবিএর সভাপতি ছায়েদুর রহমান ও সিএমজেএফের সভাপতি হাসান ইমাম রুবেল। মূলপ্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিএমবিএর ভাইস-প্রেসিডেন্ট মো. মনিরুজ্জামান।

সালমান এফ রহমান বলেন, আমরা সবাই দেখছি একটি কোম্পানির ১০ বছর ধরে কারখানা ও উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। প্রতিনিয়তই এই রকম কোম্পানির শেয়ার নিয়ে ডিএসইর ব্রোকাররা ম্যানিপুলেশন (কারসাজি) করছে। ডিএসই’র সামনেই বন্ধ থাকা কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়াচ্ছে। তারা তো লুকিয়ে করছে না। তারপর ডিএসই এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। ডিএসইকে এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তিনি বলেন, শেয়ারবাজারে যদি কোন দুই নম্বারি হয়ে থাকে, সেটা পুরো পৃথিবীতেই সবার আগে স্টক এক্সচেঞ্জ ধরে।

প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি উপদেষ্টা বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থাতো অনেক পরের বিষয়। প্রথমেই ধরবে স্টক এক্সচেঞ্জ। তাদের ওখানেইতো প্রতিদিন লেনদেন হয়। যেকোন ধরনের অনিয়মের লেনদেন দেখলে বুঝতে পারা যায়। কিন্তু এখনো আমাদের শেয়ারবাজারে যে কোম্পানি বন্ধ, তারপরেও সেই কোম্পানির দর বাড়ে। কারা এসব কোম্পানির শেয়ার কিনে এবং কারা বিক্রি করে, তা স্টক এক্সচেঞ্জ জানে। এখানে যে ম্যানুপুলেশন হচ্ছে এবং ওপেনলি হচ্ছে, লুকিয়ে কেউ করছে না। কিন্তু যখনই বাজার পড়ে গিয়ে কোন কিছুই হলেই রাস্তায় লোকজন নেমে সরকারকে দোষারোপ করে।

দেশের পুঁজিবাজারকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে বেনিফিশিয়ারি একাউন্ট (বিও) ডিজিটাল হওয়া উচিত উল্লেখ্য করে সালমান এফ রহমান বলেন, এটা ডিজিটাল হলে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য যেমন সুবিধা হবে তেমনি অনেক বিনিয়োগকারী বাসায় বসেই একাউন্ট খুলে বিনিয়োগ করতে পারবেন। এখন অনেক ব্যাংক একাউন্টও বাসায় বসেই ডিজিটালি করা যাচ্ছে।

ওয়েবিনারে বক্তারা বলেন, শেয়ারবাজারের সুশাসন প্রতিষ্ঠান স্টক এক্সচেঞ্জের ভুমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। বিশেষ করে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সামনেই বন্ধ থাকা কোম্পানির শেয়ারে কারসাজি হচ্ছে। পৃথিবীর সবদেশেই শেয়ারবাজারে কারসাজির বিরুদ্ধে স্টক এক্সচেঞ্জ সবার আগে ব্যবস্থা নেয়। কিন্তু ডিএসইর ব্রোকাররা কারসাজি করলে স্টক এক্সচেঞ্জ নিবর। এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। এছাড়াও শেয়ারবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।

বিএসইসির চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম বলেন, গত তিন থেকে চার বছরের জমে থাকা আইপিওর আবেদনগুলো প্রায় শেষ। নতুন করে যেসব কোম্পানি আবেদন করবে তাদের দ্রুত সময়ের মধ্যে অনুমোদন দেয়া হবে। সেক্ষেত্রে তিন মাস নয়, কাগজপত্র ঠিক থাকলে এক মাসের মধ্যে অনুমোদন দেয়া হবে। আমরা আইপিও অনুমোদনের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের সময় ক্ষেপণ করবো না।

শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম বলেন, পুঁজিবাজারে ভালো আইপিও আনতে সর্বাত্মক চেষ্টা করছি। আইপিও অনুমোদন দেয়ার ক্ষেত্রে কোম্পানির বিগত বছরগুলোর ব্যবসা পর্যালোচনা করছি। বিশেষ করে কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধন কত এবং ৫ বছরের ট্যাক্স রেকর্ড বিশ্লেষণ করছি। মিউচুয়াল ফান্ড প্রসঙ্গে তিনি বলেন, গত কয়েক বছরে অনেক ফান্ড বিনিয়োগকারীদের কোনো রিটার্ন দিচ্ছে না, এটা ঠিক না। এ সময়ে অনেক মিউচুয়াল ফান্ড লভ্যাংশ দিলেও কিছু ফান্ড দিচ্ছে না। কারও চাপে নয়, বাজারের জন্যই পুঁজিবাজারে মিউচুয়াল ফান্ডের প্রকৃত রুপ দিতে চাই।

পুঁজিবাজারকে সাপোর্ট দেয়ার জন্য ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশকে (আইসিবি) সংস্কার করার কথা জানিয়ে শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম বলেন, আইসিবিকে ফান্ড দিয়ে আরও শক্তিশালী করতে হবে। বাজারের নেগেটিভ ইক্যুইটি দূর করতে বিশেষ ফান্ড আসছে। সুদ কমিয়ে আনা হবে। বাইব্যাক (শেয়ার পুণ:ক্রয়) পদ্ধতি চালু করা হবে। এক্ষেত্রে বাইব্যাক পলিসির কাজ করা হচ্ছে। বাইব্যাকের জন্য কোম্পানি আইনে কিছু পরিবর্তন আনতে হবে। বাজার গ্রিন ফিল্ড কোম্পানি আনা হবে। এক্ষেত্রে ই-কমার্স কোম্পানিগুলোকে অনুমতি দেয়া হবে। অর্থাৎ একটি গতিশীল পুঁজিবাজার গড়ে তোলা হবে।

বিএসইসি চেয়ারম্যান বলেন, পুঁজিবাজারে তথ্য-প্রযুক্তির সবোর্চ্চ ব্যবহার করতে বিদেশ থেকে একটি টিম আসছে। চলতি সপ্তাহে ডিএসই পরিদর্শন করবে। পুঁজিবাজারকে সত্যিকার অর্থেই ডিজিটাল করা হবে। এছাড়া সিডিবিএলের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। ন্যাশনাল আইডির মাধ্যমে কীভাবে অনলাইনে বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) হিসার খোলা যায় সে লক্ষে কাজ করা হচ্ছে।

এফবিসিসিআই সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম বলেন, দেশের সকল ব্যাংক, বীমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ সকল প্রতিষ্ঠানকে সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতায় আনতে হবে। এক্ষেত্রে কোন ছাড় নয়। আমরা চাই কর জিডিপি রেশিও বাড়াতে। তালিকাভুক্ত কোম্পানিকে বিভিন্ন সুবিধা দিতে হবে। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক, রাজস্ব বোর্ড এবং বিএসইসিকে একযোগে কাজ করতে হবে। এজেন্ট ব্যাংকগুলো গ্রাম থেকে আমানত এনে শহরে বিনিয়োগ করছে। এটি মোটেই ভাল উদ্যোগ নয়।

ডিসিসিআই সভাপতি শামস মাহমুদ বলেন, লভ্যাংশ দেয়া বাধ্যতামূলক করায় অনেক কোম্পানি ঋণ নিয়ে তা ডিভিডেন্ড দিচ্ছে। এটা সাময়িক ভাল হলেও দীর্ঘমেয়াদে সমস্যা হতে পারে। ক্ষুদ্র মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পকে বাজারে নিয়ে আসতে হবে। কোম্পানির আকার নয়, সম্ভাবনা দেখে এসব কোম্পানিকে আনতে হবে। বর্তমান কমিশন বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে এবং বিনিয়োগকারীরাও এসব উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসেবে নিচ্ছে। এটি একটি ভাল দিক।

বিএমবিএ’র সভাপতি ছায়েদুর রহমান বলেন, পুঁজিবাজারের ভারসাম্য রক্ষায় চাহিদা ও যোগান জরুরি। এক্ষেত্রে পুঁজিবাজারে ভালো কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্ত করতে হবে। ভালো ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাকে পুঁজিবাজারে আনতে কর প্রণোদনার পাশাপাশি পলিসি সাপোর্ট দেয়া জরুরি। তিনি বলেন, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত-অতালিকাভুক্ত কোম্পানির মধ্যে কর ব্যবধান বাড়াতে হবে। তাহলে অনেকেই বাজারে আসবে। বিশেষ করে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো দিনের পর দিন ব্যবসা করছে অথচ পুঁজিবাজারে আসছে না। তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর করপোরেট কর হার ২০ শতাংশ করার দাবি জানাচ্ছি। এতে অনেক ভালো কোম্পানি পুঁজিবাজারে আসতে আগ্রহী হবে। আর্থিক প্রতিবেদনে কারসাজি ঠেকাতে কেন্দ্রীয়ভাবে অডিট রিপোর্ট দেখভালের জন্য আলাদা ডাটা বেইজ করা এবং ১০ শতাংশ আগাম করকে চূড়ান্ত কর হিসেবে গণনা করার দাবি করেন ছায়েদুর রহমান।

মূল প্রবন্ধে মনিরুজ্জামান বলেন, আইপিও দীর্ঘসূত্রিতা কমানো, এবং চাঁদা গ্রহণের পর লেনদেনের দোর হওয়া, আইসিবির পোর্টফোলিওতে 'জেড' এবং ওটিসির কোম্পানির বিনিয়োগ এবং এজিএম প্রক্রিয়া স্বচ্ছ করার প্রস্তাব দেন। সিএমজেএফের সভাপতি হাসান ইমাম রুবেল বলেন, দেশের অর্থনীতি যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে সেভাবে পুঁজিবাজার এগোয়নি। তাই বাজারে অনেক কিছু করার আছে। যদিও আগের কমিশনের নেতৃত্বের উপর আস্থাহীনতা কম ছিল। বর্তমানে সেই সঙ্কট নেই। তাই সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ