পোশাক রপ্তানিতে উৎসে কর ০.৫ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব
আগামী পাঁচ বছরের জন্য তৈরি পোশাক রপ্তানির বিপরীতে প্রযোজ্য উৎসে করহার ১ শতাংশ থেকে হ্রাস করে ০.৫ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব করেছে পোশাক খাতের দুই সংগঠন
দেশের পুঁজিবাজারের অন্যতম দুর্বলতা হলো মিউচুয়াল ফান্ড। এটির কাঠামোও অদ্ভুত। পুঁজিবাজারের উন্নয়নে এ খাতের কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন। শনিবার (৩ অক্টোবর) রাতে বিশ্ব বিনিয়োগকারী সপ্তাহ ২০২০ উপলক্ষে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) আয়োজিত ‘বাংলাদেশের উন্নয়নে পুঁজিবাজারের ভূমিকা’ শীর্ষক ওয়েবিনারে আলোচনায় বক্তারা এসব কথা বলেন। ওয়েবিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এতে বিশেষ অতিথি ছিলেন।
ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অব সিকিউরিটিজ কমিশনসের (আইওএসকো) সঙ্গে যৌথভাবে ৫-১১ অক্টোবর দেশে বিশ্ব বিনিয়োগকারী সপ্তাহ উদযাপনের উদ্যোগ নিয়েছে বিএসইসি। কভিড-১৯-এর কারণে ভার্চুয়াল মাধ্যমে এবার দিবসটি উদযাপিত হচ্ছে। এ উপলক্ষে গতকাল আয়োজিত উদ্বোধনী ওয়েবিনারে সভাপতিত্ব করেন বিএসইসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলাম।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, বাংলাদেশ গত এক দশকে বিভিন্ন নির্দেশকে ঈর্ষণীয় অগ্রগতি অর্জন করেছে। এ সময়ে জিডিপিতে ১৮৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আমাদের দেশের সক্ষমতার জায়গাগুলো খুঁজে বের করতে বলেছেন। আমরা সেভাবেই কাজ করছি। পুঁজিবাজারসহ যেসব খাতে ঘাটতি রয়েছে সেগুলো সমাধানে আমরা কাজ করছি। গত তিন মাসে রেমিট্যান্স আহরণে অভাবনীয় অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবেলা করেছি। এবারের করোনার প্রভাবও আমরা মোকাবেলা করতে পারব। সারা বিশ্বের মধ্যে প্রবৃদ্ধি অর্জনে আমরা প্রথম স্থানে থাকতে পারব বলে আশা করছি।
প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বলেন, গত ১২ বছরে বাংলাদেশের অকল্পনীয় উন্নতি হয়েছে। কিন্তু ট্যাক্স টু জিডিপি রেশিও ও মার্কেট ক্যাপ টু জিডিপি রেশিওতে উন্নতি হয়নি। প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে হলে পুঁজিবাজারকে শক্তিশালী করতে হবে। বন্ড মার্কেটের উন্নয়নে বর্তমান কমিশন বেশকিছু উদোগ নিয়েছে। ডেরিভেটিভসের প্রয়োজন আছে, কিন্তু এর আগে প্রেফারেন্স শেয়ার ও কনভার্টিবল বন্ডের মতো পণ্যকে প্রাধান্য দেয়া প্রয়োজন।
মিউচুয়াল ফান্ডকে দেশের পুঁজিবাজারের একটি দুর্বলতা হিসেবে উল্লেখ করে সালমান এফ রহমান বলেন, এর কাঠামোও হাস্যকর। আইএফআইসি ব্যাংকের একটি মিউচুয়াল ফান্ড রয়েছে। কিন্তু এর কাঠামো এমনভাবে করা, যেখানে আইএফআইসি ব্যাংকের কিছু করার নেই। অথচ ফান্ডটির পারফরম্যান্স খারাপ হলে ব্যাংকেরও ব্র্যান্ডিং খারাপ হয়। এক্ষেত্রে কাঠামোগত সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। এছাড়া আমাদের দেশে পুঁজিবাজারের বড় সমস্যা হলো প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর অভাব। এখানে ব্যক্তি বিনিয়োগকারী অনেক বেশি। অথচ ম্যাচিউরড, ইমার্জিং, ফ্রন্টিয়ার মার্কেটগুলোতে ৮০ শতাংশই প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী। সেখানে ব্যক্তি বিনিয়োগকারী নেই তা না। বরং ব্যক্তি বিনিয়োগকারীরা মিউচুয়াল ফান্ড ও ব্রোকারেজ হাইজের ডিসক্রিশনারি অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে বিনিয়োগ করে। এজন্য আমাদের পুঁজিবাজারকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে হলে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী বাড়াতে হবে।
তিনি বলেন, সম্প্রতি মাত্র ১ শতাংশ শেয়ার ইস্যু করে ওয়ালটন পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে এবং বাজার মূলধনের দিক দিয়ে দ্বিতীয় শীর্ষ কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে। অথচ আগে আসা কোম্পানিগুলো এর চেয়ে অনেক বেশি শেয়ার ইস্যু করেছে। এখন অন্য যেকোনো কোম্পানিও একইভাবে ১ শতাংশ শেয়ার ইস্যু করে পুঁজিবাজারে আসতে চাইতে পারে। তাই এক্ষেত্রে নীতিগত ধারাবাহিকতা থাকা প্রয়োজন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে বেশকিছু সমস্যা রয়ে গেছে। এজন্য প্রতিষ্ঠানটির মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মানসিকতা পরিবর্তন করা প্রয়োজন।
ওয়েবিনারে ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ড. মো. হামিদ উল্লাহ ভূঁইয়া বলেন, পুঁজিবাজারের উন্নয়নের সঙ্গে আর্থিক প্রতিবেদন ও নিরীক্ষার স্বচ্ছতার বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ধারাবাহিকভাবে নজরদারি কার্যক্রম অব্যহত রাখব আমরা। এক্ষেত্রে কোনো ধরনের ব্যত্যয় হলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
অতীতের বিষয়গুলো নিয়ে পড়ে না থেকে সামনের দিকে দৃষ্টি দেয়ায় গুরুত্বারোপ করে বিএসইসি চেয়ারম্যান প্রফেসর শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম বলেন, পুঁজিবাজারের সুশাসন ও সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য কাজ করছি। ডেরিভেটিভস নিয়ে কাজ করার পরিকল্পনা রয়েছে। এরই মধ্যে আমরা কনভার্টিবল বন্ডের কাজ শুরু করে দিয়েছি। আর্থিক হিসাব ও নিরীক্ষার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য আমরা এরই মধ্যে নিরীক্ষক ও বিভিন্ন অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে আলোচনা করেছি। এছাড়া এ বিষয়ে এফআরসিও আমাদের সহযোগিতা করবে। জালিয়াতি ও প্রতারণা করেছে এমন বেশকিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে এরই মধ্যে শাস্তি দেয়া হয়েছে, পুঁজিবাজার থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বন্ড মার্কেটের উন্নয়নে আমরা গত কয়েক মাসে ৭ হাজার কোটি টাকার বন্ড অনুমোদন দিয়েছি। অবকাঠামো বন্ডের কথা উঠেছে। আমরা কিন্তু মিউনিসিপ্যাল বন্ড দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছি। এটি বর্তমানে এলজিআরডিতে আছে।
তিনি বলেন, আমরা দায়িত্ব নেয়ার পর আইন সংশোধন করে বীমা কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্তির সুযোগ করে দিয়েছি। এখন কোম্পানিগুলোর সুশাসনের দিকে আমরা নজর দিব। নতুন প্রজন্মের এনআরবিসি ব্যাংক তালিকাভুক্ত হওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। আমরা পুঁজিবাজারে তথ্যপ্রযুক্তিগত উন্নয়নের উদ্যোগ নিয়েছে। এজন্য স্টক এক্সচেঞ্জের ট্রেডিং সিস্টেম আপডেট ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়াতে বলা হয়েছে। বাজারের শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সুপারভিশন, মনিটরিং ও এনফোর্সমেন্ট কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। দেশের পুঁজিবাজারে প্রকৃত কোনো ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক নেই। অবশ্য এ ধরনের প্রতিষ্ঠান থাকতে হলে যে ধরনের বিনিয়োগ প্রয়োজন সেটি আমাদের এখানে অনুপস্থিত। অবশ্য যদি বিদেশী কোনো ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক প্রথমে ছোট পরিসরে আমাদের এখানে কার্যক্রম পরিচালনা শুরু করে পরবর্তী সময়ে বড় আকারের কার্যক্রমে যায় সেটি ভালো হবে। আর ওয়ালটনের বিডিং আমরা দায়িত্ব নেয়ার আগেই সম্পন্ন হয়েছে। এক্ষেত্রে আমাদের তেমন কিছু করার সুযোগ ছিল না। আমরা শুধু সাধারণ বিনিয়োকারীদের জন্য কাট-অফ প্রাইসের ১০ শতাংশের পরিবর্তে ২০ শতাংশ ছাড়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছি।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আসাদুল ইসলাম বলেন, আমরা চাই ব্যাংকনির্ভরতা কমিয়ে পুঁজিবাজার থেকেই দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন আসুক। সে লক্ষ্যেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব পাবলিকলি লিস্টেড কোম্পানিজের (বিএপিএলসি) প্রেসিডেন্ট আজম জে চৌধুরী বলেন, ব্যাংকের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন সম্ভব নয়। এটি আসতে হবে পুঁজিবাজার থেকে। বাজারকে গতিশীল করতে হলে তারল্য বাড়াতে হবে। ব্যাংকের বিনিয়োগের মাধ্যমে পুঁজিবাজারে তারল্য বাড়ানো সম্ভব। পরীক্ষামূলকভাবে হলেও সরকারের বড় মেগাপ্রকল্পগুলোর বিনিয়োগ পুঁজিবাজার থেকে নেয়া যেতে পারে।
সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি অব বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিডিবিএল) চেয়ারম্যান শেখ কবীর হোসেন বলেন, পুঁজিবাজার শক্তিশালী হলে অর্থনীতিও শক্তিশালী হয়। যে দেশ যত উন্নত তাদের পুঁজিবাজারও তত উন্নত। নিরীক্ষা ও ক্রেডিট রেটিংয়ের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা থাকা প্রয়োজন। এ বিষয়ে বিএসইসির নজর দেয়া প্রয়োজন।
মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) প্রেসিডেন্ট নিহাদ কবির বলেন, অনেক কোম্পানি পুঁজিবাজারে আসতে দ্বিধা বোধ করে। এর কারণ বিএসইসির খুঁজে দেখা উচিত। অনেকে বলে যে পুঁজিবাজারে যথাযথ ভ্যালুয়েশন পাওয়া যায় না। এখানে অনেক মন্দ কোম্পানির শেয়ারের দাম বেশি, কিন্তু ভালো কোম্পানির দাম কম। বিদেশী বিনিয়োগকারীদের কাছে দেশের তালিকাভুক্ত কোম্পানির ডিসক্লোজারের বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। আর তা যথেষ্ট নয় বলেও তারা মনে করেন। এছাড়া তালিকাভুক্ত কোম্পানির সঙ্গে শেয়ারহোল্ডারদের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও ঘাটতি রয়েছে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) চেয়ারম্যান মো. ইউনুসূর রহমান বলেন, ২০১৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত এ তিন বছরে পুঁজিবাজার নিম্নমুখী ছিল কেন সেটি পর্যালোচনা করে দেখা প্রয়োজন। অনেক আইন-কানুন থাকা সত্ত্বেও সেগুলো যথাযথভাবে পরিপালন করা হয়নি বলে এমনটি হয়েছে। ডিএসইতে প্রয়োজনীয়সংখ্যক দক্ষ ও যোগ্য লোকবলের ঘাটতি রয়েছে। পুঁজিবাজারের উন্নয়নে সুশাসন, দক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তি, নতুন পণ্য ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহীম বলেন, সব কোম্পানি যাতে স্বচ্ছ আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে, সেটি এফআরসি নিশ্চিত করতে পারে। বিএসইসি বর্তমানে যেভাবে নজরদারি করছে সেটি ভালো। পুঁজিবাজারে ভালো কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্তিতে উৎসাহিত করতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সঙ্গে বসে একটি সর্বজনীন কর ছাড় নীতি প্রণয়ন করা যেতে পারে।
ওয়েবিনারে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বিএসইসির কমিশনার প্রফেসর ড. শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিএসইসির কমিশনার প্রফেসর ড. মিজানুর রহমান। এতে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) প্রেসিডেন্ট মো. ছায়েদুর রহমান, ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) প্রেসিডেন্ট শরীফ মো. আনোয়ার হোসেন, ডিএসইর শেয়ারহোল্ডার পরিচালক মো. রকিবুর রহমান, পদ্মা ব্যাংকের চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিস সরাফাত, অ্যাসোসিয়েশন অব অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিজ অ্যান্ড মিউচুয়াল ফান্ডসের প্রেসিডেন্ট ড. হাসান ইমাম, ভেঞ্চার ক্যাপিটাল অ্যান্ড প্রাইভেট ইকুইটি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ভিসিপিইএবি) প্রেসিডেন্ট শামীম আহসান প্রমুখ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।