Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বাংলাদেশে করোনা পরবর্তী যুব কর্মসংস্থানে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে- ফারাহ্ কবির

অর্থনৈতিক রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১৯ জুলাই, ২০২০, ৭:১৯ পিএম

করোনা পরিস্থিতির কারণে আমরা এক নতুন বিশ্ব ব্যবস্থায় প্রবেশ করছি উল্লেখ করে একশনএইড বাংলাদেশ-এর কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির বলেছেন, করোনার জন্য নতুন নতুন চিন্তার অবকাশ হয়েছে, পাশাপাশি নতুন করে কাজও করতে হচ্ছে। দারিদ্র্যসীমার নিচে নতুন করে অনেকেই চলে আসছে। সময় এখন নতুনভাবে ভাবার, করোনা পূর্ববর্তী অসম ও বৈষম্যমূলক চিন্তার অবসান ঘটিয়ে সমন্বিতভাবে একযোগে কাজ করতে হবে।

একশনএইড বাংলাদেশ ও ডেইলি স্টারের যৌথ উদ্যোগে ‘কোভিড-১৯ পরবর্তী যুব কর্মসংস্থানের চিত্র’ শীষর্ক এক ভার্চুয়্যাল রাউন্ড টেবিল বৈঠকে ফারাহ কবির এই কথা বলেন।

কোভিড-১৯ এর কারণে উদ্ভূত ভিন্ন পরিস্থিতিতে যে ভিন্ন ধরনের দক্ষতা প্রয়োজন সেগুলো কি এবং কতটুকু আমরা অর্জন করতে পারছি যে বিষয়ে প্রশ্ন তুলেন ফারাহ কবির। সব ক্ষেত্রে সমন্বয় নিয়ে একসাথে কাজ করলে এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রত্যাশিত ফল পাওয়া সম্ভব বলে তিনি মনে করেন। বিভিন্ন পেশাজীবীদের সমান স্বীকৃতি দেবার পাশাপাশি গবেষণায় বেশি বিনিয়োগেরও আহ্বান জানান তিনি। ‘ইয়ং পিপল ইগনিটিং ট্রান্সফরমেশন’ নামে একটি মাইক্রোসাইটেরও উন্মোচন করা হয় এই রাউন্ড টেবিল বৈঠকে। মাইক্রোসাইটটি যৌথভাবে উন্মোচন করেন একশন এইড বাংলাদেশ এর কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির এবং ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম। যুব বিষয়ক সকল তথ্য যাতে এক জায়গায় পাওয়া যায় সেই উদ্দেশ্যে এই মাইক্রোসাইট তৈরি করা হয়েছে বলে জানান ফারাহ্ কবির।

ডেইলি স্টার এর সম্পাদক মাহফুজ আনাম তার বক্তব্যে বলেন, ভবিষ্যতের যুবসমাজের সম্পৃক্ততা বাড়ানোর চিন্তা থেকেই এই মাইক্রোসাইট উন্মোচনের প্রয়াস। আমরা যুবদের নিয়ে অনেক কথা বলি, কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় যুব উন্নয়নে অনেক ঘাটতি রয়েছে। যুব উন্নয়নে যত নীতি গ্রহণ করা হয়েছে তা সত্যিকার অর্থেই বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে নজর দেয়ার কথা বলেন মাহফুজ আনাম। সরকার যতটুকু বরাদ্দ দিচ্ছে তার বাস্তবায়ন সঠিক হচ্ছে কি না সে ব্যাপারে আরো সচেতন হতে হবে বলে জানান তিনি। দক্ষ যুবশক্তির উপর গুরুত্বারোপ করে মাহফুজ আনাম বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে যুবরা নৈরাশ্যের জগতে বাস করছে, তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের অভাব আছে। আমাদেরকে তাদের কাছে পৌঁছে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে হবে।

একশনএইড বাংলাদেশ-এর ডেপুটি ম্যানেজার হাতেম আলী তার বক্তব্যে বলেন, শিক্ষিত যুবদের মধ্যে বেকারত্বের হার বেশি । করোনা পরিস্থিতি যুবদের সবচেয়ে বড় সমস্যায় ফেলেছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কারণে যুবদের দক্ষতার সাথে শ্রমবাজারের চাহিদা মিলছে না। করোনার আলোকে ন্যাশনাল স্কিল ডেভেলপমেন্ট পলিসিকে রিভিউ করতে হবে বলেও জানান তিনি। তাছাড়া যুবদের সোশ্যাল সেফটিনেস প্রোগ্রামের আওতায় নিয়ে আসার আহ্বানও জানান তিনি ।

করোনা আমাদের উন্নয়নের একটি সুযোগ করে দিয়েছে উল্লেখ করে বাংলাদেশ কারগরি শিক্ষা বোর্ড (বিটিইবি) এর স্পেশালিস্ট ড মুহাম্মদ শাহ আলম মজুমদার বলেন, আমাদের দেশে কোন ন্যাশনাল কোয়ালিফিকেশন ফ্রেমওয়ার্ক নেই। সারা বিশ্বের ১২৯ টি দেশে শিক্ষা আইন রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন আমাদের দেশে শিক্ষা নীতি থাকলেও শিক্ষা আইন বাস্তবায়িত হয়নি। শিক্ষা আইন না থাকার কারণে আমরা বাধ্যতামূলক ভাবে শিক্ষা উন্নয়নে অনেক কিছুই করতে পারছিনা, যার ফলে প্রথাগত দক্ষতা উন্নয়ন থেকে আমরা বের হয়ে আসতে পারছিনা। নির্দিষ্ট কোয়ালিফিকেশন ফ্রেমওয়ার্ক প্রণয়নের মাধ্যমে দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ প্রদানের আহ্বান জানান তিনি। প্রযুক্তিগত উন্নয়ন না হলে এসডিজি অর্জন করাও সম্ভব হবে না বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।

দক্ষতাই সমৃদ্ধি আনতে পারে উল্লেখ করে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাজ করা ডি ইঞ্জিনিয়ার ক্লাব এর প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি সৌমেন কানুনগো বলেন, এইচএসসি এর পরে সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে। ঝরে পড়া শিক্ষার্থী বাছাই করে আমরা তাদেরকে দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে আয়মূলক কাজে যুক্ত করে দেয়ার ব্যবস্থা করে থাকি। প্রশিক্ষণ মডিউল আধুনিকীকরণ ও উন্নয়নের পাশাপাশি প্রশিক্ষককেও আরো বেশি যুগপোযোগী হবার আহ্বান জানান তিনি।

কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির আহ্বান জানিয়ে একশনএইড বাংলাদেশ-এর ম্যানেজার নাজমুল আহসান বলেন, নারী যখন কর্মক্ষেত্রে যায় তখন তাদের নানামুখী বাধার সম্মুখীন হতে হয়। সামাজিক ট্যাব্যু নির্মুল না করলে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানো যাবে না। পাশাপাশি দক্ষতা উন্নয়ন ও শ্রম বাজারের সাথে নারীদের যোগাযোগের অভাবও রয়েছে। এছাড়া গ্রাম-শহর, নারী-পুরুষ কিংবা ধনী-দরিদ্রভেদে প্রযুক্তিগত ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বিদ্যমান বৈষম্য না ঘুচালে তুণমূল জনগোষ্ঠীর ন্যায্যতা নিশ্চিত করা সম্ভবপর হবে না বলেও তিনি মত প্রকাশ করেন।

এসডিজি অর্জনে নারীর অংশগ্রহণ প্রয়োজন উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাজারের চাহিদার সাথে সংগতি রেখে যুবদের দক্ষতা উন্নয়ন করতে হবে। করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমাদের পুর্ণাঙ্গ ডাটাবেজ তৈরি করা দরকার যাতে যুবদের চাহিদা ও প্রয়োজন অনুযায়ী দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়।

আওয়াজ ফাউন্ডেশন এর নির্বাহী পরিচালক নাজমা আক্তার বলেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জ মুখে পড়েছে অদক্ষ যুবা বিশেষ করে নারীরা। দক্ষতার অভাবের কারণে সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর অংশগ্রহণ তেমন নেই বললেই চলে । তাই সবার আগে নারী শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন দরকার।

জনমিতি লভ্যাংশ এর ফসল ঘরে তুলতে হলে যুবদের দক্ষতা উন্নয়ন আবশ্যক উল্লেখ করে বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশন এর সভাপতি কামরান টি রহমান বলেন, প্রযুক্তিগত আবিষ্কারের ফলে শ্রমবাজারে ব্যপক পরিবর্তন এসেছে, আমরা যতো তাড়াতাড়ি সেটি গ্রহণ করতে পারবো আমাদের জন্য লাভজনক হবে।

নতুন নতুন শ্রমবাজার এর চাহিদা থাকলেও প্রশিক্ষণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান কাজ করতে পারছে না উল্লেখ করে ইউসেপ বাংলাদেশ এর নির্বাহী পরিচালক তাহসিনা আহমেদ বলেন, ইউসেপ থেকে পূর্বে যেখানে দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ গ্রহণ ৯০ শতাংশ চাকরি পেতো সেই হার এই করোনা পরিস্থিতির কারণে অনেক কমে এসেছে। ইউসেপ থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে কর্মরতদের মধ্যে ৩০ শতাংশ চাকরিও হারিয়েছেন। এজন্য প্রশিক্ষণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানকে সহযোগিতা করতে হবে। শিক্ষা বাজেটে কারিগরি শিক্ষা অবহেলিত বলেও তিনি উল্লেখ করেন। শিক্ষার জন্য বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে ইন্টারনেট প্যাকেজ প্রদান করার আহ্বান জানান তিনি।

কূটনৈতিক দক্ষতার কারণে এই দূর্যোগের দিনেও বিদেশ ফেরত অভিবাসীর সংখ্যা অনেক কম বলে উল্লেখ করে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এর যুগ্ম সচিব এমএস নাসরিন জাহান বলেন, যারা বিদেশ থেকে করোনার জন্য ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছে তাদের সমাজে পুনরেকত্রীকরনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক থেকে বিদেশ ফেরতদের সহজ শর্তে ঋণ প্রদাণের ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়েছে। তাছাড়া করোনার কারণের নতুন করে চাহিদা তৈরির ভিত্তিতে প্রশিক্ষণ প্রদান করার ব্যপারে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

বৈঠকে উপস্থিত একসেস টু ইনফরমেশনম (এটুআই) এর পলিসি এডভাইসর আনির চৌধুরী বলেন, শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে কোন ধরণের কাজ করার মানষিকতা না থাকার ফলে আমাদের দেশে বেকারত্বের হার বেশি। করোনার কারণে শ্রম বাজার দ্রুত পরিবর্তন আসছে। যুবদের তাই ভোকেশনাল শিক্ষায় উদ্ভদ্ধ করতে হবে। এজন্য ভোকেশনাল শিক্ষয় অধীক অর্থায়ন প্রয়োজন। বিদেশ ফেরত সহ দেশে বিভিন্ন কাজে অভিজ্ঞদের পূর্ব অভিজ্ঞতার সনদ (আরপিএল) প্রদান করার আহ্বানও জানান তিনি। তাছাড়া মাদরাসা গ্রাজুয়েটদের প্রতিও বিশেষ নজর দিতে হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

দক্ষতা উন্নয়ন নীতির সংস্কার প্রয়োজন বলে মনে করেন অনুষ্ঠানে উপস্থিত বাংলাদেশ বাংলাদেশ শিল্প কারিগরি সহায়তা কেন্দ্র (বিআইটিএসি) এর ডিরেক্টর জেনারেল ড. এমডি মফিজুর রহমান। শিক্ষা বাজেটের খুব কম দক্ষতা উন্নয়নে ব্যয় হয় উল্লেখ করে তিনি এই খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর আহ্বানও জানান।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এর কান্ট্রি ডিরেক্টর টওমো পটিয়েনেন তার বক্তব্যে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবেলায় সব সেক্টরকে সক্রিয়ভাবে কাজ করতে হবে। এই মূহূর্তে শ্রমবাজারের প্রতি নজর দিতে হবে এবং যুবদেও জন্য দক্ষতা উন্নয়ন ও উদ্যোক্তা বান্ধব নীতি বাস্তবায়ন করতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ