Inqilab Logo

সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে দুধের বিকল্প নেই

কৃষিবিদ মো: নাজমুল হাসান | প্রকাশের সময় : ৭ জুলাই, ২০২০, ১২:৩৮ পিএম | আপডেট : ১২:৩৯ পিএম, ৭ জুলাই, ২০২০

করোনাভাইরাসের কোন প্রতিষেধক আবিষ্কার না হওয়ায় বিশ্বব্যাপী একটিই গবেষণা চলছে কিভাবে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো যায়। শরীরকে সুস্থ রাখতে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য প্রতিনিয়ত মানুষ অবলম্বন করছে নানা পদ্ধতি । করোনার ভয়াল থাবায় সারা বিশ্ব যখন দিশেহারা ঠিক তখনই আমরা বুঝতে পারছি পুষ্টিকর খাবার শরীরের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ । চিকিৎসক এবং পুষ্টিবিজ্ঞানীদের মতে, শরীর ভালো রাখতে পুষ্টিকর খাবারের কোন বিকল্প নেই। চিকিৎসক, পুষ্টিবিজ্ঞানী, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সবার মুখে একটাই কথা-কিভাবে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো যায়। শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার উন্নতি করতে হলে অবশ্যই প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় পুষ্টিকর খাবার রাখতে হবে। হাতের নাগালে পাওয়া সবচেয়ে সস্তা এবং পুষ্টিকর খাবারের মধ্যে দুধ হলো অন্যতম। অথচ মানুষের সচেতনতার অভাবে অনেকেই এই পুষ্টিসম্পন্ন খাবারটির কথা জেনেও গুরুত্ব দেয় না।
একটা সময় ছিলো মানুষের চাহিদা অনুপাতে দেশে দুধের ঘাঠতি ছিল । বর্তমানে হাজারো পশুবিজ্ঞানী এবং ডেইরী খামারীদের অক্লান্ত পরিশ্রমে দেশ এখন দুধে স্বয়ংসম্পূর্ণ । তার বাস্তব প্রমাণ পাওয়া যায় DLS এর তথ্য মতে । মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রনালয়ের তথ্যমতে, ২০০৮-২০০৯ এ দেশে দুধ উৎপাদন ছিলো ২২.৯ লক্ষ মেট্রিক টন। ২০১৮-২০১৯ এ এসে দাড়ায় ৯৯.২৩ লক্ষ মেট্রিক টন। এই সহজ পরিসংখ্যান বলে দেয় দুধ আমাদের সকল মানুষের জন্য কতটা সহজলভ্য। পশুবিজ্ঞানীদের অবদানের কারনে, দুধ হলো আমাদের দেশে সবচেয়ে সস্তা; পুষ্টিকর, আদর্শ প্রাণীজ খাবার। দুধের গুনাবলী সম্পর্কে আমরা অবগত নই বলে প্রত্যেকদিন বাহিরের বিভিন্ন রকম দামী রঙ্গিন খাবার খাই। নিজের শরীরে নিজেই কুড়াল মারি। এই সব রঙ্গিন খাবারের ফলে প্রেসার, ডায়াবেটিস, মানসিক অশান্তি লেগেই থাকে। যে পুষ্টি সম্পন্ন খাদ্য গ্রহণ করবে, তার ওপর ভাল প্রভাব পড়বে। আর যে রঙ্গিন অপুষ্টি জাতীয় খাবার গ্রহণ করবে তার ওপর এর খারাপ প্রভাব পড়বে এটাই স্বাভাবিক । অথচ হাতের কাছে পাওয়া দুধের উপকারীতা আমরা কাজে লাগাতে পারি না। চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে, `দুধ'ই হতে পারে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর একমাত্র হাতিয়ার।
অসংখ্য পুষ্টির সমন্বয়ে দুধ গঠিত। তাই দুধকে বলা হয় সুপার ফুড। দুধে রয়েছে ভিটামিন এ, ডি, বি১২, ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম ,ফসফরাস, প্রোটিন, নিয়সিন, রিবোফ্লাবিন, আয়রণ, জিংক, ম্যাঙ্গনিজ ও কপার।
১. দুধ ক্যালসিয়ামের সবচাইতে ভালো উৎস। আজকাল পেশীর ব্যথা ও দাঁতের ক্ষয় সব বয়সের লোকের মধ্যে দেখা যায়। নিয়মিত দুধ খেলে, দুধে থাকা ক্যালসিয়াম আমাদের দাঁত ও হাড়ের গঠন মজবুত করে। এছাড়াও দুধে থাকা ক্যালসিয়াম ভিটামিন ডি এর সাহায্যে পেশীর ব্যথা কমাতে সাহায্য করে এবং পাশাপাশি আমাদের পেশী মজবুত করে এবং হাড়ের ক্ষয় রোধ করে।
২. একটা সুস্থ মানুষের শরীরে প্রোটিন যে এতো দরকারী তা হয়তো আমরা অনেকেই জানি না। ২১ ধরনের অ্যামাইনো এসিডের সমন্বয়ে প্রোটিন তৈরি হয়। যার মধ্যে ৯টি আমাদের শরীরে তৈরি হয় না। আর এই ঘাটতি পুরণ করতে দুধের কোনো বিকল্প নাই। দুধে রয়েছে প্রচুর পরিমানে প্রোটিন যা মাংসপেশী গঠনে সহায়তা করে।
৩. কোলেস্টেরল নিয়ে আমরা সবসময় চিন্তাই মগ্ন থাকি। আমাদের সবার মনে একটা ভুল ধারনা বাসা বেধেছে যে কোলেস্টেরল শরীরের জন্য ক্ষতিকর। দুধে যে প্রোটিন থাকে তা খারাপ কোলেস্টেরল কমিয়ে ভালো কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি করে।
৪. দুধে বিদ্যমান ভিটামিন বি-১২ ত্বকে নমনিয়তা বজায় রাখতে সাহায্য করে, ফলে অল্প বয়সে চামড়া ঝুলে যায় না। ত্বক উজ্জ্বল হয় এবং তারুণ্যে ভরপুর থাকে।
৫. হার্টে রক্ত চলাচল সচল রাখতে নিয়মিত দুধ খাওয়া খুবই জরুরী । কারণ দুধে বিদ্যমান থাকে ভিটামিন-এ, ডি ও ক্যালসিয়াম-যা আমাদের হার্টে রক্ত জমাট বাঁধতে বাধা দেয় এবং হার্টকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।
৬. হৃদপিন্ডের পেশীর সুস্থতা বজায় রাখতে দুধে বিদ্যমান পটাসিয়ামের গুরুত্ব অপরিসীম। তাছাড়া দুধে উপস্থিত খনিজ উপাদান রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ রাখে এবং হৃদপিন্ড সতেজ রাখে।
৭. দুধে রয়েছে প্রচুর পরিমানে ফ্যাটি এসিড ও অ্যামাইনো এসিড। চুলের পুষ্টি যোগাতে, চুল সুন্দর ও মজবুত রাখতে দুধের ভূমিকা অপরিসীম।
৮. গর্ভাবস্থায় মায়ের জন্য দুধ অত্যন্ত উপকারী। দুধে বিদ্যমান আয়োডিন ভ্রুণের মস্তিষ্ক বিকাশে ভূমিকা পালন করে। তাছাড়া দুধের প্রোটিন, অ্যামিনো এসিড, ফ্যাটি এসিড শিশুর স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশের জন্য প্রয়োজন।
৯. শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং হজম শক্তি বৃদ্ধিতে দুধের ভূমিকা অনন্য। সারাদিনের মানসিক চাপ দুর করে শান্তির ঘুম নিশ্চিত করতে দুধ হতে পারে প্রধান হাতিয়ার।

দুধ আল্লাহ প্রদত্ত এমন নেয়ামত যা সবাই সহজে হজম করতে পারে। প্রত্যেকটি মানুষের জীবনে দুধের গুরুত্ব এতটাই অপরিহার্য যে, ইসলাম ধর্মেও দুধের গুনাগুন সম্পর্কে বলা হয়েছে। বর্তমান সময়ে চিকিৎসা বিজ্ঞান দুধের যে গুরুত্বের কথা বলে, সে গুরুত্বের কথা ইসলাম আজ থেকে বহু বছর আগে ঘোষণা করেছেন। চলুন দেখে নেই দুধের উপকারীতা সম্পর্কে ইসলাম ধর্মে কি বলা হয়েছে।
১. তোমাদের মধ্যে চতুষ্পদ জন্তুর মধ্যে চিন্তা করার অবকাশ রয়েছে। আমি তোমাদেরকে পান করাই উদরস্থ বস্তুসমূহের মধ্য থেকে গোবর ও রক্তনিঃসৃত দুগ্ধ, যা পনকারীদের জন্য উপদেয়। (সূরা আন নাহল-৬৬)
২. হযরত সুহাইব (রাঃ) বলেন, নবী করীম (সঃ) ইরশাদ করেছেন- গাভীর দুধ তোমাদের জন্য অপরিহার্য করে নাও। কেননা গাভীর দুধ অরোগ্য দানকারী। এর ঘি, ঔষধ এবং এর গোশতের মধ্যে রোগ নিরাময়ের ব্যবস্থা রয়েছে। (নেয়ামুল কুরআন-পৃষ্ঠা-৩৮৪)
৩. তোমাদের জন্য চতুষ্পদ জন্তু সমূহের মধ্যে চিন্তা করার বিষয় রয়েছে। তোমাদেরকে তাদের উদরস্থিত বস্তু থেকে দুধ পান করাই এবং তোমাদের জন্য তাদের মধ্যে প্রচুর উপকারিতা আছে। তোমরা তাদের কতককে ভক্ষণ করো। (সুরা আল মুমিনুনের ২১ নং আয়াত)
৪. সকল মানুষের সেরা মানুষ আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)। তিনি দুধ খুব পছন্দ করতেন । তার প্রমাণ পাওয়া যায় মেরাজের রাতে। আনাছ ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, মেরাজের রাতে হযরত জীবরাঈল (আঃ) আমার সম্মুখে তিনটি পেয়ালা তুলে ধরেন। একটি পেয়ালায় দুধ, একটিতে মধু, আর অন্যটিতে শরাব ছিল। আমি দুধের পেয়ালা গ্রহণ করলাম এবং পান করলাম। তখন আমাকে বলা হল আপনি এবং আপনার উম্মার স্বভাবজাত বস্তু গ্রহণ করছেন। (আধুনিক প্রকাশনী-৫১৯৯২,ইসলামীক ফাউন্ডেশন-৫০৯৫)
সহজে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো এবং সস্তা পুষ্টিকর খাবারের তালিকায় দুধকে পরিপূরক খাদ্য হিসেবে নয়, মূল খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। আল্লাহ প্রদত্ত যতোগুলো খাবার দেখি তার মধ্যে দুধ হলো সবচেয়ে বেশি পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যকর। শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য দুধের কোন বিকল্প নেই। তাই সব সময় মন প্রফুল্ল ও সতেজ এবং শরীরকে চাঙ্গা রাখতে হলে সব বয়সের মানুষের জন্য দুধ হলো অপরিহার্য।

লেখক : ব্যবস্থাপক-আফিল এগ্রো লিমিটেড
সাবেক শিক্ষার্থী পশুপালন অনুষদ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন