Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

চীনের অনন্য সহযোগীতা

শর্তহীনভাবে ৮২৫৬ পণ্যের প্রবেশাধিকার

হাসান সোহেল | প্রকাশের সময় : ২০ জুন, ২০২০, ৭:৫০ পিএম | আপডেট : ৭:৫১ পিএম, ২০ জুন, ২০২০

প্রাচীনকাল থেকেই চীন ও বাংলাদেশের জনগণ পরস্পরের ভালো প্রতিবেশী ও বন্ধু। চীনের ফাহিয়েন ও হিউয়েন সাং বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থের সন্ধানে এ অঞ্চলে এসেছিলেন। অন্যদিকে, বাংলাদেশের অতীশ দীপঙ্কর চীনে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার করেছেন। গত শতাব্দীর পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে তৎকালীন চীনা প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই দু’বার ঢাকা সফর করেন। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও দুইবার চীন সফর করেন। তাই, দুই দেশের বন্ধুত্ব সুদীর্ঘকালের।

# রফতানি বাণিজ্য প্রসারের বড় সুযোগ- বিশেষজ্ঞদের অভিমত

# সু-খবর, তবে সতর্ক থাকতে হবে আমরা যেন নির্ভরশীল হয়ে না পড়ি - ড. মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ

চীন-বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার অনেক আগেই দুই দেশের প্রবীণ নেতারা মৈত্রী বৃক্ষের চারাটি রোপণ করেছিলেন। যার শিকড় এখন অনেক গভীরে। গতবছরও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এফবিসিসিআই নেতারা বৃহত্তম বিনিয়োগ ও বাণিজ্য অংশীদার চীনের সাথে বিদ্যমান বাণিজ্য সম্পর্ক আরও সম্প্রসারণে প্রচেষ্টা চালান। পরবর্তীতেও একাধিকবার দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়ানোর উপায় নিয়ে চীনা ব্যবসায়ীদের সাথে আলোচনা করেছেন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) নেতারা। বিশেষ করে এ অঞ্চলে চীনের পণ্য আমদানির বড় ক্রেতা বাংলাদেশ। তবে চীনে পণ্য রফতানির গতি খুব একটা বাড়ছিলো না। মহামারি করোনায় দেশে যখন চরম অর্থনৈতিক মন্দা বিরাজ করছে। অনিশ্চিয়তা এবং হতাশা গার্মেন্টসসহ অন্যান্য রফতানিকারকদের মধ্যে। আর এই সময়েই চীন অনন্য সহযোগীতা বা অনন্য সুযোগের হাতছানি দিলো। যা চীনের বাজারে পণ্য রফতানির পথ আরো উন্মুক্ত হলো। দেশের রফতানি বাণিজ্য ঘুড়ে দাড়ানোর পথ সুগম করলো। পাশাপাশি বাংলাদেশকে ব্যাপক কর ছাড় দেওয়ায় দুই দেশের বন্ধুত্ব আরও গভীর হলো।

আগেই বাংলাদেশকে ৩ হাজারের বেশি পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয় চীন। কিন্তু এর মধ্যে তৈরি পোশাক না থাকায় তার সুফল পায়নি বাংলাদেশ। অবশেষে তৈরি পোশাককে শুল্কমুক্ত সুবিধায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। এতদিন এশিয়া প্যাসিফিক ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্টের (আপটা) আওতায় বাংলাদেশ চীনে ৩ হাজার ৯৫ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা পেয়ে আসছিল। কিন্তু তাতে তৈরি পোশাক না থাকায় সুফল খুব একটা মেলেনি। গত ১৬ জুন আরও ৫ হাজার ১৬১টি পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়েছে চীন, তাতে তৈরি পোশাকসহ বাংলাদেশের প্রধান রফতানিকৃত ১৭টি পণ্য আছে। আগামী ১ জুলাই থেকে বাংলাদেশে তৈরি পোশাকসহ ৮ হাজার ২৫৬টি পণ্য শুল্কমুক্ত সুবিধায় চীনে রফতানি করা যাবে। যা চীনের মোট ট্যারিফ লাইনের ৯৭ শতাংশ।

বিষয়টিকে বাংলাদেশের জন্য বড় সুযোগ দেখছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ও ব্যবসায়ীরা। বিশেষ করে করোনা মহামারীর এই দুঃসময়ে এটা একটি ভালো সংবাদ। তাদের মতে, এ পদক্ষেপ রফতানি বাণিজ্যকে প্রসারিত করবে। পাশাপাশি দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি কমে আসবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, চীন ১৪০ কোটি জনসংখ্যার একটি বিশাল সম্ভাবনাময় বাজার। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে এ দেশের জনগণের ক্রয়ক্ষমতা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে, একই উৎপাদন ব্যয়ও বৃদ্ধি পাচ্ছে। চীনের বাজারে ৯৭ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার সুবিধা পেলে তৈরি পোশাকসহ বাংলাদেশের রপ্তানি সক্ষমতা সম্পন্ন প্রায় সকল পণ্য চীনে শুল্কমুক্ত কোটামুক্তভাবে প্রবেশের সুবিধা পাবে। ফলে, চীনে রপ্তানি উল্লেখযোগ্য ভাবে বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা যায়। যা বাংলাদেশের বাণিজ্য বৈষম্য কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। এই সুযোগকে এখন সরকার ও ব্যবসায়ীরা কিভাবে ব্যবহার করে ঘুড়ে দাড়াবে সে নিয়ে পরিকল্পনা করার তাগিদ দেন বিশেষজ্ঞরা।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ড. মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ ইনকিলাবকে বলেন, চীন বাণিজ্যিক কর্তৃত্ব নেওয়ার জন্য বড় সুযোগ দিয়েছে। এটা দুই দেশের রফতানি বাণিজ্যকে প্রসারিত করবে। এর আগেও বড় বড় প্রকল্পে অর্থায়ন করছে। নতুন করে ৫ হাজার ১৬১টি পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়েছে এটা আমাদের জন্য অবশ্যই একটি সু-খবর। তবে সতর্ক থাকতে হবে আমরা যেন কোন ভাবেই তাদের উপর নির্ভরশীল হয়ে না পড়ি। একই সঙ্গে সক্ষমতা অর্জন করে প্রতিযোগীতামূলক মনোভাব বজায় রাখতে পারি বলে উল্লেখ করেন ড. মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ।

সুত্র মতে, বর্তমানে ৪ শতাধিক চীনা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে ব্যবসা পরিচালনা করছে। মূলত বিদ্যুৎ, টেক্সটাইল, চামড়া, প্রকৌশল ও অবকাঠামো নির্মাণ খাতে চীনের বিনিয়োগকারীরা কাজ করছে। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়ানোর উপায় নিয়ে চীনা ব্যবসায়ীদের সাথে একাধিকবার আলোচনা করেছেন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম। তিনি বলেন, শুধু রফতানি বাজারের সুযোগই নয়; সরকারের দেয়া আকর্ষণীয় বিনিয়োগ সুবিধা গ্রহণ করে চীনা ব্যবসায়ীরাও বাংলাদেশে আরও বিনিয়োগ বাড়াবে। যা বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও বড় ধরণের প্রভাব রাখবে বলে মনে করেন তিনি।

এর আগে আগামী এক থেকে দেড় দশকে চীন বাংলাদেশের জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ খাতে ৫ হাজার কোটি ডলারের বিনিয়োগ করবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। অপরদিকে চীনও মনে করে সেদিন খুব বেশি দূরে নয়, যেদিন চীন বাংলাদেশের এক নম্বর বিনিয়োগকারী দেশে পরিণত হবে।

তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি ও এফবিসিসিআই’র সহ-সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান ইনকিলাবকে বলেন, চীন বড় দেশ। বড় অর্থনীতির দেশ। চীনে বিশ্বের বড় বড় ব্রান্ড কাজ করে। চীনের অভ্যন্তরীণ বাজারও অনেক বড়। তাই চীনের বাজারে প্রবেশ আমাদের জন্য বড় সুযোগ। সিদ্দিকুর রহমান বলেন, এই সুবিধা শুধু রফতানি বাণিজ্যকে প্রসারিত করবে না। চীনও আমাদের দেশে বিনিয়োগ বাড়াবে। এখানে পণ্য উৎপাদন করবে। যা আমাদের কর্মসংস্থানেরও সুযোগ সৃষ্টি করবে। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি কমে আসবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

বিকেএমইএ’র প্রথম সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, করোনার এই দুঃসময়ে এটা ভালো সংবাদ। এই মহামারীতে অন্য সব দেশের যেখানে পোশাক রফতানি নেতিবাচক, সেখানে চীনে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। বাংলাদেশের বেসিক আইটেমের প্রচুর চাহিদা রয়েছে সেখানে। এখন নিজেদের অভ্যন্তরীণ জটিলতা কমিয়ে আনতে পারলে এর সুফল পাওয়া যাবে।

তথ্য মতে, গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চীন থেকে বাংলাদেশে আমদানির পরিমাণ ছিল প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি মার্কিন ডলার। এর বিপরীতে বাংলাদেশের রফতানির পরিমাণ ছিল এক বিলিয়ন ডলারের নিচে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, চীনের সঙ্গে বাণিজ্য বৈষম্য কমিয়ে আনতে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির দিকনির্দেশনায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নানা উদ্যোগ গ্রহণ করে। এ লক্ষ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনক্রমে চীনের সঙ্গে বিনিময়পত্র স্বাক্ষর করে।

সর্বপ্রথম চীন ২০১০ সালের ১ জুলাই স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে শুল্কমুক্ত কোটামুক্ত বাজারে প্রবেশাধিকার সুবিধা প্রদান করে। প্রাথমিকভাবে এ সুবিধার আওতায় বাংলাদেশসহ ৩৩টি স্বল্পোন্নত দেশ চীনের ৬০ শতাংশ ট্যারিফ লাইনে শুল্কমুক্ত সুবিধা পায়। কিন্তু চীনের এ সুবিধা বাংলাদেশের রফতানি সক্ষমতার অনুকূল কিনা তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা যায়, বাংলাদেশের রফতানি সক্ষমতা আছে এমন অনেক পণ্য শুল্কমুক্ত সুবিধার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি। এ প্রেক্ষিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বাংলাদেশের জন্য রফতানি সম্ভাবনাময় পণ্যে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার সুবিধা প্রদানের জন্য চীনকে অনুরোধ করে। বাংলাদেশের অনুরোধের পর চীন লেটার অব এক্সচেঞ্জ স্বাক্ষর করে। দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর ১৬ জুন চীন বাংলাদেশকে শর্তহীনভাবে ৯৭ শতাংশ পণ্যে (৮ হাজার ২৫৬টি পণ্য) শুল্কমুক্ত কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার সুবিধা প্রদান করে আদেশ জারি করে। এর ফলে চীনের বাজারে বাংলাদেশের সব সম্ভাবনাময় পণ্য শুল্কমুক্ত কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার সুবিধা পাবে, যা ১ জুলাই কার্যকর হবে।



 

Show all comments
  • Mohammed Shah Alam Khan ২০ জুন, ২০২০, ১০:৩২ পিএম says : 0
    খবরটা খুবই ভাল তবে এতে লাভবান হবে চীন কারন বাংলাদেশে শ্রমের মূল্য চীনের চেয়েও কম সাথে সাথে পোষাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ চীনকে ক্রমান্বয়ে ছাড়িয়ে যাচ্ছে এটা চীনের জন্যে একটা ভয়ের করানও বটে। সেজন্যে নিন্দুকেরা বলছেন, চীনারা চাচ্ছে তারা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে পোষাক শিল্প গড়ে তুলবে এবং সেখানে থেকে উৎপাদিত পোষাক তারা নিজদেশে এবং বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি করবে। চীনারা ইতিমধ্যে তাদের দেশে পোষাক শিল্প তুলে দেয়ার চিন্তা ভাবনা করে আসছে বহু বছর আগে থেকেই এখন তারা বাংলাদেশের সাথে এই চুক্তি করে তাদের স্বার্থ বজায় রেখে বাংলাদেশেরও শ্রম বাজার চাঙ্গা রেখে বাংলাদেশের সাথেও বন্ধুত্ব বজায় রাখবে এটাই তাদের নীতি। আল্লাহ্‌ আমাদের দেশের সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী দেরকে সত্য বলা ও সততার সাথে চলার ক্ষমতা দান করুন। আমিন
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ