Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নার্সরাই অবহেলিত

হাসপাতালে করোনা রোগীদের সেবা

হাসান সোহেল | প্রকাশের সময় : ১৭ এপ্রিল, ২০২০, ১১:৫০ পিএম

‘দি প্লেগ’ ফরাসি ভাষার একটি উপন্যাস। ফরাসি উপনিবেশ শুরুর পর বর্তমান আলজেরিয়ার ওরান অঞ্চলের প্লেগ মহামারির প্রেক্ষাপটে এই উপন্যাস রচনা করেন নোবেল বিজয়ী ফরাসি সাহিত্যিক আলবেয়ার কামু। এটা লেখা হয় বিংশ শতাব্দীর চল্লিশের দশকে। সেই মহামারিতে প্রায় ২০০ মিলিয়ন মানুষ মৃত্যুবরণ করে। মহামারির সেই কালো মৃত্যুর কালেরসাক্ষী এই উপন্যাস। উপন্যাসের গল্পের বর্ণনায় দেখা যায়, ডা. বার্নাড রিও শত শত প্লেগ আক্রান্ত মানুষকে সুস্থ করে তুলেছেন। কিন্তু তিনি নিজের স্ত্রীকে রক্ষা করতে পারেননি। কারণ যে কোনো মহামারীতে ডাক্তার-নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ফ্রন্টলাইন যোদ্ধার ভূমিকা পালন করতে হয়। বর্তমানে শুধু উন্নত দেশেই নয়, বাংলাদেশেও আমাদের চিকিৎসক-নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা একই ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। কিন্তু চিকিৎসা সেবায় অব্যবস্থাপনায় এসব ফ্রন্টলাইন যোদ্ধাদের জীবনের ঝুঁকি বাড়ছেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক তথ্যমতে, ইতোমধ্যে বিশ্বের ৫২টি দেশে প্রায় ২৩ হাজার স্বাস্থ্যকর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। বাংলাদেশেও এই সংখ্যা কম নয়। চিকিৎসকদের নিয়ে কাজ করা বাংলাদেশ ডক্টরস ফাউন্ডেশন (বিডিএফ) এর তথ্য মতে, গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত ৯০ জন চিকিৎসক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এদের মধ্যে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) আছেন ৩ জন। ইতোমধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন সিলেটের ডা. মো. মঈন উদ্দিন। অপরদিকে নার্স নেতাদের তথ্য অনুসারে, এখন পর্যন্ত ৫৪ জন নার্স করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। তবে কোয়ারেন্টিনে আছেন সহ¯্রাধিক স্বাস্থ্যকর্মী।
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিশ্বব্যাপি করোনাভাইরাসের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন চিকিৎসক-নার্স-টেকনোলজিস্ট ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। বর্তমান মহামারী থেকে রক্ষা করতে রোগীর সেবায় নিজেদের উজাড় করে দিচ্ছেন। অথচ মানুষকে বাঁচানো প্রথম সারির এই যোদ্ধারাই স্বাস্থ্য খাতের সমন্বয়হীনতার স্বীকার। তারা ঠিকমতো খেতে এবং ঘুমাতে পারেন না। তাই প্রতিটি মুহুর্ত সংক্রমিত হওয়ার অজানা আতঙ্ক তাড়া করছে। এছাড়া দিনভর হাড়ভাঙা খাটুনির পর নিম্নমানের খাবার দেয়ায় অনেক নার্স এর মধ্যেই শারীকিরভাবে অসুস্থবোধ করছেন।
সূত্র মতে, কিছুদিন আগেও রাজধানীর উত্তরার কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সদের থাকা-খাওয়া নিয়ে বিপাকে পড়তে হয়। অবশ্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হাবিবুর রহমান খান ইতোমধ্যে ইনকিলাবকে নিশ্চিত করেছেন ওখানকার সমস্যার সামধান করা হয়েছে। যদিও দেশের অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর এখনও খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। এখনো চিকিৎসক-নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের পর্যাপ্ত পিপিই, এন-৯৫ মাস্ক, সু-কভার ইত্যাদির অভাব রয়েছে। একই সঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী চিকিৎসক-নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের থাকা-খাওয়া থেকে অন্যান্য সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হয়নি।
করোনার রোগীদের সেবা প্রদানকারী চিকিৎসক-নার্স-টেকনোলজিষ্টসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের থাকা-খাওয়া থেকে সুরক্ষার অব্যবস্থাপনা গত কিছুদিন থেকে ইনকিলাবসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে আসে। এরপর চিকিৎসকদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও এখনও অবহেলিত নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীরা। আর এমনই অবহেলার এক চিত্র উঠে এসেছে দেশের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা নারায়নগঞ্জের করোনা সেলে সেবা দেওয়া নার্সদের। করোনা রোগীদের জন্য বিশেষায়িত খানপুর হাসপাতালের দায়িত্বরত চিকিৎসকদের জন্য নারয়নগঞ্জ ক্লাবে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করলেও নার্সদের জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছে খুবই পুরাতন ও জরাজীর্ণ ভবন নারায়নগঞ্জ ডাকবাংলো। ভুক্তভোগী নার্সদের মতে যা প্রায় শত বছরের পুরাতন ও স্যাতসেতে ভবন। এখানেই শেষ নয়; ওখানকার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক নার্স গত বৃহষ্পতিবার রাতে ইনকিলাবকে জানান, দুপুরের শিফটে ডিউটি করে রাতে হোটেলে ফেরার সময় দেখা যায় এ্যাম্বুলেন্স নেই। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরও এ্যাম্বুলেন্স না পেয়ে তারা রিকশায় করেই হোটেলে ফেরেন। যদিও নি¤œমানের হোটেল হওয়ায় দুই জন নার্স হাসপাতালেই থেকে যান। বাকী ৬ জন নার্স হোটেলে এসে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে খাবার খেতে গিয়ে দেখনে চার পিস আলু, ১ পিস মুরগির গোশত, ডাল ও ভাত। যা খুবই নি¤œ মানের। কিন্তু এখানেই অব্যবস্থাপনার শেষ নয়; তারা জানালেন খাওয়ার পর দেখা গেল পানি নেই। সারাদিন পরিশ্রম করার পর হাত ধোয়ার পানিটুকুও তারা পাননি। এতো রাতে কাউকে কিছু বলতেও পারছেন না।
ভুক্তভোগী নার্সরা জানান, ৩ দিন আগে খাওয়ার পর ঝুঁড়িতে যে উচ্ছিষ্ট রাখা হয়েছে। তাও কেউ পরিষ্কার করেনি। এমনকি রুম পরিস্কার করার মতোও কেউ নেই। গন্ধে রুমে থাকাও দায়। একই সঙ্গে খুবই পুরাতন ফ্যান রুমে থাকলেও স্যাতসেতে ওই ডাকবাংলাতে থাকা খুবই কষ্টকর। তাদের মতে, খুবই নিম্নমানের কক্ষে তাদেরকে রাখা হয়েছে। তারা খুব খারাপ অবস্থায় আছেন বলেও জানান। সূত্র মতে, গত ১২ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের করোনা ইউনিট চালু হলেও নার্সদের থাকার ভাল ব্যবস্থা না করেই কার্যক্রম চালু করা হয়েছে খানপুর হাসপাতালের।
দেশে ৫৪ জন নার্স করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন সোসাইটি ফর নার্সেস সেফটি অ্যান্ড রাইটস সংগঠনের মহাসচিব সাব্বির মাহমুদ। তিনি জানান, আক্রান্ত নার্সদের মধ্যে সরকারি হাসপাতালের ২৮ জন আর বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ২৬ জন চিকিৎসাধীন আছেন। এছাড়া হাসপাতাল ও ক্লিনিকের আক্রান্ত রোগীদের সংস্পর্শে এসেছিলেন এমন ২৫০ থেকে ৩০০ নার্স কোয়ারেন্টিনে রয়েছেন।
শুক্রবার রাতেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হাবিবুর রহমান খানকে বিষয়টি জানালে তিনি ইনকিলাবকে বলেন, স্থানীয়ভাবে খুব ভালোভাবেই নার্সদের রাখার কথা। আমি সকালেই স্থানীয় প্রশাসনকে জানাচ্ছি। অবশ্যই চিকিৎসকদের মতো নার্সদেরও ভালোভাবে রাখা তাদের দায়িত্ব। তবে শুক্রবার রাতে ওখানকার নার্সদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, থাকার জন্য ডাকবাংলো থাকলেও থাকলেও ইতোমধ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছে। একই সঙ্গে আরও নার্স প্রয়োজন আছে হাসপাতালে তাই দ্রæত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানানো হয়েছে তাদেরকে।
ফ্রন্টলাইনের যোদ্ধাদের নিরাপত্তা সরঞ্জাম, খাবার ও থাকার ব্যবস্থা স্ব স্ব হাসপাতালেই করার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসা পেশাজীবীরা। মেডিকেল পেশা ও প্রশাসনের সংশ্লিষ্টদের নিয়ে কার্যকরী কমিটি প্রণয়নের দাবি করেন পেশাজীবীরা।
বাংলাদেশ নার্সেস অ্যাসোসিয়েশন (বিএনএ) ও স্বাধীনতা নার্সেস পরিষদের (স্বানাপ) একাধিক শীর্ষ নেতা রাজধানীসহ সারাদেশে করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত নার্সদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জোর দাবি জানিয়ে বলেন, ফ্রন্টলাইন ফাইটার হিসেবে তাদের নিরাপত্তা দিতে না পারলে করোনা পরিস্থিতির আরও অবনতি কিংবা রোগী বৃদ্ধি পেলে নার্সের আরও সংকট দেখা দেবে।
বাংলাদেশ নার্সেস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএনএ) কেন্দ্রীয় কমিটির মহাসচিব এবং ঢামেক শাখার সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান জুয়েল বলেন, নার্সদের শীর্ষ সংগঠনের নেতাদের নার্সিং অধিদফতরের মনিটরিং টিমে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। নার্সদের নিরাপত্তাসহ সার্বিক কার্যক্রম গতিশীল করতে নার্স নেতাদের অন্তর্ভুক্ত করা এখন সময়ের দাবি। যদিও ইতোমধ্যে বাংলাদেশে করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবেলায় চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের উদ্বুদ্ধ করতে পুরস্কৃত করারও ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অথচ করোনা রোগীদের সেবায় নিয়োজিত নার্সদের মানসম্পন্ন পরিবেশে থাকা এবং সুষম খাওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে না। এদিকে বিডিএফ’র চেয়ারম্যান ডা. মো. শাহেদ রাফি পাভেল ইনকিলাবকে বলেন, দেশে এ পর্যন্ত ৯০ জন চিকিৎসক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এদের মধ্যে আক্রান্তদের মধ্যে তিনজন চিকিৎসার পর সুস্থ হয়েছেন। তাদের ছুটি দেওয়া হয়েছে। আক্রান্ত চিকিৎসকদের মধ্যে ৫৩ জন বিভিন্ন বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। অন্যরা বাড়িতে আইসোলেশনে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। চিকিৎসক-নার্সরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন কেন জানতে চাইলে ডা. মো. শাহেদ রাফি পাবেল বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মান নির্দেশিত পিপিই ও এন-৯৫ মাস্ক সঙ্কট। একই সঙ্গে অনেক রোগী করোনার লক্ষণ গোপন করে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। তার সংস্পর্শে এসে চিকিৎসক-নার্সরা আক্রান্ত হচ্ছেন।



 

Show all comments
  • Babul ১৮ এপ্রিল, ২০২০, ১:১২ এএম says : 0
    চিকিৎসক-নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষার ব্যবস্থা দ্রুত করা হোক। তারাই যদি এত আক্রান্ত হয় তাহলে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। কারা চিকিৎসা দিবে করোনা রোগীদের...
    Total Reply(0) Reply
  • মোঃ দেলোয়ার হোসেন ১৮ এপ্রিল, ২০২০, ৬:২৪ এএম says : 0
    সাংবাদিক ভাইদের আহবান করছি সরাসরি নার্স কর্তৃপক্ষের সামনে সমস্যা তুলে ধরেন এবং এ ব্যাপারে তারা কী করছে এবং কবে নাগাত এ সমস্যার সমাধান করতে পারবেন।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: করোনা

২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ