Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সঙ্কট মোকাবেলায় ব্যাংকার্স সভা আজ

দিকনির্দেশনা দিবেন গভর্নর

অর্থনৈতিক রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১৪ জানুয়ারি, ২০২০, ১২:০১ এএম

খেলাপি ঋণ, সুদহার, ঋণপ্রবাহ কমে যাওয়াসহ নানা সংকটে ভুগছে দেশের ব্যাংকিং খাত। এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে নির্ধারিত সময় পার করতে চলেছেন ফজলে কবির। সদ্য একটি বছর শেষ হলেও ব্যাংকিং খাতের সংকট কমেনি, বরং আরও বেড়েছে। এমন অবস্থায় নতুন বছরের প্রথম ব্যাংকার্স সভা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আজ মঙ্গলবার। এতে ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) সঙ্গে আলোচনা করে নতুন দিকনির্দেশনা দেবেন গভর্নর।

সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতি তিন মাস পর পর ব্যাংকার্স সভা অনুষ্ঠিত হয়। এটি নতুন ২০২০ সালের প্রথম সভা। আজ বিকালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জাহাঙ্গীর আলম কনফারেন্স হলে বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। এটি বর্তমান গভর্নর ফজলে কবিরের শেষ সভা। আগামী ১৫ মার্চ তার মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। এ ছাড়া অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ঘোষিত চতুর্থ দফায় নয়-ছয় সুদহার বাস্তবায়নের টাইমলাইন শুরু হবে ১ এপ্রিল থেকে। ব্যাংকিং খাতের নানা সংকটের মধ্যে সিঙ্গল ডিজিট সুদহার বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ বিষয়ে করণীয় নিয়ে আলোচনা হবে।

জানা গেছে, বর্তমানে ব্যাংকভেদে উৎপাদন খাতে সুদহার ১১ থেকে ১৪ শতাংশ। ব্যাংকঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার কৌশল ঠিক করতে গত ১ ডিসেম্বর ডেপুটি গভর্নর এস এম মনিরুজ্জামানকে আহ্বায়ক করে ৭ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিটির সুপারিশের আলোকেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বোর্ড সভায় শিল্প খাতে ৯ শতাংশ সুদহার নির্ধারণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। গভর্নর ফজলে কবির সভায় সভাপত্বি করেন। এদিকে ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ব্যাংক ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিট অর্থাৎ সর্বোচ্চ ৯ কার্যকর করতে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যাবে ব্যাংকগুলো। বিভিন্ন মেয়াদে যাদের কাছ থেকে আমানত নেয়া হয়েছিল তাদের সুদহার কমানো যাবে না। অর্থাৎ চুক্তি অনুযায়ী দিন শেষে তাদের সুদাসলে ফেরত দিতে হবে। কিন্তু নতুন-পুরনো মিলে ১ এপ্রিল থেকেই উৎপাদনমুখী সব শিল্পঋণের সুদহার ৯ অঙ্কের ঘরে নামিয়ে আনতে হবে। এতে আমানতের সুদহার না কমাতে পারলেও ঋণের সুদহার কমে যাওয়ায় যে লোকসানের মুখে পড়বে ব্যাংকগুলো, তা সমন্বয় করা কঠিন হয়ে যাবে। সংশ্লিষ্টরা আরো বলছেন, মুদ্রার চাহিদা ও জোগানের ওপর নির্ভর করে ঋণের সুদহার। বিনিয়োগ চাহিদা বেশি হলেও সে অনুযায়ী টাকার প্রবাহ কম থাকলে ঋণের সুদহার বেড়ে যাবে। আবার টাকার প্রবাহ বেশি থাকলে আর সে অনুযায়ী ঋণের চাহিদা কম থাকলে ঋণের সুদহার এমনিতেই কমে যাবে। দেড় বছর আগে ৯-৬ ঘোষণা করার পর থেকেই আমানতপ্রবাহ কমতে থাকে। অর্থাৎ ব্যাংকগুলো নানাভাবে আমানতের সুদহার কিছুটা কমিয়ে ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু এতে হিতে বিপরীত হয়েছে। আমানতের সুদহার কমে যাওয়ায় সাধারণ আমানতকারীরা টাকা ব্যাংকে না রেখে বেশি মুনাফার জন্য সঞ্চয়পত্রসহ বিভিন্ন খাতে রাখতে থাকে। এতে ব্যাংকিং খাতে আমানতপ্রবাহ কমে যায়। কোনো কোনো ব্যাংকে টাকার সংকট তীব্র হওয়ায় তারা আবার সুদহার বাড়াতে থাকে। অর্থাৎ দুই-একটি ইসলামী ব্যাংক বাদে আর সব বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকই আমানতের সুদহার ৯ শতাংশের উপরে নিয়ে গেছে। কোনো কোনো ব্যাংক আমানতের সুদহার বাড়িয়ে ১০ থেকে ১১ শতাংশে উন্নীত করেছে। এমন পরিস্থিতিতে ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনাকে ব্যাংকগুলোকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যাংকগুলোকে নতুন-পুরনো মিলে উৎপাদনমুখী শিল্প ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে, এটাই বাস্তবতা। কিন্তু নতুন ঋণের ক্ষেত্রে যতটা সমস্যা দেখা না দেবে, তার চেয়ে বেশি সমস্যা দেখা দেবে পুরনো ঋণের সুদহার কমানোর ক্ষেত্রে। কারণ অতীতে যাদেরকে ঋণ বিতরণ করা হয়েছিল, সেটা তো অতীতের আমানতের অর্থ দিয়ে বিতরণ করা হয়েছিল। যেমন ৩ বছর আগে একজন গ্রাহকের কাছ থেকে ১০০ টাকা আমানত সংগ্রহ করা হয়েছিল। ৫ বছর পরে তাকে সুদাসলে ২০০ টাকা ফেরত দিতে হবে। ওই ১০০ টাকার মধ্যে এসএলআর ও সিআরআর সংরক্ষণ করার পর ৮১ টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে বার্ষিক ১২ শতাংশ সুদে। ইতোমধ্যে ৩ বছর অতিবাহিত হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী আর ২ বছর পর আমানতকারীকে সুদে-আসলে ২০০ টাকা ফেরত দিতে হবে। কিন্তু এখন ৩ বছর আগে যাকে ১৩ শতাংশ ঋণ বিতরণ করা হয়েছিল নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী ওই ঋণের সুদহার সরাসরি ৪ শতাংশ কমিয়ে ৯ শতাংশ করতে হবে। অথচ দেখা গেছে, ব্যাংক ১০ শতাংশ সুদে আমানত গ্রহণ করেছিল। এতে শুধু গ্রাহককেই সুদ পরিশোধ করতে হবে ১ শতাংশ লোকসান দিয়ে। আর পরিচালন ব্যয় যোগ করলে আরও ৩ শতাংশ বেড়ে যাবে। অর্থাৎ ঋণগ্রহীতা ৩ শতাংশ কমাতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে সুদহারে ৪ শতাংশ লোকসান দিতে হবে। এটা যদি ১০ হাজার কোটি টাকা হয়, তাহলে ৪ শতাংশ হারে একটি ব্যাংকের সুদহারে লোকসান হবে ৪০০ কোটি টাকা। আর ২ শতাংশ হলে লোকসান হবে ২০০ কোটি টাকা। বর্তমানে প্রায় ১০ লাখ কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে। এর এক-চতুর্থাংশ যদি শিল্পঋণ হয় তাহলে মোট শিল্পঋণের পরিমাণ হবে আড়াই লাখ কোটি টাকা। এ আড়াই লাখ কোটি টাকায় ব্যাংক খাতকে রাতারাতি লোকসান দিতে হবে ৪ শতাংশ হারে ১০ হাজার কোটি টাকা; আর ২ শতাংশ হারে ৫ হাজার কোটি টাকা। এত বড় লোকসানের ধকল সামলানোর সক্ষমতা বর্তমানে ব্যাংক খাতের নেই। তারপরও সরকারের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে ব্যাংকগুলো বাধ্য। তা হলে ভবিষ্যতে ব্যাংকিং খাতের পরিস্থিতি কী হবে তা দেখার জন্য আরো কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক শুধু সুদহার সিঙ্গেল ডিজিট বাস্তবায়নের নির্দেশনা দিলে ব্যাংক খাতের প্রতি সুবিচার করা হবে না। কারণ পুরনো শিল্পঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনলে যে পরিমাণ লোকসান হবে, ব্যাংক খাত ওই লোকসানের ধকল কিভাবে কাটিয়ে উঠবে তার পথও দেখালে ব্যাংকখাতের প্রতি সুবিচার করা হবে। তাও না হলে ব্যাংকগুলোর সমস্যা দেখা দিলে পুরো অর্থনীতিতেই সমস্যা দেখা দেবে। এতে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগসমতা ভেঙে পড়বে। এতে কাঙ্খিত হারে জাতীয় প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হবে না। তা হলে ব্যাংকিং খাতের পরিবর্তিত নাজুক পরিস্থিতি বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারকেই সামলাতে হবে।
নয়-ছয় সুদহারের কারণে ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণ এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন হারে বাড়ছে। সর্বশেষ গত নভেম্বর বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ। প্রতি মাসেই ঋণ বিতরণ কমছে। বেসরকারি খাতের ঋণ কমে গেলে বিনিয়োগ কমে গিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। জানা যায়, নতুন বছরে ব্যাংক খাত হবে সরকারের অন্যতম চ্যালেঞ্জের জায়গা।

উল্লেখ্য, ঋণের সুদহার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ কার্যকরের ঘোষণা দেওয়া হয় ২০১৮ সালের জুলাই থেকে। এর পর তিন দফায় কার্যকরের ঘোষণা দেওয়া হলেও সুদহার কমেনি, বরং বেড়েছে। সর্বশেষ চতুর্থ দফায় আগামী ১ এপ্রিল থেকে কার্যকরের জন্য ঘোষণা দেওয়া হয়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ