Inqilab Logo

শুক্রবার ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পিইডিপি’র ৫৮ কোটি টাকা সাইফুরের পকেটে!

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরে লুটপাট

সাঈদ আহমেদ | প্রকাশের সময় : ১২ জানুয়ারি, ২০২০, ১২:০১ এএম

প্রাইমারি এডুকেশন ডেভলপমেন্ট প্রোগ্রাম (পিইডিপি-৩)র অন্ততঃ ৫৮ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী সাইফুর রহমানের বিরুদ্ধে। ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে কৌশলে তিনি এ অর্থ আত্মসাৎ করেন। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে বিষয়টি বেশ আগেই ‘নিষ্পত্তি’ হয়ে গেছে বলে দাবি করেন সাইফুর রহমান। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম গতকাল শনিবার ইনকিলাবকে বলেন, দুর্নীতির বিষয়ে বর্তমান সরকারের অবস্থান ‘জিরো টলারেন্স’। কেউ যদি দুর্নীতি করেন কিংবা দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়া হয় তাহলে তিনি প্রধান প্রকৌশলী হোন আর যে-ই হোন-তার বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।

স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২০১২ সালে সহকারী প্রকৌশলী ছিলেন জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী মো. সাইফুর রহমান। এ সময় তিনি পিএন্ডসি বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীর (মূল পদ সহকারী প্রকৌশলী) পদ ছেড়ে অধিদফতরের সর্ববৃহৎ প্রকল্প (৪ হাজার কোটি টাকা) ‘প্রাইমারি এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (পিইডিপি-৩)র ফোকাল পার্সনের দায়িত্ব পান। ওই অর্থবছরে অধিদফতরে চলমান সকল প্রকল্পের একীভ‚ত মোট এডিপি ছিল ৪শ’ কোটি টাকা। অথচ ওই বছর পিইডি-৩ প্রকল্পের এডিপি ছিল প্রায় ৮৫০ কোটি টাকা। ৮ বছর ধরে তিনি পিইডিপি-৩ প্রকল্পের ৪ হাজার কোটি টাকার কাজই বাস্তবায়ন করছেন। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে কোটি কোটি টাকা লোপাট হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ঠিকাদারদের কাছ থেকে আদায়কৃত নগদ জরিমানার (লিকুইডেটেড ড্যামেজ)র ৫৮ কোটি টাকা আত্মসাতের বিষয়টি। ‘আন্ডারহ্যান্ড ডিলিং’র মাধ্যমে ঠিকাদারদের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে বিশাল অংকের জরিমানার অর্থ তিনি মওকুফ করে দেন। এর ফলে সরকার কোটি কোটি টাকা থেকে বঞ্চিত হয়। আর্থিকভাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সরকার। যা তার সম্পূর্ণ এখতিয়ার বহিভর্‚ত।

প্রাপ্ত রেকর্ডপত্রে দেখা যায়, বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট প্রকল্প থার্ড প্রাইমারি এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (পিইডিপি-৩)। ঠিকাদারদের মাধ্যমে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়। নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করতে না পারলে মাশুল দিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের বিধান রয়েছে। এ বিধানের আওতায় প্রকল্পটির ঠিকাদাররা কার্যাদেশ বাস্তবায়নের জন্য সময় বৃদ্ধির আবেদন দেন। পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধি অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ে কাজ সম্পাদন করতে না পারলে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারকে একদিন বিলম্বের মাশুল হিসেবে ১% হারে নগদ জরিমানা করার বিধান রয়েছে। এ জরিমানার সিদ্ধান্ত দেয়ার এখতিয়ার স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের। জরিমানাকৃত অর্থ ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে সরকারি কোষাগারে জমা দিয়ে ঠিকাদারগণ কার্য সম্পাদনের মেয়াদ বৃদ্ধির সুবিধা নেন। কিন্তু পিইডিপি-৩ প্রকল্পের ঠিকাদারদের সময়সীমা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী সাইফুর রহমান কোনো বিধি-বিধানের ধার ধারেননি। তিনি নিজেই ঠিকাদারদের জরিমানাকৃত অর্থ বা লিকুইডেটেড ড্যামেজ আদায়ের আদেশ দেন। এ ক্ষেত্রে জরিমানার বিরাট অংশ নিজের পকেটে ঢোকান। ছোট একটি অংক সরকারি কোষাগারে জমা দানের আদেশ দেন।

রেকর্ডপত্রে দেখা যায়, নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে ‘মেসার্স এম.এন. ট্রেড বলারীপাড়া, নাটোর’ প্রকল্পের কাজ শেষ করতে পারেনি। এ কারণে দিনপ্রতি প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে দুই দফায় ৩ কোটি ৩৪ লাখ ৭৬ হাজার ২৪১ টাকা ‘লিকুইডেটেড ড্যামেজ’ বাবদ সরকার পাওয়ার কথা। কিন্তু প্রধান প্রকৌশলী সাইফুর রহমান ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে ২ দফায় ৯ হাজার ৭৫২ টাকা এবং ১৩ হাজার ৫০৩ টাকা আদায় করেন। বাকি অর্থ তিনি ব্যক্তিগতভাবে আত্মসাৎ করেন। অথচ অর্থ মন্ত্রণালয়ের ‘আর্থিক ক্ষমতা অর্পণ’র নির্দেশনা (৬,৭) অনুযায়ী তার এই এখতিয়ার নেই। ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে তিনি ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হন। আর্থিক ক্ষতি হয় সরকারের।

রেকর্ডপত্রে আরো দেখা যায়, একই প্রকল্পাধীন ‘কন্সট্রাকশন অব ওয়াটার সোর্স’ কাজে (টেন্ডার আইডি নং-২৩৪৮৪) ঠিকাদার মো. সাইদুল ইসলাম ৬৩ লাখ ৮৪ হাজার ২৮৯ টাকার একটি কাজ শেষ করতে ১৫৯ দিন দেরি করেন। কিন্তু জনস্বাস্থ্যের তৎকালীন সুপারিনটেনডিং ইঞ্জিনিয়ার সাইফুর রহমান (বর্তমানে প্রধান প্রকৌশলী) ১৪ দিনের বিলম্ব অনুমোদন করে ১৪৫ দিনের জরিমানার অর্থ নিজেই আত্মসাৎ করেন। সরকার বঞ্চিত হয়।
একইভাবে সিরাজগঞ্জের ‘মীম কনস্ট্রাকশন’ ৭৩ লাখ ২২ হাজার ১৬৩ টাকার কার্যাদেশ পায়। চুক্তি অনুযায়ী ২০১৭ সালের ২৭ জুন কাজ সম্পন্ন করার কথা। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে না পারায় তাকে ১ শতাংশ হারে জরিমানা করার কথা। প্রতিষ্ঠানটি এ প্রেক্ষাপটে ৬০ দিন সময় বৃদ্ধির আবেদন দেয়। মো. সাইফুর রহমান ৭ দিন সময় বৃদ্ধির অনুমোদন দিয়ে মাত্র ৫ হাজার ১২৫ টাকা জরিমানা নিয়ে আবেদন নিষ্পত্তি করেন। নিজ এখতিয়ার বহিভর্‚তভাবে ৫৩ দিনের জরিমানা মওকুফ করেন। এ অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা পড়েনি।

সিরাজগঞ্জ ‘মেসার্স আফরা সাদেকা’ ৭৬ লাখ ১১ হাজার ৬৬৩ টাকার একটি কার্যাদেশ (টেন্ডার আইডি নং-৮১৩৭৭) পায়। ৪ মাস মেয়াদী এই কাজ ২০১৭ সালের ২৭ জুন সম্পন্ন হওয়ার কথা। অতিরিক্ত চার মাসেও প্রতিষ্ঠানটি কাজ শেষ করতে পারেনি। এ প্রেক্ষাপটে ৪ মাস (১২০ দিন) সময়সীমা বাড়ানোর আবেদন জানানো হয়। সাইফুর রহমান মাত্র ৫১৩৯ টাকা জরিমানা নিয়ে বাকি দিনগুলো মওকুফ করে দেন। ৬৫ লাখ ৬৮ হাজার ৮৭৯ টাকার একটি কার্যাদেশ (টেন্ডার আইডি নং-২৪২৪২) সম্পাদনে ১৭১ দিন বিলম্ব হয়। সাইফুর রহমান ১৫ দিনের জরিমানা আদায় করে ১৫৬ দিন মাফ করে দেন। এতে সরকার ওই ঠিকাদারের কাছ থেকে ১৫৬ দিনের জরিমানার অর্থ থেকে বঞ্চিত হয়। ৬৫ লাখ ৬০ হাজার টাকার কার্যাদেশের (টেন্ডার আইডি নম্বর ২৪০৯০) কাজটি নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে ৭৫ শতাংশ সম্পাদন করতেই ১৪৩ দিন বিলম্বিত হয়। ঠিকাদার আব্দুস সোবহান এবং আলমগীর জাহান কার্য সম্পাদনের জন্য সময় বাড়ানোর আবেদন করেন। সাইফুর রহমান শুধু ১৫ হাজার টাকা আদায় করে বাকি দিনগুলোর জরিমানা এক স্বাক্ষরে মওকুফ করে দেন। বাকি টাকা কোষাগারে জমা হয়নি। এভাবে শতাধিক ঠিকাদারের লিকুইডেটেড ড্যামেজের ৫৮ কোটি টাকা তিনি হাতিয়ে নেন। এভাবে বিভিন্ন ঠিকাদারের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন। সরকারকে আর্থিক ক্ষতির মধ্যে ফেলেন।

এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক মহাপরিচালক (লিগ্যাল) মো. মইদুল ইসলাম বলেন, এখতিয়ার বহিভর্‚তভাবে সরকারি অর্থ মওকুফ করা হলে এটি হচ্ছে ক্ষমতার অপব্যবহার। ১৯৪৭ সালের ২ নং দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় এটি দন্ডনীয় অপরাধ। অপরাধ প্রমাণিত হলে এ ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি ৭ বছর। সরকারি অর্থ কোষাগারে জমা না হলে সেটি আত্মসাৎ হিসেবেই পরিগণিত। ফৌজদারি দন্ডবিধির ৪০৯ ধারায় দুদক এ বিষয়ে মামলা করতে পারে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে যাবজ্জীবন কারাদন্ডের বিধান রয়েছে।



 

Show all comments
  • Aiyub Rahman ১২ জানুয়ারি, ২০২০, ৩:০৮ এএম says : 0
    দশজন বড় পদের সৎ সরকারি চাকরি জিবীর নাম বলেন তো! বেশীর ভাগই চোর!
    Total Reply(0) Reply
  • তোফাজ্জল হোসেন ১২ জানুয়ারি, ২০২০, ৩:০৯ এএম says : 0
    যে যার মতো লুটে পুটে খাচ্ছে না।
    Total Reply(0) Reply
  • কাজী হাফিজ ১২ জানুয়ারি, ২০২০, ৩:০৯ এএম says : 0
    সত্যি হলে তো এই হালায় বড় বাটপার।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ