Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী ব্যাংকিং-এর অগ্রগতি ও জনপ্রিয়তা

মো. মাঈন উদ্দীন | প্রকাশের সময় : ১ জানুয়ারি, ২০২০, ১২:০২ এএম

ইসলামী ব্যাংকিং বিষয়ে মানুষ একসময় কল্পনা করতো যা বর্তমানে বাস্তবতা। বর্তমান বিশ্বে এই ব্যবস্থা নতুন ধারায় সর্বাধিুনিক ব্যাংকিং সেবা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। বিশ শতকের কতিপয় বিখ্যাত ইসলামী মনীষি ও অর্থনীতিবিদদের দীর্ঘ গবেষণার মধ্য দিয়ে ইসলামী ব্যাংকিং বাস্তবতা লাভ করেছে। ষাটের দশকে মিসরে ইসলামী ব্যাংকিং-এর যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, তা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ক্রমান্বয়ে মজবুত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। ১৯৬১ সালে মিশরে ইসলামী গবেষণার সর্বোচ্চ কেন্দ্র হিসেবে ‘কলেজ অব ইসলামিক রিসার্চ’ কায়েম করা হয়। ১৯৬৪ সালের ৭ মার্চ এ কলেজের প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ৪০টিরও বেশী মুসলিম দেশের শতাধিক নেতৃস্থানীয় ইসলামীবিশেষজ্ঞ যোগদান করেন। তাঁরা সুদভিত্তিক প্রচলিত ব্যাংক ব্যবস্থার বিকল্পরূপে ইসলামী ব্যাংকিং পদ্ধতি গড়ে তোলার উপায় নির্ণয়ে আলোচনা করেন। ১৯৬২ সালে মায়েশিায় কিস্তিতে হজ্বের অর্থ জমাগ্রহণের উদ্দেশ্যে ‘পিল গ্রিমস্ সেভিংস কর্পোরেশন’ নামে সুদমুক্ত একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর পর ১৯৬৩ সালে ডক্টর আহমদ আল-নাজ্জারের উদ্যোগে মিসরের কায়রো থেকে একশ’ কিলোমিটার দূরে মিট গামার নামক এক গ্রামে আধুনিক বিশ্বের প্রথম সুদমুক্ত ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয। সত্তরের দশকে মুসলিম দুনিয়ায় আন্তর্জাতিক সংগঠন ‘ইসলাম সম্মেলন সংস্থা’ শরিয়াহ্ ভিত্তিক ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিলে ইসলামী ব্যাংকিং-এর সূর্যোদয় ঘটে। ১৯৭৪ সালের ওআইসির’র সম্মেলনে জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে উপস্থিত থেকে ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রবর্তনের সিদ্ধান্তে ঐক্যমত পোষণ করেন।


ইসলামী ব্যাংক ব্যবস্থা ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক রূপ লাভে সক্ষম হয়েছে। ফলে দেশে-দেশে ইসলামী তথা সুদবিহীন ব্যাংকের প্রসার বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইরান, পাকিস্তান ও সুদানের সামগ্রিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা ইসলামীকরণসহ সারাবিশ্বে বিশ শতকের শেষ নাগাদ তিনশ’র বেশী ইসলামী ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শুধু তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোতেই নয়, অনেক স্বপ্লোন্নত দেশেও ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মুসলিম বিশ্বের বাইরেও ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। লুক্সেমবার্গ, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ডেনমার্কসহ বিশ্বের পঞ্চাশটির বেশী দেশে ইসলামী ব্যাংক তাদের সফল কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবসায়ে ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার কারণে বহু সুদিভিত্তিক আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানও ইতমধ্যে ইসলামী ব্যাংকিং পদ্ধতির দিকে ঝুঁকছে। পাশ্চাত্যে ইসলামী ব্যাংকিং পদ্ধতির গুরুত্ব দিনদিন বেড়ে চলছে এবং তা প্রশংসা পাচ্ছে। ইসলামী শরীয়াহ্ পরিপালন হলো এ পদ্ধতির মূলভিত্তি। পাশ্চাত্যর দেশগুলোতেও এ মূলভিত্তি ঠিক রেখে তাদের ব্যাংকিং কার্যক্রম চলাচ্ছে।

ইসলামী ব্যাংকিং এর মুখপাত্র ‘গেøাবাল ইসলামিক ফিন্যানসিয়াল রিভিউ’ কর্তৃক পরিবেশিত তথ্য উপাত্ত থেকে দেখা যায়, বিগত ৩০ বছর আগে প্রায় শূন্য থেকে শুরু করে ইসলামী ফিন্যানসিয়াল খাত এখন ১ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন ডলারেরও অধিক সম্পদ সৃষ্টি করেছে। পাশ্চত্যের ব্যাংকিং জগতে সাম্প্রতিককালে সৃষ্ট সংকট সমাধানে ইসলামী ব্যাংকিং পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে। পাশ্চাত্যের ব্যাংকিং ব্যবস্থার (নন ইসলামীক) ব্যাংকগুলোর প্রবৃদ্ধি যেখানে ১০ শতাংশের নিচে নেমে যায়, সেখানে ইসলামী ব্যাংকিং ২০১২ সালে ২০ শতাংশের উপরে প্রবৃদ্ধি লাভ করে। আফ্রিকার একাধিক অমুসলিম রাষ্ট্র তাদের প্রকল্পগুলোতে বিনিয়োগের জন্য ইসলামী আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে ‘সুকুক’ নামে সুদমুক্ত এক প্রক্রিয়া যুক্ত করেছে। ‘সুকুক’ অনেকটা বন্ডের মতো। এটি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সুদ থেকে মুক্ত। ‘সুকুক’ প্রচিলিত শেয়ার ও বন্ডের মতো বিনিয়োগকারীকে একটি নির্দিষ্ট হারে মুনাফা দেয়। কিন্তু শেয়ার ও বন্ড ব্যবস্থায় যে বিপুল পরিমাণ তরল পুঁজি রাখা হয় ‘সুকুক’ ব্যবস্থায় সেভাবে রাখা যায় না। ‘সুকুক’ সম্পূর্ণ বিনিয়োগযোগ্য পূঁজিকে ভূ-সম্পত্তি ও অন্যান্য হাউজিং এস্টেট ক্রয়ে বিনিয়োগ করে থাকে। যা নিয়মিত উপার্জন সৃষ্টি করে। ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র যখন গভীর অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছিল এবং অনেক ব্যাংক ও হাউজিং মর্টগেজ অর্থ-লগ্নি প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়ে যায়, তখন পাশ্চাত্যের ব্যাংকিং মহলে ইসলামী ‘সুকুক’ প্রক্রিয়ার মূল্যায়ন করা হয় এবং সুকুক-এ পাশ্চাত্যের আগ্রহ বাড়তে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক ব্যাংক ‘সুকুককে’ নিরাপদ অর্থলগ্নি ব্যবস্থা বলে গ্রহণ করেছে।

বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং বহুমাত্রিক দীর্ঘ প্রচেষ্টার ফসলরূপে ১৯৮৩ সালের ৩০ মার্চ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রথম সুদমুক্ত ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৯ জন বাংলাদেশী ব্যক্তিত্ব ৪টি প্রতিষ্ঠান, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের ১১টি ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ২ জন বিদেশী ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশ ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগে এগিয়ে আসেন। বর্তমানে এ ব্যাংকে ১৪ হাজার সৎ, দক্ষ ও নিবেদিত প্রাণ জনশক্তি রয়েছে। বর্তমানে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী মোঃ মাহবুব-উল-আলমসহ একদল সুদক্ষ, অভিজ্ঞ, নিষ্ঠাবান পরিচালনা পর্ষদ রয়েছে। রয়েছে শরীআহ্ সুপারভাইজারি কমিটি। বর্তমানে এ ব্যাংকের আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়ছে প্রায় ৮৭ হাজার কোটি টাকারও বেশী। দ্য ব্যাংকার কর্তৃক বিশ্বের সেরা ১০০০ ব্যাংকের তালিকায় বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড-এর স্থান ৯৪৩তম। এই ব্যাংক পেয়েছে বিশ্বসেরা ইসলামী ব্যাংক সিবাফি অ্যাওয়ার্ড ২০১৯ ও সর্বোচ্চ বৈদেশিক রেমিট্যান্স আহরণে এনআরবি কর্তৃক গোল্ড রেমিটেন্স অ্যাওয়ার্ড ২০১৯। প্রায় সোয়া কোটি গ্রাহক নিয়ে শরীআহ্ নির্দেশিত ব্যবস্থায় সম্পদের সুষম বন্টরের মাধ্যমে মানুষের আর্থ সামাজিক উন্নয়নে এ ব্যাংক কাজ করে চলেছে। এ ব্যাংকের সফল অগ্রযাত্রার পথ ধরে পরবর্তীতে এদেশে আরও কয়েকটি ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানের বাংলাদেশে ৮টি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংক রয়েছে। এছাড়া ৯টি প্রচলিত ধারার ব্যাংকের ১৯টি ইসলামী ব্যাংকিং শাখা, ৮টি কনভেনশনাল ব্যাংকের ২৫টি ইসলামী ব্যাংকিং উইন্ডো রয়েছে। এসব উইন্ডোর মোট আমানতের পরিমাণ ২ লাখ ৫৩ হাজার ৫৮কোটি টাকা যা দেশের মোট ব্যাংক আমানতের ২৩.৭৭ শতাংশ। সফলভাবে ইসলামী ব্যাংকিং বাস্তবায়নের পদক্ষেপ হিসাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় ইসলামী ব্যাংকগুলো সম্মিলিতভাবে ২০০১ সালের ১৬ আগস্ট প্রতিষ্ঠা করে ‘সেন্ট্রাল শরীয়াহ্ বোর্ড ফর ইসলামীক ব্যাংকস্ অব বাংলাদেশ’।

আমদানী-রফতানি বাণিজ্য নতুন উদ্যোক্তাশ্রেণী সৃষ্টি, পরিবেশ বান্ধব ও টেকসই বিনিয়োগে ইসলামী ব্যাংকগুলো জনমানুষের আস্থা অর্জন করে চলেছে। শরীয়াহ্ ভিত্তিক ব্যাংক হওয়ায় খেলাপী ঋণের পরিমাণও ইসলামী ব্যাংকগুলোতে তুলনামূলক কম। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক-এর এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৯ জুন পর্যন্ত দেশের ব্যাংক খাতে ১ হাজার ২৬১টি ইসলামী ব্যাংকিং শাখা আছে। ২০১৮ সালে ছিল ১ হাজার ১৭৮টি। দেশের ইসলামী ব্যাংকগুলোতে কাজ করছে মোট ৩৫ হাজার ৩৪১ জন জনশক্তি।

প্রবাসীদের কাছেও ইসলামী ব্যাংকিং অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছে উঠেছে। ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত ৯ হাজার ৭১২ কোটি টাকার রেমিট্যান্স এসেছে ইসলামী ব্যাংকিং-এর মাধ্যমে। মোট ব্যাংকিং খাতের প্রবাসী আয়ের ৭৭.২৬ শতাংশ আসে ইসলামী ব্যাংক-এর মাধ্যমে। শরীয়াহ্ ব্যাংকিংয়ের মোট আমানতের পরিমাণ ২ লাখ ৫৩ হাজার ৫৮ কোটি টাকা। বিনিয়োগ হয়েছে ২ লাখ ৪৫ হাজার ১৮৮ কোটি টাকা।

দেশের ৯০ ভাগ গ্রাহক মুসলমানসহ অমুসলিম গ্রাহকদের কাছেও ইসলামী ব্যাংকের জনপ্রিয়তা দিন দিন বেড়ে চলেছে। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বে ইসলামী ব্যাংক ব্যবস্থা দ্রুত গতিতে অগ্রসর হচ্ছে এবং জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। বহু দেশের উন্নয়ন কার্যক্রমে এ ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ অবধান রাখতে সক্ষম হচ্ছে এবং দেশে দেশে ব্যাপক গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছে।

লেখক: সাবেক কলেজ শিক্ষক, গবেষক, অর্থনীতিবিদ।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ