Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বিএডিসিতে অযোগ্যদের পিডি নিয়োগ

ডিপিপি লঙ্ঘন

অর্থনৈতিক রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১০ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) শত শত কোটি টাকার প্রকল্পে পিডি নিয়োগে চলছে তুঘলকি কান্ড। উন্নয়ন প্রকল্পের প্রস্তাব (ডিপিপি) লঙ্ঘন করে কনিষ্ঠ এবং দুর্নীতিপরায়ণ ও বিতর্কিত কর্মকর্তাদের পিডি নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। চলতি অর্থবছরে পাস হওয়া পাঁচটি প্রকল্পের মধ্যে ইতোমধ্যে চারটিতে অযোগ্য কর্মকর্তাদের পিডি নিয়োগ দেয়া হয়েছে। একটি সিন্ডিকেট কৃষিমন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে অর্থের বিনিময়ে এই অবৈধ কারসাজি করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় বঞ্চিতসহ সংস্থাটির কর্মকর্তাদের মধ্যে চরম অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। 

কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্তি সচিব আরিফুর রহমান অপু বলেন, পিডি নিয়োগে ডিপিপির ব্যত্যয় ঘটানো হয় না। তবে ডিপিপির বাইরে যাওয়া যাবে না এমনও নয়। তবে এ ক্ষেত্রে যৌক্তিক কারণ থাকতে হবে এবং এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের অনুমতি নিতে হবে। একই সঙ্গে পিডি নিয়োগের বিষয়টি এখনো সঠিকভাবে তিনি জানেন না। তবে অভিযোগ এলে খতিয়ে দেখা হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
কৃষি মন্ত্রণালয় ও বিএডিসি সূত্রে জানা গেছে, গত অক্টোবরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় বিএডিসির ক্ষুদ্র সেচ, বীজআলু ও সারগুদামের ৫টি প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়। প্রকল্পগুলো হচ্ছে ৬৮৮ কোটি ২১ লাখ টাকা ব্যয়ে মানসম্পন্ন বীজআলু উৎপাদন ও সংরক্ষণ এবং কৃষক পর্যায়ে বিতরণ জোরদারকরণ প্রকল্প, ৩১১ কোটি টাকা ব্যয়ে বিএডিসির বিদ্যমান সারগুদামসমূহের রক্ষণাবেক্ষণ, পুনর্বাসন ও নতুন গুদাম নির্মাণের মাধ্যমে সার ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম জোরদারকরণ প্রকল্প (২য় পর্যায়), ৩২৫ কোটি ৫৩ লাখ টাকা ব্যয়ে কুমিল্লা-চাঁদপুর- ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সেচ এলাকা উন্নয়ন প্রকল্প, ২শ’ কোটি ৫৯ লাখ টাকা ব্যয়ে বৃহত্তর ফরিদপুর সেচ এলাকা উন্নয়ন প্রকল্প (২য় পর্যায়) এবং ৫৬০ কোটি ৫৩ লাখ টাকা ব্যয়ে পাবনা-নাটোর-সিরাজগঞ্জ জেলায় ভূ-উপরিস্থ পানির মাধ্যমে সেচ উন্নয়ন প্রকল্প। এসব প্রকল্পে প্রকল্প পরিচালক (পিডি) নিয়োগের জন্য নভেম্বরের শেষ দিকে বিএডিসি থেকে প্রত্যেক প্রকল্পে ৩ জন করে ১৫ জন কর্মকর্তার নাম প্রস্তাব পাঠানো হয় কৃষি মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু প্রত্যেক প্রস্তাবেই ডিপিপি লংঘন করে অযোগ্য ও অদক্ষ এবং কনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের নাম এক নম্বরে দেয়া হয়। এর মধ্যে চারটি প্রকল্পে গত ৪ ডিসেম্বর মন্ত্রণালয় থেকে পিডি নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
সূত্র মতে, পাবনা-নাটোর-সিরাজগঞ্জ জেলায় ভূ-উপরিস্থ পানির মাধ্যমে সেচ উন্নয়ন প্রকল্পের পিডি হিসেবে সংস্থাটির নির্বাহী প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসেন ভূঁইয়া, সাজ্জাদ হোসেন ও মাজেদুল আলমের নাম প্রস্তাব পাঠানো হয় মন্ত্রণালয়ে। এ প্রকল্পে ডিপিপি লংঘন করা হয়েছে। ডিপিপি অনুযায়ী এই প্রকল্পে বিএডিসির তত্ত¡াবধায়ক প্রকৌশলীকে পিডি হিসেবে নিয়োগ দেয়ার কথা। সংস্থাটির সেচ বিভাগে প্রয়োজনীয় সংখ্যক তত্ত¡াবধায়ক প্রকৌশলী থাকার পরও পিডি হিসেবে নির্বাহী প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসেনকে পিডি নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
কুমিল্লা-চাঁদপুর-ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সেচ এলাকা উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক হিসেবেও নাম প্রস্তাব করা হয়েছে অপেক্ষাকৃত কনিষ্ঠ প্রকৌশলীদের। তারা হচ্ছেন নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান, নজরুল ইসলাম ও আহসান উদ্দিন। মিজানের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। ইকিউএসএস প্রকল্পে স্পেশালিস্ট থাকাকালে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন তিনি। হাতিয়ে নেন কয়েক কোটি টাকা। এ বিষয়ে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। অর্থ কেলেঙ্কারির অভিযোগ থাকার পরও মিজানুরকে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের পিডি নিয়োগ দেয়ায় বিস্মিত বিএডসির কর্মকর্তারা।
বৃহত্তর ফরিদপুর সেচ এলাকা উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য পিডি নিয়োগেও নিয়মকানুন মানা হয়নি। কনিষ্ঠ কর্মকর্তা নির্বাহী প্রকৌশলী মনিরুল ইসলামকে পিডি নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ডিপিপি লংঘন করে নির্বাহী প্রকৌশলী মনিরুল ইসলাম, ওয়াহেদুল ইসলাম এবং কাউসার আহমেদ মুন্সীর নাম প্রস্তাব পাঠানো হয় মন্ত্রণালয়ে। এই বিভাগেও একাধিক তত্ত¡াবধায়ক প্রকৌশলী রয়েছেন। যোগ্যদের বাদ দিয়ে কনিষ্ঠ কর্মকর্তাকে পিডি নিয়োগ দেয়া হয়। তার বিরুদ্ধে রয়েছে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ।
সারগুদামসমূহের রক্ষণাবেক্ষণ, পুনর্বাসন ও নতুন গুদাম নির্মাণের মাধ্যমে সার ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম জোরদারকরণ প্রকল্পে পিডি নিয়োগের জন্য যুগ্ম পরিচালক মোজাম্মেল হক, আবু রায়হান মো. তারেক ও আব্দুল মালেকের নাম প্রস্তাব পাঠানো হয়। ডিপিপি অনুযায়ী প্রস্তাব পাঠানো হলেও জাতীয় পার্টির সমর্থক মোজাম্মেল হককে ৪ ডিসেম্বর পিডি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
তবে এখনো মানসম্পন্ন বীজআলু উৎপাদন ও সংরক্ষণ এবং কৃষক পর্যায়ে বিতরণ জোরদারকরণ প্রকল্পে পিডি নিয়োগ দেয়া হয়নি। ডিপিপি অনুযায়ী একজন অতিরিক্ত মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) পদমর্যাদার কর্মকর্তা এই প্রকল্পের পিডি হওয়ার কথা। কিন্তু কনিষ্ঠ পদ যুগ্ম পরিচালক আবির হোসেন, গোলাম কিবরিয়া ও নরেশ চন্দ্র পালের নাম প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। অথচ বীজআলু প্রকল্পের জন্য উপযোগী সিনিয়র পদ এজিএম হিসেবে ৫ জন কর্মকর্তা রয়েছেন। আবির হোসেনকে পিডি নিয়োগ করতে যোগ্য-দক্ষ ও সিনিয়র কর্মকর্তাদের বাদ দিয়ে তার নাম এক নম্বরে প্রস্তাব পাঠানো হয়। আবিরের বিরুদ্ধে অদক্ষতা, ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি ও নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগ রয়েছে। এই পদে আসার আগে টাঙ্গাইলের মধুপুর বিএডিসি খামারে যুগ্ম পরিচালক থাকাকালে অনিয়ম-দুর্নীতি ও নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগে আবিরকে প্রত্যাহার করা হয়। এর আগে চাকরিজীবনের শুরুতে চাঁদপুরে কর্মরত থাকাকালে চুক্তিবদ্ধ চাষিদের কাছ থেকে উৎকোচ নেয়া এবং হিমাগারের আলু পচিয়ে ফেলার অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত করা হয় তাকে। পরে দত্তনগর খামারে উপ-পরিচালক হিসেবে কর্মরত অবস্থায় বিশাল অংকের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে অপসারিত হন তিনি। এরপর তাকে মধুপুর খামারে নিয়োগ দেয়া হয়। এখন তাকেই সংবেদনশীল বীজআলু প্রকল্পের পিডি নিয়োগ দিতে একটি সিন্ডিকেট পাঁয়তারা চালাচ্ছে।
বিএডিসির কর্মকর্তাদের অভিযোগ, কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাকের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচয় দিয়ে বাইরের তিন-চারজন ব্যক্তি বিএডিসিতে প্রভাব বিস্তার করছে। এরা সারাক্ষণ সংস্থাটিতে পড়ে থাকেন। এদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে সংস্থাটির কিছু সুবিধাবাদী কর্মকর্তা। মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে এই চক্রের পছন্দেই অদক্ষ-অযোগ্য এবং দুর্নীতিতে অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের এই প্রকল্পগুলোতে পিডি নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এই চক্রটি শুধু পিডি নিয়োগ নয়, বদলি, পদোন্নতি এবং ঠিকাদারি কাজেও প্রভাব খাটাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তাদের প্রভাবে কর্তৃপক্ষও অসহায় হয়ে পড়েছে বলে সংস্থাটির কর্মকর্তাদের অভিমত।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ