পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
কঞ্চির মতো সরু বাহু। হাতের কব্জিতে নিকেল করা দু’জোড়া চুড়ি। নাকের দুটি বাঁশি গলে সর্দি ঝরছে অনর্গল। ওপরের ঠোঁটের নিচটুকুন লালচে হয়ে গেছে সর্দি মুছতে মুছতে। ওর করুণ চাহনি পেশাদার যেকোনো ফটোগ্রাফারের জন্য অসাধারণ টপিক হতে পারত। কিন্তু না। মোহাম্মদপুর বিহারি ক্যাম্পের উপেক্ষিত এক পরিবারের সন্তান নূরজাহানের ফ্যাল ফ্যাল চাহনিটা ওই মুহূর্তে কারো চোখেই পড়েনি। সমর্থ পরিবারের মেয়ে হলে হয়তো ৬ বছরের নূরজাহানের গলায় ঝুলত সোনা-রুপার মাদুলি। সেই স্থানটি দখলে নিয়েছে কালো সুতায় বাঁধা একগোছা তাবিজ। মাঝ রাতে ভয়ে লাফিয়ে ওঠে। বুকে ধড়ফড় । একা একা কথা বলতে থাকে ঘুমের ঘোরে। ঝার-ফুঁক দিয়ে ক্যাম্পেরই এক কবিরাজ ঝুলিয়ে দিয়েছেন মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পের অপুষ্টির শিকার শিশু নূরজাহানের গলে। মৌলিক চাহিদার একটি স্বাস্থ্যসেবা। কিন্তু জেনেভা ক্যাম্পের ‘স্বাস্থ্যসেবা’ এখনো কবিরাজ-নির্ভরতা কাটেনি। কঠিন কোনো অসুখ হলেও বড়জোর ছুটতে হয় ‘মেরিস্টোপস’র এনজিও হাসপাতালে। আর্থিক টানাপড়েনের কারণে সংলগ্ন বেসরকারি হাসপাতালে ‘ভালো ডাক্তার’ দেখানোর সাধ্য নেই উর্দুভাষী এই জনগোষ্ঠীর।
৮ বর্গফুটের খুপড়িতে বন্দি প্রজন্মের স্বপ্ন
শুধু স্বাস্থ্যসেবা কেন? অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও নিরাপত্তার মতো সাধারণ অধিকারগুলোই এখানে সুদূর পরাহত। ‘আটকেপড়া পাকিস্তানি’ পরিচয়ে বেড়ে ওঠা উর্দুভাষীদের ক্যাম্প-জীবন নানা সঙ্কটে ওষ্ঠাগত। ঘরে ঘরে ‘খানাওয়ালা’ বাড়ছে। দৈর্ঘ্য-প্রস্থে ৮ ফুটের খুপড়ি ঘর। একটি কক্ষে বসবাস করতে হচ্ছে ৮/১০ জনকে। পরিবারের নারী-পুরুষ সদস্যের একসঙ্গে গাদাগাদি বাস। ‘টাউন হল ক্যাম্প’-এর তরুণ মোহাম্মদ নাদিম বলেন, বিয়ের বয়স পেরিয়ে গেলেও বিয়ে থা করতে পারছি না। স্ত্রীকে রাখব কোথায়? পাঁচ ভাই-বোন এক রুমে থাকতে এমনিতেই কষ্ট হচ্ছে।
এদিকে বোনও একটা বিয়ের উপযোগী। জামাই বাবু এলে তাকেই বা কোথায় থাকতে দেবো? টেনশনে আছি। নাদিমের মতো অভিন্ন সমস্যা সাজিদ এবং জসিমেরও। একজনের শরীরকে বালিশ বানিয়ে আরেকজন ঘুমান। স্থান সংকুলান না হওয়ায় অনেকে ছাদের ওপর ও বাড়ির সামনের খোলা জায়গায় থাকছেন। ছোট একটি ঘরে মা-বাবা, ছেলে-পুত্রবধূ ও সন্তান নিয়ে থাকায় পরিবারগুলোয় গোপনীয়তা বজায় থাকে না। একই সঙ্গে ছোট ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া বিঘিœত হচ্ছে। ক্যাম্পের গলিগুলোয় হাঁটার জায়গা অপরিসর। ময়লা-আবর্জনায় দুর্গন্ধযুক্ত পরিবেশ।
উর্দুভাষী বিহারি ক্যাম্পগুলোতে স্বাস্থ্যসেবা নেই বললেই চলে। অপরিষ্কার স্থানে বেশির ভাগ মানুষ গাদাগাদি করে থাকায় বাসিন্দারা সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। বাসিন্দাদের জন্য সরকারি উদ্যোগে কয়েকটি নলকূপ বসানো হলেও ওয়াসার পানি পানে পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন তারা। বিশাল এ জনগোষ্ঠীর জন্য রয়েছে বেসরকারি উদ্যোগে পরিচালিত ‘মেরী স্টোপস ক্লিনিক’।
একাত্তরের যুদ্ধের পর ক্যাম্পের তিন পাশে নারী ও পুরুষের জন্য আলাদা ২শ’ টয়লেট নির্মাণ করা হয়। যেখানে একই সঙ্গে গোসলও সারেন তারা। অপরিষ্কার এ টয়লেটগুলো ক্যাম্পের বাসিন্দাদের তুলনায় সীমিত। ফলে সকাল-সন্ধ্যা দৈনন্দিন জরুরি কাজ সারতে টয়লেটের সামনে দীর্ঘ লাইন ধরতে হয়। ঘরে স্থান সংকুলান না হওয়ার কষ্ট বিহারি ক্যাম্পের প্রতিটি পরিবারে। বাধ্য হয়ে ৮ বর্গফুটের খুপড়ি ঘরের ওপর একতলা, দোতলা, তিনতলা ছাদ করা হয়েছে। এসব ঘরের না আছে অনুমোদন, না আছে প্ল্যান। অপরিকল্পিত ঝুপড়িতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম বাস করছেন ৫টি ক্যাম্পের উর্দুভাষীরা। ঝড়-ঝঞ্ঝা, দৈব-দুর্বিপাকে এ যাবত বেশ কিছু প্রাণ সংহারের ঘটনাও ঘটেছে। ঝড়ের পর বৈদ্যুতিক তারে জড়িয়ে মারা গেছে শিশু। যে কোনো মুহূর্তে বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কায় থাকেন ঘরগুলোতে বসবাসকারীরা।
ঠিকানা দেখলেই আটকে দেয়া হয় পাসপোর্ট
ক্যাম্পের শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষা গ্রহণের বৈষম্যের শিকার। তাই চাকরির বাজারে পিছিয়ে পড়েছেন তারা। ক্যাম্পের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আজাদ সুমন জানান, এলাকার বাসিন্দাদের ভোটার করা হলেও জাতীয় পরিচয়পত্রে জেনেভা ক্যাম্পের ঠিকানা উল্লেখ থাকে। এ কারণে তদের পাসপোর্ট আটকে দেয়া হয়। জেনেভা ক্যাম্পের বাসিন্দাদের নানা বঞ্চনা ও অধিকারের কথা বলতে ইতোমধ্যে সারাদেশে অন্তত ১০টি সংগঠন প্রতিষ্ঠা হয়েছে। তাদের রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন এজেন্ডা। পুরনো এবং সবচেয়ে বড় সংগঠনের নাম ‘স্ট্রান্ডেড পাকিস্তানিজ জেনারেল রিপ্যাট্রিয়েশন কমিটি’ (এসপিজিআরসি) নামক একটি সংগঠন। এ সংগঠনের নেতৃত্বে রয়েছেন ঢাকার জব্বার খান এবং রংপুরের নাছিম খানের ছেলে হারুন খান। তবে এই সংগঠনের বিরুদ্ধে মূল দাবি থেকে পিছিয়ে গিয়ে স্বার্থান্বেষী মহলের স্বার্থে কথা বলার অভিযোগ রয়েছে। ১৯৭৮ সালে বিশেষ একটি গোয়েন্দা সংস্থার সহযোগিতায় এ সংগঠনটি জন্ম নেয় বলেও রয়েছে অভিযোগ।
৩২ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মো. শাকিল জানান, হাবিবুর রহমান ওরফে পাগলা মিজান ওয়ার্ডটির কাউন্সিলর। ভোটের আগে তিনি ক্যাম্পে একাধিকার এসেছেন ভোট চাইতে। ‘হ্যান করেঙ্গা ত্যান করেঙ্গা’ বলে অনেক প্রতিশ্রæতি দিয়েছেন। পাস করার পর আর খোঁজ নেননি। এখন তো তিনি জেলে। তিনি বলেন, ভোট এলেই আমাদের কদর বেড়ে যায়। পুনর্বাসনের কথা বলা হয়। পরে পাত্তাও মেলে না। ২০০৩ সাল পর্যন্ত আমাদের রেশন ছিল। ৩ কেজি ৩ ছটাক গম, দুম্বার গোশত, খেজুর পেতাম। এখন সেটি বন্ধ। বলা হচ্ছে, তোমরা এখন আর রিফিউজি নও। অথচ আমাদের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। একটি ভোটার আইডি কার্ড ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। কোনো অধিকার দেয়া হয়নি। নামেই আমরা উর্দুভাষী বাংলাদেশি।
দুঃস্বপ্নে রাত হয় ভোর
‘মহাজির ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশেন’-এর (বিএমডবিøউএ)’র কার্যালয়ে বসে নাম প্রকাশ না করে এক ক্যাম্প অধিবাসী তুলে ধরেন নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টিও। তিনি বলেন, প্রতিটি মুহূর্ত আমাদের আতঙ্কে কাটে। এই বুঝি পুলিশ এলো! আমরা অপরাধপ্রবণ নই। দেশের আইনশৃঙ্খলার প্রতি পূর্ণ আস্থা রেখেই শান্তিপ্রিয় নাগরিক হিসেবে যুগ যুগ ধরে বাসবাস করছি। অথচ কিছু একটা ঘটলেই বিহারিদের ‘নন্দঘোষ’ বানানো হয়। মাদক কেনা-বেচা, পরিবহন, ছিঁচকে চুরির ঘটনায়ও আমাদের দায়ী করা হয়। অথচ এই ক্যাম্পে মাদকবিরোধী অভিযান চালিয়ে আমরা নিজেরাই হাতেনাতে ধরে পুলিশে দিয়েছি। আমরাও মাদকের বিরুদ্ধে লড়াই করছি। পুলিশকে সহযোগিতা করছি। আমাদের বিরুদ্ধেই মাদক ব্যবসার বদনাম দেয়া হয়। এখানে কোনো মাদক উৎপাদন হয় না। সব আসে বাইরে থেকে। বাংলাভাষী মানুষরাই এগুলোর গ্রাহক। তারাই ক্যাম্পের বখে যাওয়া ছেলেপেলে শুধু ব্যবহৃত হচ্ছে। বাংলাভাষী বখাটে সন্ত্রাসীদের কাছে আমরা জিম্মি। তাদের প্রয়োজনে বিহারিদের অপরাধী ও সন্ত্রাসী বানাচ্ছে। অথচ এর জন্য প্রায়ই জেলে যেতে হয় আমাদের। ক্যাম্পের জমি দখলের উদ্দেশ্যে বার বার আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। উল্টো আমাদেরই আসামি করা হয়। বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। এসব নিয়ে কথা বললেই আমাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় মামলা। একেকটি ঘটনার পর মামলা হয়। ঘটনার সব দায় চাপানো হয় উর্দুভাষীদের ওপর। অসহায় অবস্থায় আমদের এখানে-সেখানে, মসজিদে, টার্মিনালে, ফুটপাথে রাত কাটাতে হয়।
এ প্রসঙ্গে তিনি গত ৫ অক্টোবর ঘটে যাওয়া বিহারি-বাঙালি সংঘর্ষের উদাহরণ দেন। তিনি বলেন, ক্যাম্পের বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করত ত্রাণ মন্ত্রণালয়। ২০০৩ সালে ভোটার তালিকায় নাম ওঠানোর পর সরকার ক্যাম্পের বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ বন্ধ করে দেয়। আমাদের নাকি ৩৪ কোটি টাকা বিদ্যুৎ বিল বকেয়া। আমাদের তেমন কোনো আয় নেই। এ টাকা আমরা কিভাবে দেবো? এ কারণে দীর্ঘদিন ক্যাম্পের অধিবাসীরা বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় ছিলেন। বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় ক্যাম্পে মানবিক বিপর্যয় নামার উপক্রম হয়। রাতে ঘুটঘুটে অন্ধকার। পানি নেই, মোটর চলে না। সব কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যায়। এ পরিস্থিতিতে আমরা বিদ্যুতের দাবিতে মিছিল করি। এ দেশের নাগরিক হিসেবে মোস্তাকিমের কাবাব ঘরের এখানে আমরা শান্তিপ্রিয়ভাবে মিছিল করতে চাই। এটি স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর মানতে পারেননি। এ কারণেই আমাদের ওপর হামলা। পরে উল্টো আমাদের বিরুদ্ধেই মামলা করা হয়। ওই মামলায় শত শত আসামি। সেই থেকে অনেকে আর ঘরে ঘুমাতে পারেন না। জেলে আছেন কেউ কেউ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই অধিবাসী আরো বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিভিন্ন মামলায় গ্রেফতারকৃত আসামির টার্গেট সংখ্যা পূরণ করতে প্রায়ই ক্যাম্প থেকে কিশোর-তরুণদের ধরে নিয়ে মিথ্যা মামলায় চালান করে দিচ্ছে। অথচ ওই ছেলেটি হয়তো কিছুই জানে না। পথে হাঁটছে কিংবা ঘরে শুয়ে আছে। কথা নেই বার্তা নেই তাকে হাতকড়া পরিয়ে ফেলা হয়। স্বপ্নে পুলিশ দেখলেও আঁৎকে উঠি। দুঃস্বপ্নে রাত ভোর হয়। জানতেই পারি না কী অপরাধ আমাদের।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।