Inqilab Logo

বুধবার ২০ নভেম্বর ২০২৪, ০৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সাদা মনের কালো মানুষ

তামিলরাজ্যের ভেতরে বাইরে : ধর্মীয় শান্তি-স¤প্রীতির অনুপম নজির

শফিউল আলম | প্রকাশের সময় : ৮ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

বাইরে থেকে দেখলে একদম আকর্ষণহীন দূরদেশ তামিলনাড়–। পা ফেলে মনে হবে পানির মাছ ডাঙ্গায়। তবে তামিলের পথে পথে, পদে পদে চোখে দেখা ও কানে শোনা বেশিরভাগই সুখকর অভিজ্ঞতা। ইতিবাচক ও ব্যতিক্রমী অনেক কিছুই উপলব্ধির দরজায় সত্যিই নাড়া দিয়েছে। বঙ্গোপসাগরের একদিকে বাংলাদেশের দক্ষিণের দুয়ার। সোয়া দুই হাজার কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরের শেষ প্রান্তে সুবিশাল ভারত মহাসাগর ঘেঁষে তামিলনাড়–। প্রায় কাছাকাছি শ্রীলংকা।

সাউথ ইন্ডিয়ার বিশেষ করে তামিলের নিকট অনেক কিছুই শেখার আছে ‘বিশাল’ দাবিদার ভারতের অন্যসব অঞ্চলের। শিক্ষণীয় হওয়া উচিৎ বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের। এমনকি সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার জন্যও।
বেশভ‚ষা, চাকচিক্য, ভোগবাদিতা, বাকচাতুর্য, অন্ধ পরানুকরণ?
“...তোর সঙ্গে? মারি অরি পারি যে কৌশলে” (মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাবধ কাব্য) মানেই কী চ‚ড়ান্ত বিচারে মানুষের শৌর্যবীর্য ও ‘কৌলিন্য’র পরিচয়? চানক্য বুদ্ধি? কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র?

নাকি এর বিপরীতে সততা, মেধা ও মননের চর্চা, স্বকীয়তা, দক্ষতা, ধী-শক্তি, আত্ম-পরিচয়বোধ, স্বদেশপ্রেম, আত্মবিশ্বাস, বাকসংযম, স্বভাবসুলভ সারল্য, মূল্যবোধের লালন, পরোপকার, সেবার মানসিকতা, প্রকৃতি ও মৌলিকত্ব ধারণ, ধর্মপরায়ণ ও মানব ধার্মিকতা, শান্তি ও স¤প্রীতির চর্চা, দীর্ঘকালের সুশৃঙ্খল সামাজিক বিবর্তনের মধ্যদিয়ে জাতিগোষ্ঠীর সুস্থির বিকাশ? হাঁ, এই গুণগুলোই তামিলের মানুষদের দিয়েছে অনন্য এক পরিচিতি। ‘কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে’। এর জ্বলন্ত উদাহরণ তামিল জনগোষ্ঠী। তামিলের শহর-নগর, গ্রাম-জনপদ ঘুরে ভেতর থেকে তাই মনে হয়েছে।

সাত কোটি জনসংখ্যার রাজ্য তামিলনাড়–র শতকরা ৮০ থেকে ৯০ ভাগ মানুষের গায়ের রঙ কালো। এই ‘কালো’ যেন উজ্জ্বল আলোর বাহক। তারা স্বভাবগতভাবেই সত্যভাষী, সৎ, শান্তিপ্রিয়, কর্মপাগল, শ্রমনিষ্ঠ। রঙ কালো তবে মন ভালো। ভারতের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিজ্ঞানী ড. এ পি জে আবদুল কালাম, বিশ্বখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক-সুরকার-শিল্পী এ আর রাহমান থেকে শুরু করে হাজারো কৃতিব্যক্তি ও তারকার জন্মস্থান তামিল। শিক্ষা-সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, জ্ঞান-গবেষণায় পুরো ভারতে অগ্রণী তামিলনাড়–। শিক্ষার হার ৭০ শতাংশ।

তামিলরাজ্যে ডাক্তারের সংখ্যা প্রায় সোয়া এক লাখ। যা এককভাবে ভারতীয় রাজ্যগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। ১৯০০ সালে মাত্র একটি শয্যা নিয়ে স্থাপিত আজকের দিনে ‘চিকিৎসার কারখানা’ নামে খ্যাত ভেলোর শহরের খ্রিস্টান মেডিকেল কলেজ (সিএমসি)সহ তিন ডজনেরও বেশি নামকরা হাসপাতাল ও বিশেষায়িত হাসপাতাল রয়েছে তামিলরাজ্যে। বর্তমান চেন্নাই যা প্রাচীনকালের মাদ্রাজ, তার সুখ্যাতি চিকিৎসা ও ওষুধ শিল্পে। অস্বীকারের জো নেই, চিকিৎসক ও নার্সরা প্রতিটি রোগীর জন্যই যেন নিবেদিতপ্রাণ। ভেলোর শহরে আছে সিএমসিসহ ১৪টি হাসপাতাল। সেখানে চিকিৎসা নিতে আসেন বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, চীন, পাকিস্তান, মালদ্বীপ ছাড়াও ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে। কয়েকজন ‘বাবু’ স্বীকার করলেন, কলকাতার চিকিৎসা ব্যবস্থা ছিল ‘নষ্ট’। এখন ‘ধ্বংস’। ওদের কথাগুলো বাংলাদেশের চিকিৎসায় বেহালদশার সঙ্গে মিলে যায়।

প্রকৌশল ও প্রযুক্তিতে তাক লাগানো অগ্রগতি তামিলদের হাতের মুঠোয়। এ রাজ্যে আছে ভারতের সর্ববৃহৎ মোটরগাড়ির শিল্পাঞ্চল। এ খাতে সারা ভারতের তিন ভাগের এক ভাগ মুনাফা তামিল রাজ্য থেকেই আসছে। তামিলনাড়–র রাজধানী চেন্নাই এবং হসুর শিল্পনগরে বিএমডবিøউ, মার্সিডিজ বেনজ, ফোর্ড, মিতসুবিসি, অশোক লেল্যান্ডের মতো নামকরা মোটরগাড়ি কোম্পানির অনেকগুলো কারখানা রয়েছে। পোলট্রি খামারজাত খাদ্য উৎপাদনে তামিল শীর্ষে।
জাতীয় অর্থনীতিতে রয়েছে তামিলরাজ্যের অন্যতম বৃহৎ অবদান। ভারতের জিডিপিতে পঞ্চম বৃহৎ অবদান এ রাজ্যের। ভারতের এককভাবে সর্বোচ্চ সংখ্যক বাণিজ্যিক সংস্থা (১০ দশমিক ৫৬ শতাংশ) তামিলে অবস্থিত। যা রাজ্যটির জনসংখ্যার (ভারতের ৬ শতাংশ) তুলনায় অনেক বেশি। এ রাজ্য আয়কর প্রদানে ভারতে ৪র্থ অবস্থানে।

তামিলনাড়–র মানুষ জ্ঞান-গবেষণা, অর্থনীতি, খেলাধুলা, টিভি ও চলচ্চিত্র শিল্প, সংস্কৃতিতে তাদের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য আর আধুনিকতার মিশ্রণে অগ্রগতির স্বর্ণশিখরে আরোহন করেছেন। অভাবনীয় উন্নতির পেছনে অন্যতম সহায়ক শক্তি হিন্দু-মুসলমান-খ্রীস্টান-বৌদ্ধ এমনকি নিম্নবর্ণের জাতি (হিন্দু ধর্মবিশ্বাসী) মিলিয়ে বিরাজমান ধর্মীয় সা¤প্রদায়িক শান্তি-স¤প্রীতি। যার অনুপম নজির তামিল। সকল ধর্মীয় মত ও পথ যেন মিশে গেছে কাবেরী নদীর একই স্রোতধারায়। দিল্লী, কলকাতা, মুম্বাইয়ের মতো চেন্নাই, ভেলোরে প্রতারণা-শঠতা, অসাধুতার ঠাঁই নেই। গভীর রাতেও মানুষ নিরাপদে পথঘাটে যে যার কাজে ঘুরছে। মহিলাদের রয়েছে সামাজিক মর্যাদা। শিক্ষা-দীক্ষায়, কর্মসংস্থানে তারা বেশ এগিয়ে।

চেন্নাই (মাদ্রাজ), ভেলোরসহ বিভিন্ন স্থানে মুসলমানদের শত শত বছরের ঐতিহ্যের নিদর্শনগুলো রয়েছে সমুন্নত। হায়দার আলী-টিপু সুলতানের বীরত্বের স্মৃতিধন্য সেই সুরম্য ভেলোর কেল্লা বা ফোর্ট, ছোট-বড় অনেক মসজিদ-মক্তব ঐতিহ্যের স্মারক। পাঁচ ওয়াক্ত আজানের সুমধুর ধ্বনি শোনা যায় যে কোনো জায়গা থেকে। তামিল মুসলিমরা শিক্ষাদীক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরিসহ বিভিন্ন পেশায় পিছিয়ে নেই। ভোলোর শহরে হিন্দু-মুসলমান জনসংখ্যার অনুপাত ঊনিশ-বিশ। জেলায় প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ ভাগ মুসলমান। তারা রাষ্ট্রের কল্যাণে এবং সমাজসেবায় অবদান রাখছেন। চেন্নাই-হায়দ্রাবাদ কেন্দ্রিক টিভি ও চলচ্চিত্র তারকাদের মাঝেও মুসলিম কম নয়।
তামিলনাড়–র রাজধানী চেন্নাই ভারতের চতুর্থ ও বিশ্বের ৩৬তম বৃহত্তম নগর। বঙ্গোপসাগরের করমন্ডল উপকূলে অবস্থিত দক্ষিণ ভারতের প্রবেশদ্বার ৩৭০ বছরের পুরনো মাদ্রাজ শহরের নাম ১৯৯৬ সালে পরিবর্তিত হয়ে চেন্নাই। চেন্নাইকে দক্ষিণ এশিয়ার ডেট্রয়েট বলা হয়। পাশ্চাত্য থেকে আসা আউটসোর্সিং কাজের প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে এ নগরী। ক্রিকেট, ফুটবল, টেনিসসহ ক্রীড়াচর্চার প্রধান রাজ্য তামিল। ভারতের একমাত্র এটিপি টেনিস চেন্নাই ওপেন এ নগরে আয়োজিত হয়। ১৮৫৪ সালে মাদ্রাজ ক্রিকেট ক্লাব গঠিত হয়। এম. চিদাম্বরম স্টেডিয়াম এ রাজ্যের প্রধান আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম। ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লীগে (আইপিএল) চেন্নাই সুপার কিংস দল তামিলের প্রতিনিধিত্ব করছে।
চেন্নাই অর্থনীতির অন্যতম চাবিকাঠি সফটওয়্যার সার্ভিস, হার্ডওয়্যার উৎপাদন, আর্থিক সেবাসমূহ, সামরিক সরঞ্জাম নির্মাণ, রেলওয়ে ইঞ্জিনসহ যন্ত্রপাতি তৈরি, পেট্রো কেমিক্যাল, বস্ত্রশিল্প, সাজপোশাক, সমুদ্রবন্দর, মেরিনা ও গোল্ডেন বিচসহ পর্যটন খাত। চেন্নাইয়ে পূর্ণাঙ্গরূপে তথ্য-প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রিত একটি স্টক এক্সচেঞ্জ রয়েছে, মাদ্রাজ স্টক এক্সচেঞ্জ।

পাহাড়-পর্বতশৈলী, সবুজ উপত্যকা, সমভ‚মি, নদ-নদী, হ্রদ, বনাঞ্চল নিয়ে প্রকৃতির নিপুণ হাতে গড়া তামিলনাড়–। এখানকার নীলগিরি পার্বত্য রেলপথের উটি এবং মেট্টুপালয়মের মাঝামাঝি এলাকাটি ইউনেস্কো স্বীকৃত বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান। এ রাজ্যে এ ধরনের ইউনেস্কো স্পট আছে আটটি।
আয়তনে তামিলনাড়– ভারতের একাদশ (গ্রিসের সমান) জনসংখ্যায় ৭ম বৃহৎ রাজ্য। প্রায় পাঁচশ’ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ থেকে তামিলনাড়– ভ‚খÐে তামিল জাতির আবাস। দেড় হাজার বছর ধরে এ অঞ্চলের তামিল ভাষা লেখ্যরূপে ও সাহিত্যে ব্যবহৃত। যা পৃথিবীতে আজও প্রচলিত অন্যতম প্রাচীন ভাষা। তামিলরা হিন্দি ভাষা চর্চা ও পছন্দ করে খুবই কম। তবে তামিল ভাষার সমানতালে ইংরেজি ব্যাপক প্রচলিত। ইডলি, দোসা, মাসালা এবং হরেক রকম মিষ্টি খাবার তামিলে জনপ্রিয়। রাজ্যের জনপ্রিয় সঙ্গীত “তামিল তাই ওয়ালত্তু” (তামিলমাতৃকার আবাহন)। সর্বোপরি তামিলনাড়–র জনগণ শিক্ষা, জ্ঞান-গবেষণা, সততা, শ্রম, শৃঙ্খলা ও অধ্যবসায়কে পুঁজি করে নিরন্তর এগিয়ে চলেছেন। অথচ নেই বাহ্যিক বিলাস।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ