Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভবঘুরে আইন অকার্যকর

‘পুনর্বাসন’ না হওয়ায় ৮ বছরেও সুফল মেলেনি

সাঈদ আহমেদ | প্রকাশের সময় : ১ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১২:০০ এএম

ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধে কাজে আসছে না ‘ভবঘুরে নিয়ন্ত্রণ আইন’। প্রণয়নের ৮ বছর অতিবাহিত হলেও-এর কোনো সুফল মেলেনি। ফলে ২০১১ সালে প্রণীত ‘ভবঘুরে পুনর্বাসন আইন’ প্রয়োজনীয় অথচ অকার্যকর একটি আইনে পরিণত হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, আইনটি যথেষ্ট ত্রæটিপূর্ণ, অদূরদর্শিতা প্রসূত। প্রয়োগেরও কোনো সদিচ্ছা দেখা যাচ্ছে না।

পর্যালোচনায় দেখা যায়, ভবঘুরে নিয়ন্ত্রণের কথা আইনে থাকলেও স্পষ্ট করা হয়নি তাদের পুনর্বাসনের বিষয়টি। ফলে দিন দিন বাড়ছে পেশাদার ভিক্ষুক সংখ্যা। বিশ্লেষকদের মতে, আইনের খসড়া প্রণয়নকারীদের অদূরদর্শিতা, আইন কার্যকরে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদিচ্ছা এবং বিধি না হওয়ার কারণেই আইনটির সুফল মিলছে না।
ভবঘুরে ও নিরাশ্রয় ব্যক্তি (পুনর্বাসন) আইন, ২০১১-তে বলা হয়েছে, যে নিজে বা কারও প্ররোচনায় ভিক্ষাবৃত্তিতে লিপ্ত, সে ভবঘুরে হিসেবে বিবেচিত হবে। এতে ভবঘুরেদের আটক করার বিধান রাখা হয়েছে।
এ বিষয়ে আইনের তৃতীয় অধ্যায়ের ৯ (১) ধারায় বলা হয়েছে, পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার নিম্নে নন এমন কর্মকর্তা অথবা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা বিশেষ ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তা, কোনো ব্যক্তিকে ভবঘুরে বলে গণ্য করার যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে মর্মে নিশ্চিত হলে, তিনি উক্ত ব্যক্তিকে যে কোনো স্থান থেকে যে কোনো সময় আটক করতে পারবেন।

আইনে আরও বলা হয়েছে, ভবঘুরেকে আটকের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হাজির করতে হবে। আর আটককৃত ব্যক্তি ভবঘুরে হলে ম্যাজিস্ট্রেট যেকোনো আশ্রয়কেন্দ্রে কমপক্ষে ২ বছর তাকে আটক রাখার জন্য অভ্যর্থনা বা আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠানোর নির্দেশ দেবেন।
আইনে ভাসমান জনগোষ্ঠিকে ‘ভবঘুরে’ এবং ‘আশ্রয়হীন’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অথচ তাদের সামাজিকভাবে পুনর্বাসনে স্পষ্ট কোনো বিধান রাখা হয়নি। ২০১১ সালে প্রণীত ‘ভবঘুরে ও নিরাশ্রয় ব্যক্তি পুনর্বাসন আইন’র ১০(৩)(খ) ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি ভবঘুরে হিসেবে প্রমাণিত হলে, তাকে অনধিক ২ বছরের আটকাদেশ দেয়া যাবে। কিন্তু পুনর্বাসনের বিষয়ে আইনটির ১৮(১) ধারায় সংক্ষেপে বলা হয়েছে, আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থানরত ভবঘুরে ব্যক্তির পুনর্বাসনের লক্ষ্যে সরকার নির্ধারিত পদ্ধতিতে পরিকল্পনা প্রণয়নপূর্বক তা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এখানে ‘নির্ধারিত পদ্ধতি’ বলা হলেও আইনের কোথাও কোনো পদ্ধতির উল্লেখ নেই। এছাড়া ধারায় উল্লেখিত ‘যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ’ বলতে কি ব্যবস্থা নেয়া হবে সেটিও স্পষ্ট নয়। আইনের দৃষ্টিতে ‘যথাযথ ব্যবস্থা’ শব্দটি অনির্ধারিত ও অস্পষ্ট বলেই বিবেচিত। আইনে আটককালীন মেয়াদে তার শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের কোনো বিধান রাখা হয়নি। এমনকি আটকের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তাকে সরকারি বা বেসরকারি সহায়তায় পুনর্বাসনের কোনো বিধান রাখা হয়নি। ফলে আটককৃত ভবঘুরেদের আটকের মেয়াদ শেষে বৈধ কাজ-কর্ম করে জীবিকা নির্বাহের সুযোগ নেই। এতে আটককৃত ভিক্ষুকরা তাদের আটকের মেয়াদ শেষে আবারো ভিক্ষাবৃত্তিতেই ফিরে যায়। মোবাইল কোর্ট তাদের বার বার আটক করলেও ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধ হচ্ছে না। ফলে ভবঘুরে নিয়ন্ত্রণ ও পুনর্বাসনের লক্ষ্যে বিদ্যমান আইন ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধে কার্যকর কোনো ভূমিকাই রাখছে না।

আইনটির ২৭ ধারায় বলা হয়েছে, সরল বিশ্বাসে করা কোনো কাজের ফলে কোনো ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে এর জন্য সরকার বা সরকারের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে কোনো দেওয়ানি বা ফৌজদারি বা অন্য কোনো আইনগত কার্যধারা দায়ের করা যাবে না। এই ধারায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে। এই বিধানের উপস্থিতির ফলে আইন প্রয়োগকারীরা আরো স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠার আশঙ্কা রয়েছে। এতে আইনটির অপব্যবহারের সুযোগ রয়ে গেছে। ‘ভুলবশত’ কোনো ব্যক্তিকে ‘ভবঘুরে’ হিসেবে আটক এবং হয়রানি করা হলেও তাদের কোনো জবাবদিহিতা থাকবে না। ফলে অসদুদ্দেশ্য কিংবা ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থে কাউকে আটক করে সেটিকে ‘ভুলবশত আটক’ বলে চালিয়ে দেয়ার সুযোগ রয়ে গেছে।

এ ছাড়া আইনটিতে মানসিক বা শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ‘ভবঘুরে’ হিসেবে আটক হলে তাদের আটক, চিকিৎসা ও কল্যাণের জন্য বিশেষ কোনো বিধান রাখা হয়নি। পুনর্বাসনের কথা বলা হলেও এর কোনো সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনা নেই। ভিক্ষুকদের এখনো ‘ভবঘুরে’ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। ফলে প্রণীত আইন দিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি দূর করা সম্ভব হচ্ছে না। বরং অস্পষ্ট আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সমস্যাগুলোর সমাধানের পরিবর্তে আরো জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হচ্ছে।

‘হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ’র চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ এ বিষয়ে ‘ইনকিলাবকে বলেন, আইনটি জনগুরুত্বপূর্ণ অথচ ত্রæটিপূর্ণ, অসম্পূর্ণ। খসড়ায়ও অদূরদর্শিতা রয়েছে। বিধান করা না হলে শুধু আইন কখনো সফলতা আনতে পারে না। নগরবাসী ভিক্ষুকদের যন্ত্রণায় অতীষ্ট। অথচ সরকার নাকি কোনো ভিক্ষুকই খুঁজে পাচ্ছে না। কর্তৃপক্ষীয় এ ধরণের দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই অসাধু ব্যক্তিরা ভিক্ষাবৃত্তিতে নিত্যনতুন মাত্রা যোগ করছে। ভিক্ষাবৃত্তি প্রসারের সুযোগ নিচ্ছে।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, রাজধানীর ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধে সরকারের ঘোষণা রয়েছে। এমনকি সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারেও ভিক্ষুকমুক্ত নগরী গড়ার কথা বলা হয়। বাস্তবে দুয়েকটি অভিজাত এলাকা ছাড়া নগরীরর সর্বত্রই ভিক্ষুকদের অবাধ বিচরণ।
মন্ত্রণালয় আরো জানায়, সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে ২০১০ সালে ‘ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান’ নামক একটি কর্মসূচি হাতে নেয়।
২০১০-১১ অর্থবছরে কর্মসূচি খাতে ৬ কোটি ৩২ লাখ টাকা, ২০১১-১২ অর্থবছরে ৭ কোটি টাকা। ২০১২-১৩ অর্থবছরে রাখা হয় ১০ কোটি টাকা। প্রতি অর্থবছরে অর্থ বরাদ্দ রাখা হলেও কোনো বছরই কোটি টাকার বেশি খরচ দেখাতে পারছে না সমাজসেবা অধিদফতর।

ব্যয়িত অর্থও কেবল ব্যয় হয়েছে জরিপ, আসবাব কেনা এবং ময়মনসিংহ ও জামালপুরে কিছু কার্যক্রম পরিচালনায়। বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় না হওয়ায় পরের বাজেটগুলোতে বরাদ্দই কমিয়ে দেয়া হয়। এর ভিত্তিতে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মোহিত গতবছর এক বক্তৃতায় বলেন, দেশে কোনো ভিক্ষুক নেই।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্র আরো জানায়, ‘ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান’ কর্মসূচির আওতায় একটি জরিপ হয়। ঢাকার ১০টি বেসরকারি সংগঠন সরকারি অর্থে ভিক্ষুকের ওপর জরিপ চালায়। তাদের তথ্য সংগ্রহ করে ১০ হাজার ভিক্ষুকের ছবি ও তথ্য নিয়ে ‘তথ্য-ভান্ডার’ তৈরি করে। কর্মসূচির আওতায় কাগজে-কলমে ময়মনসিংহ ও জামালপুরে মাত্র ৬৬ ভিক্ষুককে পুনর্বাসন করা হয়। এর মধ্যে ১২ জনকে ১২টি রিকশা, ১৭ জনকে ১৭টি ভ্যান ও ক্ষুদ্র ব্যবসা পরিচালনার জন্য ৫ হাজার করে টাকা দেয়া হয়। এ ভিক্ষুকদের সবাই ময়মনসিংহ জেলার। এর পাশাপাশি জেলাটির আরও ৮ জন ভিক্ষুককে পাঁচ হাজার করে টাকা দেয়া হয়। ‘পুনর্বাসিত’ ৩৭ জন ভিক্ষুকের মধ্যে ৩০ জন বর্তমানে কোথায় আছে? কী করছে? তার কোনো তথ্য নেই সমাজসেবা অধিদফতরে। ধারণা করা হচ্ছে, এরা সবাই রিকশা ও ভ্যান বিক্রি করে আবারও ভিক্ষাবৃত্তিতেই নিয়োজিত হয়েছেন।
ভবঘুরে ও নিরাশ্রয় ব্যক্তি (পুনর্বাসন) আইন, ২০১১ কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। আইনটির চতুর্থ অধ্যায়ের ২২(১) (খ) ধারায় বলা হয়েছে, যদি আশ্রয়কেন্দ্র থেকে কেউ পালায় তবে সে কমপক্ষে ৩ মাসের কারাদন্ডে দন্ডিত হবে। কিন্তু এ পর্যন্ত এ অপরাধে কেউ দন্ডিত হয়েছে বলে তথ্য নেই সমাজসেবা অধিদফতরে। সমাজসেবা অধিদফতরের পরিচালক (কার্যক্রম) আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, আইন থাকলেও বিধি এবং জনবলের অভাবে অনেককিছুই করা সম্ভব হচ্ছে না। আইন প্রণয়নের পরপরই এটির কার্যকরিতা পরীক্ষায় ২ হাজার ভিক্ষুক পুনর্বাসনের একটি পাইলট প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছিল। যথেষ্ট আন্তরিকতা থাকা সত্তে¡ও বিধিগত সীমাবদ্ধতা এবং জনবলের অভাবে ওই প্রকল্পে কাক্সিক্ষত ফলাফল আসেনি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ