পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
গর্র গর্র আওয়াজ। কয়েক পা এগিয়ে দেখি তরতাজা একটি বড়সড় গাছ করাত দিয়ে কাটা হচ্ছে। ঘটনাস্থল মহেশখালী দ্বীপের কালামার ছড়া সোনারপাড়া টিলাময় গ্রাম। জানতে চাইলে করাত শ্রমিক শাহাব আলী বললেন, আমরা স্থানীয় ঠিকাদারের লোক। এখানে আরও কয়েকশ বড়-ছোট গাছপালার সাথে টিলা কেটে সমান করা হচ্ছে। এসপিএম (সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং) অর্থাৎ জ¦ালানি তেলের ডিপো ও পাইপ লাইন স্থাপনের কাজ চলছে। আরকে দৃশ্য কুতুবদিয়ার দক্ষিণ ধুরংয়ের। কুঠারের ঠক ঠক আঘাতে সেখানে ভাঙাচোরা বেড়িবাঁধের ধারেই জরতাজা কয়েকটি কেওড়া গাছ কেটে শুইয়ে দেয়া হয়েছে। কৃষক হামিদ হোসেন বলেন, এই গাছে দিয়ে গোয়াল ঘর তুলবেন। সম্প্রতি দেশের সমুদ্র উপক‚লীয় চর ও দ্বীপাঞ্চলের প্রত্যন্ত জায়গায় ঘুরে এমন দৃশ্যে চোখ আটকে যায় বেশ কয়েক স্থানে। যারা নাজুক ও অরক্ষিত প্রায় উপক‚লে গাছপালা এভাবে কেটে-ছেঁটে সবাড় করছে তাদের ভাবখানা যেন এ এমন কী! ডালভাত ব্যাপার! আর উপক‚ল-চর-দ্বীপাঞ্চলে বৃক্ষরাজি রক্ষা যাদের দায়িত্ব তাদের অনেকে কার্যত ভক্ষকের ভূমিকায়।
এ অবস্থায় বিরান হওয়ার পথে দেশের সমুদ্র উপক‚লীয় সবুজ বেষ্টনি তথা গ্রীন বেল্ট। অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রতি বছরই কোটি বৃক্ষ চারা রোপন করা হয়। এরজন্য আছে বিশাল বাজেট, জনবল। কিন্তু রোপিত বৃক্ষের কী পরিণতি ঘটে আদৌ তারা বেড়ে উঠছে কিনা সে সম্পর্কে যথোপযুক্ত তদারকি ও মনিটরিং নেই। বরং উপক‚লীয় সবুজ বেষ্টনি নামক বৃক্ষের চারা রোপনের পুরো বিষয়টা চলছে সেই ‘কাজির গরু কেতাবে আছে’ হিসাব-নিকাশের মতোই। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, দক্ষ, সৎ ও কর্মনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত বর্তমান প্রধান বন সংরক্ষক (সিসিএফ) সহ শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন কর্মকর্তা দেশের বনজ সম্পদের সুরক্ষা ও সম্প্রসারণে ঐকান্তিক আগ্রহী।
তবে বন বিভাগের অভ্যন্তরে সিনিয়র, মাঝারি ও অধস্তন পর্যায়ের একশ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলে সংঘবদ্ধ অসৎচক্র নয়-ছয়ের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি-অনিয়ম, হরিলুট করছে। নানান অপকৌশলে পার পেয়ে যাচ্ছে ‘বনের রাজা ওসমান’রা। অন্যদিকে হুমকির মুখে পড়েছে সমুদ্র উপক‚লভাগের উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্য। বাড়ছে দুর্যোগের ঝুঁকি এবং ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা।
এদিকে চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশ বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, বাংলাদেশের সমুদ্র উপক‚ল চর ও দ্বীপাঞ্চল এমনিতেই দুর্যোগ প্রবণ। ঘূর্ণিঝড়-জলাচ্ছ¡াসের আঘাত থেকে জনবহুল উপক‚লীয় অঞ্চল এবং সেখানকার সম্পদ, অবকাঠামো সুরক্ষার জন্য প্রথমত অপরিহার্য ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল। সমগ্র উপক‚লে মজবুত বেড়িবাঁধ শুধুই নয়, গড়ে তুলতে হবে সবুজ বেষ্টনি বা গ্রীন বেল্ট। এরজন্য স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে উপক‚লীয় অঞ্চলে নিবিড় বনায়ন করা প্রয়োজন। এর পাশাপাশি রোপিত বৃক্ষের চারাগুলোর সুরক্ষাও নিশ্চিত করতে হবে। কোনো অনিয়ম অবহেলা থাকলে তা খুঁজে বের করে সমাধান এবং সর্বোপরি জবাবদিহিতা থাকাটা জরুরি। তিনি জানান, ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল দুর্যোগের সময় প্রকৃতির ঢাল হিসেবে কাজে আসে এবং ক্ষয়ক্ষতি লাঘব করে। যেমন- সুন্দরবন প্রায় প্রতিবছর দুর্যোগের আঘাত কমিয়ে দিচ্ছে। দক্ষিণাঞ্চলের বিরাট অংশকে সুরক্ষা করছে সুন্দরবন।
সরেজমিন খোঁজ-খবর নিয়ে জানা গেছে, উপযুক্ত তদারকি এবং দুর্নীতি-অনিয়ম আর শুভঙ্করের ফাঁকির কারণেই দেশের বিশাল সমুদ্র এলাকাজুড়ে ক্রমেই বিপন্ন অবস্থায় ধাবিত হচ্ছে উপক‚লীয় সবুজ বেষ্টনি। বাংলাদেশের সমুদ্র উপক‚লভাগ, চর ও দ্বীপাঞ্চলের ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের বৃক্ষরাজি ধ্বংস করা হচ্ছে নির্বিচারে। এককালে চকরিয়ায়ও ছিল আরেক ‘সুন্দরবন’- যেটি দেড় দুই দশক আগেও চকরিয়ার সুন্দরবন হিসেবে সুপরিচিত ছিল। চিংড়ি ঘের ও লবণ চাষের আগ্রাসনে দেড় দুই দশক আগেই হারিয়ে গেছে চকরিয়ার সুন্দরবন।
ঝাউবীথী, কেওড়া, বাইনসহ শত রকমের উদ্ভিদরাজি নিয়ে এক সময়ে নিবিড় বনাঞ্চল থাকলেও বর্তমানে উপক‚লের অনেক এলাকায় বৃক্ষরাজি বিপন্ন প্রায়। এসব এলাকার মধ্যে রয়েছে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত, শাহপরীর দ্বীপ ও সেন্ট মর্টিন দ্বীপসহ টেকনাফ সৈকত, কুতুবদিয়া-মহেশখালী সৈকত, উখিয়ার সৈকত ও বনাঞ্চল, চকরিয়া ও পেকুয়ার সৈকত ও বনাঞ্চল, চট্টগ্রামের আনোয়ারা পার্কি ও গহিরার সৈকত, বাঁশখালীর সৈকত, সীতাকুÐ, মীরসরাই, বন্দরনগরী চট্টগ্রাম সংলগ্ন পতেঙ্গা-হালিশহর-কাট্টলী, ভাটিয়ারি এলাকা ইত্যাদি।
বিশেষজ্ঞগণ জানান, উপক‚লে কেওড়া ও অন্যান্য ম্যানগ্রোভ গাছপালার একাংশ আগামরা (টপ ডাইয়িং) রোগের কারণেও হ্রাস পাচ্ছে। তাছাড়া তেল দূষণ, জাহাজের পোড়া তেল ও বর্জ্য নিঃসরণসহ বিভিন্নভাবে পরিবেশ-প্রতিবেশের দূষণ এবং আবহাওয়া-জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তনের কারণেও সমুদ্র উপক‚লীয় বিশেষ করে চর ও দ্বীপাঞ্চলে সবুজ বেষ্টনির সর্বনাশ ঘটছে। এরজন্য সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। কেননা উপক‚লে বনাঞ্চল বিপন্ন হয়ে পড়ার সাথে সাথে সেখানকার পশুপাখি, জীববৈচিত্র্য হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে ভূমি বা মাটির ক্ষয়।
সমুদ্র উপক‚লের চর ও দ্বীপাঞ্চলের বনজ সম্পদ ও ম্যানগ্রোভ বনের বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কামাল হোসাইন পরিকল্পিত বনায়ন ও তার সংরক্ষণ নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়ে বলেন, উপক‚লীয় বৈরী পরিবেশ-প্রকৃতির ভারসাম্যের জন্য ন্যূনতম প্রয়োজনের তুলনায় সামান্যই রয়েছে বন-জঙ্গল তথা আমাদের জন্য অপরিহার্য সবুজ বেষ্টনি। প্রাকৃতিক বর্মের মতো দেশের বিস্তীর্ণ সমুদ্র উপক‚লকে আগলে রাখার জন্য এর সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।
এদিকে উপক‚লে বনাঞ্চলের মারাত্মক এ ধ্বংসলীলা চলছে দীর্ঘদিন। অতিলোভী ও অপরিণামদর্শী গাছ ও কাঠ ব্যবসায়ী, চোরাকারবারি ও ভূমিদস্যুর সংঘবদ্ধ চক্র সমুদ্র উপক‚লভাগের গাছপালা অবাধে নিধন করছে। এদের সাথে যোগসাজশ কোটিপতি ‘বনের রাজা ওসমান গনি’র মতো বন বিভাগের একশ্রেণির বেপরোয়া দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীর। উপক‚লীয় বন বিভাগ পরিণত হয়েছে হরিলুটের আখড়ায়। দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার কোনো বালাই নেই। উপক‚লে বনায়ন আর পরিচর্যার নামে নয়-ছয় গোঁজামিল করে কোটি কোটি টাকা পকেটে ভরছে বনখেকো চক্রটি। উপক‚লে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল রক্ষার বদলে ভক্ষকের ভূমিকায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো রকম শাস্তিমূলক ব্যবস্থার উদাহরণ নেই।
বন বিশেষজ্ঞ সূত্রগুলো জানায়, বঙ্গোপসাগরের কিনারায় বৃহত্তর চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, পটুয়াখালী, খুলনা অঞ্চলের উপক‚লে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল ছাড়াও উপক‚লের কাছাকাছি এলাকায় পাহাড়-টিলায় কিংবা উঁচুনিচু ভূমিতে বন-জঙ্গলে গাছপালার ঘনত্ব আশঙ্কাজনক হারে কমছে। গত প্রায় এক দশকে প্রায় ২০ জাতের গাছপালা বিলুপ্ত হয়ে গেছে অথবা বিরল প্রায়। সেই সাথে বিভিন্ন প্রজাতির পাখ-পাখালি, জীবজন্তু, হরেক জীববৈচিত্র্যের বিচরণ, বসতি ও বংশবৃদ্ধির হার কমে যাচ্ছে। এতে করে সার্বিকভাবে ঘটছে পরিবেশ বিপর্যয়।
সুরক্ষার অভাবে, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া-জলবায়ু ও বৈরী পরিবেশে টিকতে না পেরে হরেক জাতের গাছপালা বাংলাদেশের উপক‚লীয় ও সংলগ্ন উঁচুনিচু উপত্যকাময় উর্বর পললভূমি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। কেওড়া, ঝাউবীথি ছাড়াও উপক‚ল ও এর কাছাকাছি এলাকাগুলোতে হরেক ধরনের গাছপালা বিলুপ্তির মুখে। এরমধ্যে রয়েছে, বাবলা, হরতন, বট, অশ্বথ, মান্দার, তেলসুর, চাপালিশ, গামার, মেহগনি, বহেরা, নিম, তেঁতুল, জাম, ঢাকিজাম, শিমূল, শিশু, কাও, ডালিম, বাইন, হারতকি, গাব প্রভৃতি। গাছাপালা কমে গিয়ে মানুষের বন্ধু পাখি, পোকা ও জীবজন্তু তাদের বংশ বিস্তারের পরিবেশ হারিয়ে ফেলছে। নিবিড় গাছপালার অভাবে গাছে পাখি বসতে পারে না, বাসা বাঁধে না, তাদের খাবার ফলমূল মিলেনা না। মাটির গুণাগুণ ও উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে। যা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মানুষের জীবনযাত্রাকে করছে ব্যাহত।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।