পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
আমীর সওদাগর ও ভেলুয়া সুন্দরীর অমর প্রেমের সাক্ষী চট্টগ্রাম নগরীর পাহাড়তলীর ভেলুয়া সুন্দরীর দীঘি হতে পারে দৃষ্টিনন্দন এক পর্যটন কেন্দ্র। ইট-পাথরের নগরে সবুজে ঘেরা নীল পানির এই অথৈ দীঘি নগরবাসীকে দিতে পারে অন্যরকম প্রশান্তি। পরিকল্পিতভাবে সাজিয়ে তুলে দীঘিরপাড়ে শিশু পার্ক আর বয়স্কদের হাঁটার ব্যবস্থাও করা যায়। এতে করে ঘুরে বেড়ানোর পাশাপাশি দেশি-বিদেশি পর্যটকেরা ঐতিহাসিক এই দীঘির জন্মের রহস্যও জানতে পারবেন।
৫০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী দীঘিটি এই অঞ্চলের ইতিহাস ও সংস্কৃতির স্মারক। পনের শতকে সংঘটিত অপরূপা ভেলুয়া সুন্দরীর বিয়োগান্ত প্রণয় উপাখ্যান- সেই কাহিনীকে পালাগান আর পুঁথিতে তুলে ধরেছিলেন সে সময়ের চারণ কবিরা। তা এখনও বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির অংশ হয়ে আছে। বেপরোয়া দখলে দূষণে বিবর্ণ দীঘিটি দখলদারদের থাবা থেকে মুক্ত হয়েছে। এ অবস্থায় ভেলুয়া দীঘি সুরক্ষায় ওই এলাকাকে ঘিরে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা জরুরি বলছেন সংশ্লিষ্টরা। আর তা নাহলে দীঘিটি ফের দখলদারদের কব্জায় চলে যাওয়ারও আশঙ্কা করা হচ্ছে।
নগর পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতি প্রফেসর জেরিনা হোসেন দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, ঐতিহাসিক এ স্থাপনা সুরক্ষা করার কোন বিকল্প নেই। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশে এ ধরনের স্থাপনাকে ঘিরে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। ভেলুয়া সুন্দরী দীঘি আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অংশ। এটি নগরীর প্রাকৃতিক পরিবেশ সুরক্ষায়ও অনন্য ভূমিকা পালন করে আসছে। এ ধরনের স্থাপনা সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া দরকার। এতে করে পর্যটকরা বেড়ানোর সুযোগ পাবে তেমনি শত বছরের ইতিহাস ও সংস্কৃতি সম্পর্কেও জানতে পারবে।
পাহাড়তলী স্টেশনের পশ্চিম পাশে এই দীঘি। টাইগারপাস থেকে আমবাগান হয়ে পাহাড়তলী রেলক্রসিং পার হয়ে একটু দূরেই ভেলুয়া সুন্দরী দীঘি। টাইগারপাস থেকে দীঘি পর্যন্ত যাওয়ার পথে আছে নগরীর সুউচ্চ পাহাড় বাটালি হিল, রেলওয়ের জাদুঘর, ব্রিটিশ আমলে নির্মিত রেলের দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যশৈলীর অনেক স্থাপনা। দীঘি দেখতে যাওয়ার পথে এসব স্থাপনা দেখারও সুযোগ পাবেন পর্যটকেরা।
নগরীতে এমনিতেই খোলা মাঠ আর ঘুরে বেড়ানোর মতো পার্কের অভাব আছে। বিশেষ করে শিশুদের বিনোদন আর ঘুরে দেখার মতো তেমন কিছু নেই। এই দীঘিকে ঘিরে সেই চাহিদা পূরণ করা যায়। ভেলুয়া সুন্দরীর দীঘিকে ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে এটি সংরক্ষণের তাগিদ দেয়া হয় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ সিডিএর ডিটেলস এরিয়া প্ল্যানে (ড্যাপ)। তাতে দীঘিটি সংরক্ষণ করে বিনোদনমূলক উন্নয়ন করে পর্যটকদের জন্য খুলে দিতে বলা আছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলীয় জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) নাসির উদ্দিন আহমেদ গতকাল মঙ্গলবার দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, দখলমুক্ত করার পর দীঘিটি সুরক্ষায় উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রাথমিকভাবে দীঘির চারপাশ দখলে নিয়ে তা মানুষের হাঁটার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। ঐতিহাসিক এই স্থাপনাকে ঘিরে পর্যটন কেন্দ্র করার বিষয়ে তিনি মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব প্রেরণ করবেন জানিয়ে বলেন, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার মন্ত্রণালয়ের।
ব্রিটিশ শাসন আমল থেকে দীঘিটি রেলওয়ের সম্পত্তি। ১৯৮২ সালে দীঘির দক্ষিণ পাশে পাহাড়তলী বাজারের জন্য কয়েকটি দোকান ইজারা দেয় রেলওয়ে। তখন থেকে শুরু হয় দখল। ১৯৮৪ সালে মাছ চাষের জন্য দীঘিটি ইজারা দেয়া হলে দখলের মাত্রা আরও বাড়ে। প্রায় ৩০ বছর পর রেলওয়ে দীঘির পাড়ের দখলদারদের উচ্ছেদ করে।
গতকাল সরেজমিন দেখা যায়, এখনও দীঘির দক্ষিণপাড়ে কিছু স্থাপনা অক্ষত রয়েছে। বড়শি দিয়ে মাছ ধরার জন্য দীঘির ভেতরে বাঁশের খুটি গেড়ে রীতিমত রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। দখলে-দূষণে দীঘির পানিও বিবর্ণ হওয়ার পথে। রেলওয়ের বিভাগীয় ভ‚-সম্পত্তি কর্মকর্তা মাহবুবউল করিম বলেন, ১৪ এক আয়তনের দীঘির চারপাশে আরও ১৪ একরের মতো জায়গা দখলমুক্ত করা হয়েছে। দীঘির পাড় সুরক্ষায় উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে দীঘি নিয়ে একটি মামলা চলমান থাকায় আপাতত দীঘির ভেতরে সংস্কারের কাজ করা যাচ্ছে না।
ইতিহাস আর লোকগাথা থেকে জানা যায়, ১৫১৯ সালে চট্টগ্রামের স্বাধীন সুলতান নসরত শাহ এর শাসন চলছিল। যমুনা তীরের ধনী সওদাগর আমীর সাধুর সুন্দরী বধূ ভেলুয়াকে চুরি করেন কাট্টলীর ভোলা সওদাগর। সাগর নদী পাড়ি দিয়ে বর্তমান ভেলুয়া দীঘির স্থলে ভোলা সওদাগরের বাড়িতে আবিষ্কার করেন ভেলুয়াকে। যুদ্ধ করে আমীর সওদাগর ভেলুয়াকে উদ্ধার করেন। ততদিনে স্বামী শোকে-বিরহে মৃতপ্রায় ভেলুয়া স্বামীর কোলে মাথা রেখে চিরবিদায় নেন। এ ঘটনার বিচারে ভোলাকে খুন করে তার ভিটাতে অমর প্রেমের স্বারক হিসেবে বাদশা নসরত শাহ ভেলুয়া দীঘি খননের নির্দেশ দেন। একই সাথে তার সম্পত্তি দখল করে গরীবদের মাঝে বিলিয়ে দেন বাদশা।
চট্টল গবেষক আবদুল হক চৌধুরীর মতে, ভেলুয়া সুন্দরী দীঘি খনন গৌড়ের সুলতান সৈয়দ নাসিরুদ্দিন নশরত শাহর অনন্য র্কীতি। তার (১৫১৯-১৫৩২ খ্রি.) রাজত্বকালে বাংলার স্বাধীন সুলতানী আমলের স্বর্ণযুগ বলা হয়ে থাকে। তিনি ১৫২৫ খ্রিস্টাব্দে উত্তর চট্টগ্রামসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের শঙ্খ নদীর তীর অবধি এলাকা জয় করেন। চট্টগ্রাম নগরীর অদূরে হাটহাজারী থানার ফতেয়াবাদে রাজধানী স্থাপন করেন। রাজধানীর নামানুসারে চট্টগ্রামের নতুন নামকরণ করেছিলেন ফতেয়াবাদ। ভেলুয়া সুন্দরীর সে কাহিনী এখনও বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষের কাছে জনপ্রিয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।